রোগের উল্লেখ থাকে না ৬৩ শতাংশ ব্যবস্থাপত্রে

ব্যবস্থাপত্র লেখার সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা হোক

বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র লেখার সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-বিধান গাইডলাইন রয়েছে। অমান্য করলে শাস্তির বিধানও রয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় বটেই, উন্নয়নশীল দেশেও ব্যবস্থাপত্রে রোগ ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার বিধান অন্যতম। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র লেখার ক্ষেত্রে নিয়ম মানছেন না। বাংলাদেশে এমন কার্যকর যথাযথ বিধান আছে বলেও জানা যায় না। শুধু তাই নয়, সামান্য অসুখেও অ্যান্টিবায়োটিকের মতো সংবেদনশীল ওষুধ দেয়া হচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই। এমন নানা ত্রুটি দুর্বলতা স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে। রোববার বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে মানবদেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ভবিষ্যতে চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে বিষয়টি জটিলতা বাড়াচ্ছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ব্যবস্থাপত্র লেখার গাইডলাইন যুগোপযোগী তার বাস্তবায়নে তদারকি বাড়াতে হবে।

ব্যবস্থাপত্রে হাতের লেখা নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে কর্তৃপক্ষ একটি নির্দেশনা দিয়েছিল। কিছুদিন সেটি মানা হলেও আবারো পুরনো ধারায় ফিরে গেছেন অনেক চিকিৎসক। অনেক চিকিৎসক আবার প্রিন্ট করে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। তবে ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক নাম না লিখে কোম্পানি প্রদত্ত ওষুধের নাম লিখছেন এখনো। রোগের নাম লেখার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অনীহার কারণ অবশ্য অজানাই রয়ে গেছে। ব্যবস্থাপত্রে রোগের নাম লেখা থাকলে অন্য চিকিৎসকদের বুঝতে সুবিধা হয় রোগী কী ধরনের চিকিৎসার মধ্যে রয়েছেন বা আগে গ্রহণ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে চিকিৎসকরা রোগ ঠিকমতো চিহ্নিত করতে পারেন না বলে ব্যবস্থাপত্রে রোগের নাম লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এটি কতটা সত্য, তা গবেষণার বিষয়। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটের একটি সংখ্যায় বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বছরে কমপক্ষে লাখ ১৪ হাজার নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করার কারণে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি যে যথেষ্ট ভয়াবহ, তা বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গত কয়েক বছরে কিছু বিশেষায়িত হাসপাতালের আইসিইউতে আসা ২৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে সংক্রমণে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। বাংলাদেশে সার্বিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ব্যবহার নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণ বাড়ছে ভয়ংকরভাবে। হতাশার বিষয় হলো, দেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কার্যকর যুগোপযোগী নীতিমালাও নেই।

চিকিৎসকদের বক্তব্য হলো, সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে একজন চিকিৎসক দিনে সর্বোচ্চ ৩০ জন রোগী দেখতে পারেন। কিন্তু কোনো কোনো সময় তাকে শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়। সব হাসপাতালে পরীক্ষার সুযোগ থাকে না। এছাড়া সম্পদ লোকবলের সংকট রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা সঠিকভাবে তার সমস্যা বলতে পারে না। আর পরীক্ষা ছাড়া রোগের সঠিক নির্ণয় সম্ভব নয়। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এটিও অস্বীকারের উপায় নেই। এক্ষেত্রে রোগী চিকিৎসক উভয়ের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ গাইডলাইন প্রণয়ন তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অ্যান্টিবায়োটিক হলো এক অর্থে মিরাকল ড্রাগ কিন্তু এর যথেচ্ছ ভুল ব্যবহারে এই ওষুধের কার্যকারিতা দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। আবার অ্যান্টিবায়োটিক-পূর্ব যুগে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত যাতে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা না হয়, বিষয়টি সবাইকে কঠোরভাবে মানতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লেখার ক্ষেত্রে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। প্রেসক্রিপশনে রোগীর নাম, বয়স, তারিখ এবং ক্ষেত্রবিশেষে শিশুদের ওজনও লিখতে হয়। বাম দিকে রোগের বিবরণ লিখতে হয়। এরপর চিকিৎসককে রোগীর লক্ষণগুলো লিখতে হয়। তারপর ডান দিকে আরএক্স চিহ্ন দিয়ে ওষুধের নাম লিখতে হয় এবং নিচে চিকিৎসকের স্বাক্ষর দিতে হয়। আর ওষুধ লেখার সময় ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা ইনজেকশন এটা লিখতে হয়। এটা কত মিলি, ডোজ কতটুকু, খাওয়ার আগে না পরে তা লিখতে হয়। সেই সঙ্গে ওষুধের নামটা অবশ্যই ইংরেজিতে লিখতে হয়। সরকারি হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন এত ছোট যে তাতে সবকিছু লেখাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে আলাদা প্যাডের ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন।

একটি আদর্শ চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে কী কী বিষয় থাকা বাধ্যতামূলক, তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ড অনুসরণ করে। তবে কিছু বিষয় সব দেশের ক্ষেত্রে একই। যেমন ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা, রোগের নাম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশেও এমন মানদণ্ড প্রণয়ন করা প্রয়োজন। মাঝে উচ্চ আদালত -সংক্রান্ত একটি রুল জারি করে কিছু দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ -সংক্রান্ত কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং কোন পর্যায়ে রয়েছে বিষয়টি, তা জানা যায় না। ফলে রোগীর ভোগান্তি বাড়ছে। একথা অস্বীকারের উপায় নেই, দেশে চিকিৎসকের বিপরীতে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সঠিক উপায়ে প্রতিটি রোগীর জন্য যথাযথ নিয়ম মেনে ব্যবস্থাপত্র লেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার পরও ন্যূনতম কিছু বিধান থাকা আবশ্যক। সেক্ষেত্রে যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক লেখার প্রবণতা রোধ করা প্রয়োজন। -সংক্রান্ত যুুগোপযোগী গাইডলাইন প্রণয়ন তার বাস্তবায়ন তদারকি জোরদার করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন