সময়ের আলোয়

করপোরেট সুশাসনের ভবিষ্যৎ

আব্দুল্লাহ শহীদ

মানুষ থেকে তত্ত্বের উদ্ভব হয়। বিজ্ঞানের উত্তরণকালে জাগতিক ধারণার সহজ, প্রয়োজনীয় উপস্থাপন হিসেবে তত্ত্ব সমীহ পেতে থাকে। তবে আমরা ভুলে যাই তত্ত্বেরও নিজস্ব প্রাণ আছে। তত্ত্ব যখন শক্তিশালী হয় এবং মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যায়, তত্ত্ব তখন মানুষকে চালায়; মানুষের মনোযোগ, শ্রম বস্তুজগতের ব্যবহার বণ্টনের ওপর প্রভাব খাটায়। তাই মানবসমাজ বস্তুজগতের নিবিড় সম্পর্ক বুঝতে আমাদের তত্ত্বের জীবনচক্র বুঝতে হবে। যেমন একসময় আমাদের মানবসমাজ ভাবত কিছু মানুষ পরিবার পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তারা বিধাতার হয়ে মানুষের শাসন করার প্রকৃত পবিত্র ক্ষমতা রাখে। এরূপ তত্ত্ব বিশ্বাসের বশে বিশাল মানবকুল রাজতন্ত্র পরিবারতন্ত্রের এবাদত করলএটা  করপোরেট বা সামষ্টিক শাসনের এক রূপ। কিছু সমাজে আজও সে রকম শাসন পদ্ধতি চালু আছে। আবার কিছু সমাজ ভাবল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভয়হীনভাবে, বেনামি মতের ভিত্তিতে নির্ধারণ করবে কারা শাসন করবে, কারা শাসন ব্যবস্থা, আইন বানাবে। এভাবে আমরা তাত্ত্বিকভাবে গণতন্ত্রে পা দিলাম। বিংশ শতাব্দীতে রকম আরেক তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে, যাকে গড়পড়তাভাবে বলা হয় করপোরেট গভর্ন্যান্স বা করপোরেট সুশাসন এক্ষেত্রে করপোরেট বলতে সব সামষ্টিক মানবকুল নয়; বরং বিশেষভাবে পুঁজির একত্রীকরণে একসঙ্গে আসা (যেমন শেয়ারহোল্ডার) মানুষের দলকে বোঝানো হয়, যা করপোরেশনে রূপ নেয়। নিম্নে ধারণার তাত্ত্বিক উদ্ভব এবং তার প্রায়োগিক দিকের কিছু দুর্বলতা তুলে ধরছি। আশা করি, এই আলোচনা থেকে প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যমূলক সুশাসন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে ইতিবাচক কিছু যোগ হবে। সহজ উপস্থাপনের চেষ্টায় এখানে কোম্পানি, করপোরেশন এবং ফার্ম সমার্থকভাবে ব্যবহার করেছি।

করপোরেট সুশাসনের ভাবনা প্রাথমিকভাবে প্রকাশ পায় এডলফ বারলে গারডিনার মিন্সের ১৯৩২ সালে প্রকাশিত বই মডার্ন করপোরেশন অ্যান্ড প্রাইভেট প্রপার্টি-এ। প্রায় এক দশক আগের প্রেক্ষাপট থেকেই বইয়ের বিশ্লেষণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী  আমেরিকায় তখন করপোরেশনের উত্তরণের সময়। জনসাধারণের ক্ষুদ্র পুঁজির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠল অনেক করপোরেশন। পুঁজির বণ্টন ব্যবস্থাপনার জন্য পাশাপাশি উদয় হলো ব্যবস্থাপক বা ম্যানেজার শ্রেণীর। যেহেতু ম্যানেজার অনেক ক্ষুদ্র পুঁজির মানুষের (বিনিয়োগকারী) প্রতিনিধি (এজেন্ট) হয়ে কাজ করেন। প্রশ্ন ওঠে, এই ম্যানেজাররা প্রতিনিধিত্ব সঠিকভাবে করেন কিনা, পুঁজির অপব্যবহার করে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করছেন কিনা। যেমন ব্যবস্থাপক নিজেকে বেশি বেতন দিতে পারেন; আরাম-আয়েশের জন্য অলাভজনক, কম লাভজনক প্রজেক্টে করপোরেশনের টাকা অপব্যয় করতে পারেন। বারলে মিন্স রকম নানা আশঙ্কার ভিত্তিতে প্রস্তাব করেন করপোরেট সুশাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদের সঙ্গে গলা মেলালেন বিনিয়োগকারী, গবেষক আইনপ্রণেতারা।

সেই পরম্পরায় শুরু হলো আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, গবেষণাকীভাবে কতিপয় ব্যবস্থাপকের হাতে থাকা বিক্ষিপ্ত, রাজনৈতিকভাবে অসংগঠিত বিনিয়োগকারীর পুঁজির সঠিক ব্যবস্থাপনা, বণ্টন লাভ নিশ্চিত করা যায়। বোর্ড অব ডিরেক্টর বা পরিচালনা পর্ষদের ধারণা সুশাসনের পদ্ধতি হিসেবে বিস্তার লাভ করল। পরিচালনা পর্ষদ এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে, যারা বিনিয়োগকারীদের লাভের বর্তমান ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ব্যবস্থাপকদের ওপর তদারকি, খবরদারি করবেন। -বিষয়ক বিভিন্ন তত্ত্বের উদ্ভাবন হলো। যেমন রোনাল্ড কোজ লিখলেন এক যুগান্তকারী নিবন্ধ, দ্য নেচার অব দ্য ফার্ম প্রকাশিত হয় ইকোনমিকা জার্নালে, ১৯৩৭ সালে। নিবন্ধের ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন কোজ। তার কথা ছিল, যা ফার্মের বাইরে উৎপাদন করা ব্যয়বহুল হবে, ফার্ম তা নিজে উৎপাদন করবে। কথাটা সহজ হলেও তার গভীরতা লুকিয়ে আছে সমাজের মধ্যে মানুষে মানুষে করা চুক্তির মধ্যে। চুক্তির  আনুষঙ্গিক খরচদরকষাকষি করা, কেনাবেচার তথ্য সংগ্রহ যাচাই-বাছাইয়ে অর্থ সময় ব্যয়, ট্রেড সিক্রেট বা বাণিজ্যিক গোপনীয়তা রক্ষা করা, চুক্তি তদারক বাস্তবায়নের খরচ। কারণে ব্যক্তি পর্যায়ে বাজারে গিয়ে প্রতিটি চুক্তি করা ব্যয়সাধ্য নয়। সমাজে অবস্থিত অর্থনীতি শাসন ব্যবস্থার কারণে যদি ব্যক্তি পর্যায়ে চুক্তি করা কঠিন হয়ে যায়, তখন ফার্ম বা করপোরেশনের আদলে আইনি সত্তার উদ্ভব ঘটে। সত্তা চুক্তির খরচ কমায়, চুক্তি কার্যকর করতে সহায়তা করে। সেখানেই এডাম স্মিথের তত্ত্বকোনো রকমের আপদ-বিপদ না থাকলে বাজারেই সব লেনদেনের কাজ মানুষ সারতে পারবে ধারণার ভিত নাড়িয়ে দিলেন কোজ। ফলে করপোরেশনকে নানা চুক্তির সমষ্টি হিসেবে দেখার তাত্ত্বিক আঙ্গিক চালু হয়। মাইকেল জেনসেন উইলিয়াম মেকলিং ব্যবস্থাপকদের তদারকির জন্য শেয়ারহোল্ডারদের যে খরচাদি বহন করতে হয়, তার একটা তত্ত্ব দেন, যা এজেন্সি থিউরি হিসেবে করপোরেট সুশাসনের গবেষকদের মাঝে সমাদৃত। সার কথা, তত্ত্ব এমন জায়গায় দাঁড়াল যে ব্যবস্থাপক ফার্মের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন চুক্তি, সম্পদের বণ্টন, ক্রয়-বিক্রয় কীভবে করলে শেয়ারহোল্ডার, বিনিয়োগকারী তথা করপোরেশনের আসল মালিকদের সম্পদের সর্বোত্কৃষ্ট ব্যবহার হবে তা নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক জারি থাকল।

এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা তার মিত্রশক্তি জয়লাভ করল। ইউরোপ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞ দেখল। তবে আমেরিকা অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগতভাবে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে গেল। মনে করতে হবে কালেভদ্রে তত্ত্ব যখন বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, মানুষ তা তত্ত্বের সাফল্য হিসেবে ভাবা শুরু করে এবং তত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে। ফলে আমেরিকার আদলে করপোরেট সুশাসন এবং অন্যান্য সমাজ অর্থ ব্যবস্থার পদ্ধতি ধারণা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে এক্ষেত্রে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ব্রেটন উডস ইনস্টিটিউশন যেমন ওয়ার্ল্ড ব্যংক আইএমএফকে দায়ী করেন। তবে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় পশ্চিমা আদলের শাসন পদ্ধতি যে পুরোপুরি পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়ার ফসল তা নয়। বেথ সিম্মন্স, ফ্রাঙ্ক ডব্বিন জিওফ্রি গেরেট সম্পাদিত বই গ্লোবাল ডিফিউশন অব মার্কেটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি তথ্যসহ দেখিয়ে দেয় পশ্চিম থেকে আসা সুশাসনের বিভিন্ন ধারণা, তত্ত্ব নীতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরে চার সামাজিক পদ্ধতিতে (সোস্যাল মেকানিজম): () কোয়ারশন বা বল প্রয়োগ, () ইমিটেশন বা অনুকরণ () অ্যাডাপ্টিভ ইম্যুলেশন বা অভিযোজক অনুকরণ এবং () কম্পিটিশন বা প্রতিযোগিতা। তবে কোন পদ্ধতি কোন দেশে কীভাবে কাজ করেছে, তা তর্কসাধ্য এবং তথ্য-উপাত্তের আলোকে আরো ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ আছে।

বাংলাদেশে করপোরেট গভর্ন্যান্স আলোচনায় নিয়ে আসতে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন পরে গেজেটের মাধ্যেমে করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড চালু করে (দেখুন আগস্ট , ২০১২ এবং তার পরবর্তী প্রাসঙ্গিক নোটিফিকেশনগুলো) এখানে পশ্চিমা আদলে সুশাসনের বিভিন্ন ধারা আছে: বোর্ড অব ডিরেক্টর কয়জন হবে, কারা হবে (যেমন ন্যূনতম এক অংশ হবে ইনডিপেনডেন্ট), ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টরের যোগ্যতা, বোর্ডের প্রধান সিইও আলাদা ব্যক্তি হবে, বোর্ড অব ডিরেক্টরের শেয়ারহোল্ডারদের কাছে কী রিপোর্ট দেবেন, বোর্ড বছরে কয় দিন মিটিং করবে, অডিট কমিটির কী গুরুত্ব ইত্যাদি। এসব ইতিবাচক পদক্ষেপ। অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দেশে এসব করপোরেট গভর্ন্যান্স কোডের সঙ্গে কোম্পানির আয় শেয়ারের মূল্যমানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পাওয়া যায়। তাছাড়া করপোরেট মুনাফার রিপোর্টে বিভিন্ন লুকাছাপা (যেমন আর্নিংস ম্যানেজমেন্ট বা লাভ-লোকসানের খতিয়ানে অপকৌশল) কমে আসার প্রমাণ মিলে। তো অনেকাংশে বলতে পারেন বারলে, মিন্স, কোজ, জেন্সেন, মেকলিং যে ম্যানেজারদের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের বিপরীতে পুঁজির ব্যবহার, বণ্টন, বিনিয়োগ নিয়ে আশঙ্কা করেছিলেন, করপোরেট গভর্ন্যান্সের কোড বা তার কিছু অংশ তা কমায়। তবে আলোচনা এই জায়গায় থেমে থাকলে করপোরেট পুঁজির অপব্যবহার রোধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, যেসব উন্নয়নশীল দেশ আমেরিকা, ইউরোপের অনুসরণে করপোরেট সুশাসনের ধারণা তত্ত্বের ভিত্তিতে করপোরেট সুশাসন চালু করেছে, তাদের কিছু গোড়ার কথা, মৌলিক বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে; আবার নিজেদের সংস্কৃতি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও ভুললে চলবে না। তত্ত্বকে আমাদের পরিচালিত করতে না দিয়ে, বরং আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী তত্ত্বকে কাজে লাগাতে হবে। নিম্নে রকম কয়েকটি বিষয় পেশ করছি।

করপোরেট কারা?

কোম্পানি সুশাসন নিয়ে বিস্তারিত গাইডলাইন চালু এবং তার সক্রিয় পালনের পাশাপাশি আমাদের রোনাল্ড কোজের মতোই মৌলিকভাবে ভাবার সময় এসেছেকোম্পানি কী, ফার্ম কী? কারণটা হলো প্রযুক্তিগত দ্রুত পরিবর্তন, মেশিন লার্নিং, ব্লক চেইন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সময়ে লেনদেন, চুক্তি কোম্পানির ধরন দ্রুত বৈশ্বিক, সংজ্ঞাহীন, সীমানাহীন হয়ে উঠছে। আরো ভাবতে হবে শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্ত (লিস্টেড) কোম্পানিগুলোয় বিস্তারিত তদারকির পাশাপাশি প্রাইভেট পরিবার নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর নানা রকম চুরির কারসাজি কলেবর ছোট থাকতেই কীভাবে আটকানো যায়। বাংলাদেশ এখনো প্রাথমিকভাবে শেয়ারবাজারনির্ভর অর্থনীতি নয়। ক্ষুদ্র পুঁজির বিনিয়োগকারীরা আজও তাদের সঞ্চয় ব্যাংকে রাখেন। তাদের পক্ষ হয়ে বিনিয়োগ করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কি যথাযথ সুশাসনের মধ্যে থেকে বিনিয়োগ কাজ পরিচালনা করছে? এখানে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক তাদের সঞ্চয়কারীদের মধ্যে যে এজেন্সি সমস্যা, তার নিয়মিত প্রতিকারের উপায় কী? করপোরেট সুশাসনের বর্তমান যে গাইডলাইন, তা ধরনের সমস্যার বিস্তারিত সমাধান করতে পারছে না। 

আবার ভার্চুয়াল লেনদেনের উত্তরোত্তর প্রসারের ফলে বিশ্বজুড়ে আলোচনা হচ্ছেকোম্পানি তার স্টেকহোল্ডার কারা, দুইয়ের গতানুগতিক ধারণা সংজ্ঞার দ্রুত পরিবর্তন। ভার্চুয়াল লেনদেনের ব্যাপারে প্রাথমিক রূপরেখা, আলোচনাপত্র ইত্যাদি ছাড়তে হবে। তবে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি মাধ্যমের কারণে চটজলদি কানুন প্রণয়ন সুবিবেচিত নয়; বরং আলোচনার মাধ্যমে ছোট কলেবরে পরীক্ষামূলক কানুন চালু করে তার সুবিধা-অসুবিধা যাচাইয়ে খোলা মন নিয়ে এগোতে হবে।

ইনডিপেনডেন্ট আর নেটওয়ার্ক-এর মধ্যে পার্থক্য কী?

আহারে ইনডিপেনডেন্ট বা স্বাধীন পরিচালক! ব্যবসায় নিরপেক্ষ স্বাধীন পরিচালক থাকলে অন্যদের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে মত দিতে পারেন। কিন্তু ব্যবসায় নিরপেক্ষতা স্বাধীন মতামত কি শুধু শেয়ারহোল্ডিংয়ের অংশ দিয়ে বিচার করা যায়? মিশিগান ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মার্ক মিজরুচি বিষয়ে অনেক নেটওয়ার্কভিত্তিক মাপজোখ দিয়েছেন, যা পরবর্তী সময়ে সমাজবিজ্ঞান ব্যবস্থাপনায় ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। যেমন দেখা যায় সিইও পরিচালকরা স্কুল, কলেজ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, যেটা তাদের করপোরেট সিদ্ধান্তে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। যেসব সমাজ, পরিবার গোষ্ঠীর সম্পর্কের বন্ধনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে, সেখানে সামাজিক মাধ্যমে পরিচালক এক্সিকিউটিভদের দূরত্ব অনেক ছোট হওয়ার কথা। কিছুদিন আগে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনার এক কনফারেন্সে মার্ক মিজরুচি বলে ফেললেন, সামাজিক নেটওয়ার্কের যে প্রভাব তিনি আমেরিকার জন্য আবিষ্কার করেছিলেন, তা বরং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে (. কোরিয়া, চীন) বেশি প্রভাব ফেলে করপোরেট কর্মকাণ্ডে। সাংস্কৃতিক অনুমানের ভিত্তিতেও তা উড়িয়ে দেয়ার জো নেই।

ক্ষুদ্র পুঁজির ক্ষমতায়ন কি আদৌ সম্ভব?

ক্ষুদ্র পুঁজির বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ক্ষমতা সাধারণভাবেই সমাজে অতিমূল্যায়িত হয়। ধারণা অমূলক। কোম্পানির ব্লকহোল্ডার বা বেশি শেয়ারের মালিকের হাতেই সংগঠনের ক্ষমতা বেশি থাকার কথা। তাছাড়া ছোট আকারের পুঁজি দিয়ে শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে ট্রানজেকশন কস্ট বা লেনদেন মূল্য অনেক বেশি। আমেরিকায় ক্ষুদ্র পুঁজির বিনিয়োগকারীরা এখন বড় বড় পেনশন ফান্ড, ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ইত্যাদির কাছে টাকা দেন শেয়ারে বিনিয়োগ করার জন্য। সে রকম প্রবণতা বিভিন্ন দেশে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এসব ফান্ডের ব্যবস্থাপকরা যে সবসময় ক্ষুদ্র পুঁজির স্বার্থ পুরোপুরি দেখভাল করতে পারবেন তা নয়। প্রতিযোগিতা কম থাকলে ফান্ডের ব্যবস্থাপকরা অতিরিক্ত ফি, কমিশন আদায় করে ক্ষুদ্র পুঁজির বিনিয়োগকারীদের লাভের অনেকটা নিজেরাই লুফে নিতে পারেন।

বাজার নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা কতটুকু

শেয়ারবাজারের রেগুলেটরদের (যেমন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) অনেকে জাদুর কাঠি মনে করেন। কিন্তু দিন শেষে এসব মানুষই চালায়। তাই কোম্পানিগুলোয় সুশাসন স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেখতে হবে রেগুলেটরের লোকবল টেকনিক্যাল সক্ষমতা কেমন। এই সক্ষমতার স্বচ্ছতা কতটুকু থাকবে তা নিয়ে সক্রিয় আলোচনা তর্ক দরকার আছে। সমাজ, সংস্কৃতি অর্থনীতি ভেদে এই সক্ষমতা কতটুকু, যথাযথ তা ভেবে নিতে হবে; গড়পড়তা ইউরোপ-আমেরিকার আদলে রেগুলেটর মডেল অন্যান্য দেশে প্রযোজ্য হবে, তা ভাবা অপরিণামদর্শী।

পরিশেষে বলতে চাই, পশ্চিমা তত্ত্বের আলোকে করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুবিধা-অসুবিধা উভয়ই আছে। সুবিধা হলো, পশ্চিমাদের অভিজ্ঞতা দেখে অন্যরা ভুলত্রুটি কমাতে পারে। অসুবিধা হলো, পশ্চিমা তত্ত্বের হুবহু অনুকরণ বিভিন্ন দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যমূলক না- হতে পারে। তখন তত্ত্বের আতিশয্যে বেদরকারি আমলাতন্ত্র জটিলতা বৃদ্ধি হবে, যা বিদ্যমান সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলবে। সাধারণ মানুষের তাতে উন্নতি নেই।

 

আব্দুল্লাহ শহীদ: পিএইচডি গবেষক, সমাজবিজ্ঞান, কর্নেল ইউনিভার্সিটি নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন