আলোকপাত

পাট খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে করণীয়

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

গত ২০ জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাজারে এক মণ কাঁচা পাট হাজার ২০০ থেকে হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা পাট কাটা ঘরে তোলার মৌসুমে অর্থাৎ গত জুলাই-আগস্টে ছিল হাজার ২০০ থেকে হাজার ৪০০ টাকা। কাঁচা পাটের নজিরবিহীন উচ্চমূল্য পাটচাষীরা পেলে তা হতো সুসংবাদ। কিন্তু তারা উচ্চমূল্য পাচ্ছেন না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চমূল্য পাচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা, যারা পাট কাটার মৌসুমে কম দামে বিপুল পরিমাণ কাঁচা পাট কিনে মজুদ করেন এবং এখন আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি করছেন। পাটজাত পণ্যসামগ্রী উৎপাদনকারী পাটকল মালিকরা কাঁচা পাটের অভাব এবং অতি উচ্চমূল্যের কারণে তাদের মিল বন্ধের হুমকি দিয়েছেন। কাঁচা পাট রফতানিকারকরা রফতানি অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর। অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় আলোচনা করাই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।  

পাট চাষ, পাটজাত সামগ্রী তৈরি, পাট পাটজাত পণ্যাদির ব্যবসা-বাণিজ্য বহুকাল ধরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৫০-৭০ সময়কালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাট পাটজাত পণ্যসামগ্রী রফতানি পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর পাট খাতে কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তীব্র প্রতিযোগিতা, বিশ্ববাজারে কৃত্রিম তন্তুর আবিষ্কার, তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গৃহীত অননুকূল নীতি যথা ৮২টি পাটকল নিয়ে নবগঠিত বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) ওপর অভ্যন্তরীণভাবে পাট কেনা পণ্য উৎপাদনের একচেটিয়া দায়িত্ব প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ, বেসরকারি খাতে পাট ব্যবসা বন্ধ, শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাট রফতানি সংস্থাকে পাট রফতানির দায়িত্ব প্রদান ইত্যাদি কারণে পাট খাতে বিপর্যয় দেখা দেয়। ১৯৭৫-পরবর্তী সরকারের সময়ে অত্যধিক ক্ষতিতে থাকা সরকারি খাতের পাটকলগুলোর বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু, যা পরবর্তী সময়ে অব্যাহত থাকেআশির দশকে  বেসরকারি খাতকে পাটকল স্থাপন পাট ব্যবসার অনুমতি প্রদান পাট খাতে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। বেসরকারি খাতে এখন পাটকলের সংখ্যা আড়াইশ ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে ক্রমাগত লোকসানের কারণ দেখিয়ে সরকার গত জুলাই থেকে বিজেএমসির আওতাধীন ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। এগুলো কী পদ্ধতিতে এবং কখন চালু করা হবে তা অনিশ্চিত, যদিও এগুলো বন্ধ করে দেয়ার আগে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বলেছিলেন, এগুলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) চালু করা হবে।

চলতি অর্থবছরে  উৎপাদিত কাঁচা পাট যে দেশের পাটকলগুলোর চাহিদা পূরণ করতে পারবে না, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাট কাটা মৌসুম শুরুর কিছুদিনের মধ্যে। বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স  অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) পাট কাটা মৌসুমের শেষ দিকে দেশে পাট শিল্প বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় কাঁচা পাট রফতানিতে প্রতি টনে ২৫০ মার্কিন ডলার শুল্কারোপসহ পাঁচ দফার একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পেশ করে। অন্য প্রস্তাবগুলো ছিল নিম্নমানের পাট রফতানি বন্ধ, লাইসেন্সবিহীন অসাধু ব্যবসায়ীদের পাট কেনাবেচা মজুদ থেকে বিরত রাখা, লাইসেন্সধারী ডিলার, আড়তদাররা এক হাজার মণের অতিরিক্ত পাট এক মাসের বেশি মজুদ রাখলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং শুধু সামুদ্রিক বন্দরের মাধ্যমে কাঁচা পাট রফতানি করা। প্রস্তাবের সমর্থনে সংগঠন দুটি যেসব যুক্তি তুলে ধরে সেগুলো ছিলএক. দেশে বছরে সাধারণত গড়ে ৭৫ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়। তবে খরা, অতিবন্যা করোনা মহামারীর কারণে চলতি অর্থবছরে উৎপাদিত হবে প্রায় ৫৫ লাখ বেল কাঁচা পাট। অথচ দেশে পাট শিল্পের জন্যই প্রয়োজন হবে ৬০ লাখ বেল কাঁচা পাট। আর গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্য পাঁচ লাখসহ মোট ৬৫ লাখ বেল কাঁচা পাট দরকার। চাহিদার নিরিখে ১০ লাখ বেল পাট কম উৎপাদন হবে। পাট সরবরাহ ঘাটতির কারণে পাটকল বন্ধ হয়ে গেলে অভ্যন্তরীণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রেতারা পাটপণ্য ব্যবহার থেকে সরে দাঁড়াবেন, যা হবে দেশের পাট শিল্পের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। তিন. দেশে আড়াইশর বেশি পাটকল রয়েছে। এসব পাটকলে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। চাষীসহ প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে খাতে চার কোটি মানুষ জড়িত। কাঁচা পাটের অভাবে পাট শিল্প বন্ধ হলে শ্রমিকরা চাকরি হারাবেন। এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ঝুঁকির মধ্যে পড়বে খাতে অর্থায়নকারী ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।  

অন্যদিকে কাঁচা পাট রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ) সরকারের কাছে পেশকৃত স্মারকে কাঁচা পাট রফতানির ওপর কোনো শুল্কারোপ না করার এবং কাঁচা পাটকে কৃষিপণ্য ঘোষণা করে এর রফতানিতে আর্থিক প্রণোদনার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়। দাবির সমর্থনে তারা যেসব যুক্তি তুলে ধরে সেগুলো হলো: এক. এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে দেশ থেকে কাঁচা পাট রফতানি হচ্ছে এবং কাঁচা পাট রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত হচ্ছে। দুই. কাঁচা পাট রফতানি না হলে পাটের দাম কমে যাবে। এতে পাটচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং পাট চাষে নিরুৎসাহী হয়ে পড়বেন।

বিজেএমএ, বিজেএসএ বিজেএর পরস্পরবিরোধী দাবির ব্যাপারে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে বলে জানা নেই। এদিকে  পাটকল মালিকরা কাঁচা পাটের অভাবে মিল বন্ধের হুমকি দিয়েছেন। তারা পাটকল চালু রাখার স্বার্থে বর্তমানে আমদানি বন্ধ থাকা প্রাকৃতিক তন্তু আমদানির অনুমতিও চেয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।

পাটজাত পণ্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব হওয়া, পাটপণ্যের উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনা এবং পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ বিধিমালা ২০১৩ বাস্তবায়নের ফলে দেশে-বিদেশে পাটের চাহিদা বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে কাঁচা পাট পাটজাত পণ্য রফতানি থেকে আয় হয় মোট ৪০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৩০২ মিলিয়ন আসে পাটজাত পণ্য থেকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কাঁচা পাট পাটজাত পণ্য রফতানি করে মোট আয় হয় হাজার ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৮৭০ মিলিয়ন পাটজাত পণ্য থেকে। করোনা মহামারীর কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাটপণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। সুযোগ যদি নেয়া যায় তাহলে খাতের রফতানি অনেক বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করবে। 

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পাটচাষীরা পাটের বর্তমান উচ্চমূল্যের সুবিধা পাচ্ছেন না। কারণ ধানচাষীদের মতো অধিকাংশ পাটচাষী ক্ষুদ্র প্রান্তিক শ্রেণীর। ক্ষুদ্র প্রান্তিক ধানচাষীরা যেমন তাদের ধার-দেনা পরিশোধ পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে ধান কাটা মৌসুমের শুরুতে চালকল মালিক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের শিকার হয়ে স্বল্পমূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন, তেমনি পাটচাষীরাও পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে মৌসুমের শুরুতে পাট বিক্রি করে দেন। বর্তমানে পাটের অতি উচ্চমূল্য তারা পাচ্ছেন না। দাম পাচ্ছেন স্বল্পসংখ্যক বড় চাষী এবং মজুদদাররা, যারা পাট কাটা মৌসুমে কম দামে বিপুল পরিমাণে পাট কিনে মজুদ করেন এবং এখন অতি উচ্চমূল্যে তা বিক্রি করছেন। তাই সময় এসেছে আমন বোরো ধানের মতো পাট উৎপাদনের খরচ চাষীদের লাভ বিবেচনায় নিয়ে সরকার কর্তৃক শ্রেণীভেদে পাটের মণপ্রতি ন্যূনতম দাম বেঁধে দেয়ার, যাতে পাট কাটার মৌসুমে ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষীদের পাট বিক্রির সুযোগ নিয়ে পাটকল মালিক মজুদদাররা বেঁধে দেয়া দামের কমে পাট কিনতে না পারেন।

এটা ঠিক দেশে পাট উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দশমিক লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় এবং উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় দশমিক ৩৮ লাখ টনে। ২০১০-১১ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যথাক্রমে দশমিক শূন্য এবং দশমিক ২৫ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় এবং উৎপাদিত পাটের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৫ দশমিক ২৬ এবং ১৩ দশমিক ৭৪ লাখ টন। এর অর্থ দাঁড়ায়, পাট উৎপাদনে ধারাবাহিকতার অভাব। তাছাড়া রিপোর্ট মোতাবেক উপর্যুক্ত তিন অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি পাট উৎপাদন ছিল যথাক্রমে দশমিক শূন্য , দশমিক ১৫ এবং দশমিক ৯০ টন। ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে। প্রাপ্ত এক তথ্যে জানা যায়, চীনে এক একর জমিতে দশমিক ১৫ টন পাটের ফলনের বিপরীতে বাংলাদেশে এক একর জমিতে পাটের ফলন শূন্য দশমিক ৬৮ টন। ফলে পাট চাষে জমির পরিমাণ বাড়লেও সে পরিমাণে দেশে উৎপাদন বাড়েনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাট চাষে জমির পরিমাণ বাড়লেও উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। এখন যা প্রয়োজন তা হলো পাটের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। জাতীয় চাহিদা পূরণের জন্য পাট পাটবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণ বিষয়ে প্রযুক্তির সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। উন্নত পদ্ধতি কলাকৌশল অবলম্বনে পাটবীজ উৎপাদনে এবং মানসম্মত পাট উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানে জোর দিতে হবে।

সব শেষে যা বলতে চাই তা হলো, উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেশে পাটের চাহিদা মেটাতে হবে। পাটের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে উন্নত মানের পাটবীজ সরবরাহ, চাষীদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ অন্যান্য বিষয়ে সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের চাহিদা মেটানোর পরই পাট রফতানির বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। পাটের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো গেলে উৎপাদন ব্যয় কমবে। এতে কৃষক, পাটকল মালিক, পাটপণ্য ক্রেতা, পাট ব্যবসায়ী সবাই উপকৃত হবেন। পাটজাত পণ্যসামগ্রী রফতানি প্রতিযোগিতায় আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকব। 

 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন