বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষা

অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে

সাইফ সুজন

দেশে এখন অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৭। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় থাকা ৯৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী সাড়ে তিন লাখের মতো। যদিও তাদের অর্ধেকই ২০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অনুমোদনের বাইরেও বিভিন্ন নামে প্রোগ্রাম খুলে ভর্তি নেয়া হচ্ছেএমন অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থী সংখ্যায় এগিয়ে থাকা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আসন সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি ভর্তি করছে। এসব কারণে প্রত্যাশিতসংখ্যক শিক্ষার্থী পাচ্ছে না অন্যগুলো। এজন্য শিক্ষার্থী ভর্তিতে ভারসাম্য আনতে আসন সংখ্যা বেঁধে দেয়ার কথা ভাবছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)

দেশে বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষার যাত্রা ১৯৯২ সালে। শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রোগ্রাম অনুমোদন দেয়ার প্রক্রিয়া এখনকার চেয়ে তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। এমনকি প্রোগ্রামগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য আসন সংখ্যাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হতো না। সুযোগ কাজে লাগিয়ে তখন পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সক্ষমতার বাইরেও অনেক প্রোগ্রামের অনুমোদন নিয়ে নেয়। এসব বিভাগে নিজেদের ইচ্ছামতো শিক্ষার্থী ভর্তি করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

অন্যদিকে সনদ বাণিজ্যের মতো গুরুতর নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক বছরে প্রোগ্রাম অনুমোদন প্রক্রিয়ায় নানা শর্ত যোগ করেছে তদারক সংস্থা ইউজিসি। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর হয়নি, তাদের কোনো প্রোগ্রামই অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতি বছর সর্বোচ্চ একটি প্রোগ্রাম অনুমোদন দেয় ইউজিসি। আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বছরপ্রতি সর্বোচ্চ দুটি প্রোগ্রাম অনুমোদন দেয়ার সুযোগ থাকলেও সেক্ষেত্রেও বেশকিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। এসব কারণে এখন আর আগের মতো সহজে প্রোগ্রাম চালু করতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এছাড়া নতুন প্রোগ্রাম অনুমোদন দেয়ার সময় আসন সংখ্যাও বেঁধে দেয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রাসী কার্যক্রমের কারণে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই ভুক্তভোগী। নামে-বেনামে প্রোগ্রাম খুলে কয়েক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি সেমিস্টারে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে। কারণে তাদের আয়ও অনেক বেশি। আয় বেশি হওয়ায় তাদের সুযোগ-সুবিধাও অন্যদের চেয়ে বেশি। তাই শিক্ষার্থীও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর বাড়ছে। অন্যদিকে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীই পাচ্ছে না।

বিষয়টি ইউজিসির কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রোগ্রামভিত্তিক যে আসন সংখ্যা বেঁধে দেয়া হয়েছে, তা অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা, সেটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এছাড়া আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। আসন সংখ্যা নির্ধারণ করে না দেয়ায় সনদ বাণিজ্যের সুযোগ থেকে যাচ্ছে। এছাড়া প্রতি সেমিস্টারে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের তথ্য একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এতে ইচ্ছামতো শিক্ষার্থী ভর্তি করে সনদ বিক্রির সুযোগও বন্ধ হবে।

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষার্থী ছিল লাখ ৪৯ হাজার ১৬০ জন। এর মধ্যে শিক্ষার্থী সংখ্যা বিবেচনায় এগিয়ে থাকা ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিল লাখ ৯০ হাজার ৩৩৭ জন শিক্ষার্থী। হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ৫৫ শতাংশই ২০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের।

নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য বিশ্লেষণ করেও একই ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে। ইউজিসির হিসাবে ২০১৯ সালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট লাখ ২০ হাজার ২৭৬ জন নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তাদের ৫২ শতাংশই ভর্তি হয়েছেন শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যায় শীর্ষে থাকা ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থী সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (এনএসইউ) গুণগত শিক্ষার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুদের পছন্দের শীর্ষে থাকে উচ্চ শিক্ষালয়। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষাবর্ষে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যার চেয়েও বেশি। ২০২০ সালে হাজার ১৩১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়েছে এনএসইউতে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৪ সালে হাজার ২৭০, ২০১৫ সালে হাজার ৫৭৫, ২০১৬ সালে হাজার ৪০২, ২০১৭ সালে হাজার ৯৯০, ২০১৮ সালে হাজার ২৯৩ ২০১৯ সালে হাজার ৩১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অর্ধেকের বেশিই বিবিএর। যদিও নর্থ সাউথের বিবিএর অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নর্থ সাউথে শুধু বিবিএ পড়ানোর জন্য ১১টি প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। এসব প্রোগ্রামের মধ্যে রয়েছেবিবিএ, বিবিএ ইন অ্যাকাউন্টিং, বিবিএ ইন ইকোনমিকস, বিবিএ ইন অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ, বিবিএ ইন ফাইন্যান্স, বিবিএ ইন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, বিবিএ ইন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, বিবিএ ইন ম্যানেজমেন্ট, বিবিএ ইন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস, বিবিএ ইন মার্কেটিং, বিবিএ ইন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বিবিএ জেনারেল।

যদিও ইউজিসি বলছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০০২ সালে বিবিএ নামে একটি প্রোগ্রাম অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিবিএ বিষয়ে আর কোনো প্রোগ্রামই অনুমোদন দেয়া হয়নি। অননুমোদিত প্রোগ্রাম পরিচালনা করায় সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে লালতারকায় চিহ্নিত করা হয়েছে ইউজিসির ওয়েবসাইটে। প্রসঙ্গে ইউজিসির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষক সংখ্যা অবকাঠামো সুবিধা যাচাই করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রোগ্রামের অনুমোদন দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে ইউজিসির ওয়েবসাইটে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক অনুমোদিত প্রোগ্রামের তালিকাও প্রকাশ করা হয়। নর্থ সাউথকে ইউজিসির পক্ষ থেকে শুধু একটিমাত্র বিবিএ প্রোগ্রাম অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও তারা ১১টি প্রোগ্রাম খুলে শিক্ষার্থী ভর্তি নিচ্ছে। বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খুব শিগগির নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি চিঠি পাঠানো হবে।

তবে এনএসইউ কর্তৃপক্ষের দাবি, অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রসঙ্গে নর্থ সাউথের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের শীর্ষ একজন ব্যক্তি বণিক বার্তাকে বলেন, গুণগত শিক্ষার জন্য নর্থ সাউথ যখন জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে, তখন ইউজিসি তাদের সহযোগিতার বদলে পেছনে টেনে ধরছে। দেশ বৈশ্বিক চাকরির বাজারে আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা খুবই ভালো করছে। এনএসইউর কোনো সেকশনে ৩০-৩৫ জনের বেশি পড়ানো হয় না। মানসম্মত শিক্ষক উন্নত অবকাঠামো থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ভর্তিচ্ছুরা আগ্রহী। আর অন্যরা শিক্ষার্থীই পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে অন্যদের ঈর্ষান্বিত হওয়াই স্বাভাবিক। আসন নির্ধারণ করে দিলে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা কমে যাবে। এর ফলে শিক্ষার গুণগত মান কমে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। শিক্ষার্থীরা যেহেতু নিজেদের অর্থে পড়বে, বিষয়টি তাদের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভালো।

শিক্ষার্থী সংখ্যায় এগিয়ে থাকা ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে অননুমোদিত প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিএসসি ইন সিএসই, বিএসসি ইন আইপিই, বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি ইন ইইই বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি করে প্রোগ্রাম অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যদিও দুটি ভাগে এসব প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তি নেয় ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি। একইভাবে রাজধানীর বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা এলাকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও অননুমোদিত প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি কার্যক্রমে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীর একটি ছক পাঠিয়ে ভর্তিসংক্রান্ত তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে ভর্তি বিষয়ে একটি গাইডলাইন করে দিতে চায় কমিশন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক . বিশ্বজিৎ চন্দ বণিক বার্তাকে বলেন, আইন অনুযায়ী ইউজিসির অনুমোদিত প্রোগ্রামের বাইরে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সম্পূর্ণ অবৈধ। তাই কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, সেটি অবশ্যই আইনবিরুদ্ধ কাজ। এছাড়া প্রতিটি প্রোগ্রামে সর্বোচ্চ কত শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে, সে বিষয়েও ইউজিসির নির্দেশনা রয়েছে। যদিও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তা অনুসরণ করছে না। সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি, শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েটদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সবার জন্য একটি গাইডলাইন করে দেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন