বদলে যাওয়া বাজার ও জনজীবনে তার প্রভাব

রঞ্জন সাহা পার্থ

গ্রামের বাজারের কথা শুনলেই এমন দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠত যেখানে খোলা মাঠে বা কাঁচা রাস্তার পাশে কৃষক কিছু পণ্য বিক্রয় করছেন, গ্রামের মানুষ হাতে বস্তা বা ব্যাগ নিয়ে বাজার করে বাড়িতে ফিরছেন, রাতের অন্ধকারে কুপি জ্বালিয়ে বাজারে মাছ বিক্রির জন্য বসে আছেন বা সাপ্তাহিক হাটের দিনে অধিকসংখ্যক মানুষের সমাগম ও নানা ধরনের পণ্য বিক্রয় হচ্ছে। গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থার এ চিরায়ত দৃশ্যের অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। এ পরিবর্তনের অনেক প্রেক্ষাপট রয়েছে। গ্রামের বাজারের যেমন অবকাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে তেমনি পরিবর্তন হয়েছে পণ্য ব্যবস্থাপনায়। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এ পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটের বহুবিধ কারণের মধ্যে গ্রামীণ সমাজে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির বিস্তার, অভিবাসন, গ্রাম-শহরের যোগাযোগ বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারের মতো বিষয়াবলি অন্যতম।

ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা যেমন—টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টি পরিলক্ষিত হয় যে সত্তর ও আশির দশকে কৃষিতে যান্ত্রিক ও রাসায়নিক প্রযুক্তির বিস্তার কৃষককে কৃষি উৎপাদনের উপকরণ সংগ্রহের জন্য বাজারের ওপর অধিক নির্ভরশীল করে তোলে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের আগে কৃষি উপকরণ যেমন—সার, বীজ, কীটনাশক কৃষক নিজ গৃহে তৈরি বা সংগ্রহ করতেন। যান্ত্রিক ও রাসায়নিক প্রযুক্তির বিস্তার শুধু কৃষি পদ্ধতিরই পরিবর্তন আনে না, পারিবারিক কাঠামো, সমাজকাঠামো এমনকি গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থারও পরিবর্তন সাধন করে। আগে মানবশ্রম বিশেষত গৃহের নারীশ্রম থেকে শুরু করে মাঠে পুরুষশ্রম কৃষি উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করত। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব কৃষিক্ষেত্রে মানবশ্রমের গুরুত্বকে অনেকাংশেই হ্রাস করে। বীজ, সার, কীটনাশক সংরক্ষণ ও তৈরিতে যেখানে গৃহের নারীর শ্রমের গুরুত্ব ছিল অধুনিক প্রযুক্তির বিস্তার তা পাল্টে বাজারের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষের প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে রাসায়নিক সার ও যান্ত্রিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে কৃষক উৎপাদনের উপকরণ সংগ্রহের জন্য গৃহের পরিবর্তে বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা তাদের এজেন্ট/ডিলার গ্রামে সার, বীজ, কীটনাশক বিক্রির জন্য দোকান প্রতিষ্ঠা করে। এ ধরনের বাণিজ্যের প্রসার শুধু উৎপান পদ্ধতি বা সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলে না, গ্রামীণ বাজারের অবকাঠামোগত পরিবর্তনেও প্রভাব ফেলে। আশির দশকে গ্রামের বাজারে টিনের তৈরি দোকানপাটের সংখ্যা বাড়তে থাকে যা পরবর্তী সময়ে অনেক ক্ষেত্রে ইটের দোকানে রূপান্তর হয়। আধুনিক প্রযুক্তি বিকাশের শুরুর দিকে গ্রামে রাসায়নিক প্রযুক্তি বিক্রি হলেও যান্ত্রিক প্রযুক্তি যেমন ট্রাক্টর, পাম্পজাতীয় প্রযুক্তি ক্রয়ের জন্য জেলা শহর, ক্ষেত্র বিশেষে ঢাকায় যেতে হতো। নব্বইয়ের দশকের দিকে যান্ত্রিক প্রযুক্তির চাহিদা বৃদ্ধির কারণে গ্রামের বাজারে সেগুলো বিক্রি হতে থাকে। এসব প্রযুক্তির মূল্য অনেক বেশি তাই এগুলো দোকানে রাখতে গিয়ে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে দোকান মালিক বা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামের বাজারে ইটের তৈরি দোকান নির্মাণ শুরু করে। এভাবে গ্রামের বাজারে অবকাঠামোগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। আবার সার-কীটনাশকের মতো প্রাত্যহিক কৃষি উপকরণ বিক্রির জন্য গ্রামেও নতুন বাজার ও বিজ্ঞাপন ব্যবস্থার প্রসার ঘটছে যা কয়েক দশক আগেও ছিল অনুপস্থিত। ট্রাক্টর ও অন্যান্য মেশিনারিজ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য যে ডিজেল প্রয়োজন হয়, ক্ষুদ্র পরিসরে তা তার বিক্রয়কেন্দ্র বা দোকান তৈরি হয়েছে। ট্রাক্টর, পাম্পের মতো মেশিনারিজ মেরামতের জন্য ছোট পরিসরে মেরামত কেন্দ্রের আবির্ভাব গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। 

প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ব্যাংকঋণ ও এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণের চাহিদা বেড়েছে। যান্ত্রিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণের প্রচলন ঘটতে শুরু করেছে, যদিও গ্রামের খুব কম মানুষই ব্যাংকঋণ গ্রহণ করে। যান্ত্রিক প্রযুক্তি ক্রয়ে এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণের প্রবণতা কম থাকলেও ক্ষুদ্র জমির মালিকেরা চারা রোপণ বা চাষাবাদের সময় সার, কীটনাশক বা ধান কাটার শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের জন্য এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে থাকেন। নব্বইয়ের দশক থেকে এ ধরনের ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা গ্রামে খুব জনপ্রিয় হয়। তবে ক্ষুদ্র ঋণ শুধু কৃষিপ্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে প্রসার লাভ করেনি, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নানাবিধ কাজে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করে। ক্ষুদ্র্র ঋণের কার্যালয় ব্যতীত এখন গ্রামীণ জনপদকে চিন্তা করা যায় না। অন্যদিকে কৃষিতে ব্যবহূত রাসায়নিক প্রযুক্তি বিক্রির অ্যাক্টরগুলো যেমন জাতীয় বা বহুজাতিক কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি থেকে শুরু করে দোকান মালিক, বিক্রয়কর্মীর ধারণা বা গ্রামের বাজারে শোরুম স্থাপনের মতো বিষয়াবলি গ্রামীণ কৃষি কাঠামোয় নতুন মাত্রা যোগ করে। অনেক এনজিও কৃষিতে ব্যবহূত রাসায়নিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রসারের সাথে যুক্ত হয়, যা গ্রামে বাজারের ধারণাকেও সম্প্রসারণ করে। রাসায়নিক প্রযুক্তির বিক্রয়কে কেন্দ্র করে শহরের বা গ্রামের বাইরের মানুষজনের গ্রামে অর্থ বিনিয়োগের ব্যাপারটিও লক্ষণীয়।

কৃষিবহির্ভূত খাতেও অর্থ বিনিয়েগের ব্যাপারটি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে নগদ অর্থের সংস্থান করতে পারা অনেক মানুষই গ্রামে ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করেছে। গ্রামের বাজারে টিন বিক্রির দোকান, সারের ডিলারের বা দোকানের মতো প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় টিভি, ফ্রিজ বিক্রির প্রতিষ্ঠান বা শো-রুম প্রতিষ্ঠাও পরবর্তীতে গ্রামের বাজারের চিরায়ত রূপকে পরিবর্তিত করেছে। কোনো কোনো গ্রামের বাজারে পোশাকের দোকানের উপস্থিতি মেলে। দরিদ্র যারা অর্থ বিনিয়েগের সামর্থ্য রাখেন না তাদের অনেকেই এসব প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী হিসেবে চাকরি নিয়েছেন, যা স্থানীয় প্রেক্ষাপটে ‘কর্মচারী’ পেশা হিসেবে পরিচিত। আবার সরকারি-বেসরকারি ভোকেশনাল ট্রেনিংপ্রাপ্ত যুবকরা গ্রামেই প্রযুক্তি মেরামতের জন্য বাজারে দোকান স্থাপন করছেন। এ ধরনের নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন শুধু গ্রামের বাজারকেই সম্প্রসারণ করছে না, পেশার ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য আনছে।

শুধু প্রযুক্তির কারেণই কৃষিক্ষেত্রে শ্রমের গুরুত্ব হাড়ায়নি, গ্রামের নতুন প্রজন্মের অনেকেই কৃষি পেশার প্রতি ‘আগ্রহ’ হাড়িয়ে ফেলছে। তারা কৃষি খাতের চেয়ে অকৃষিকাজের পেশাকেই প্রাধান্য দেয়। টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রেক্ষাপটে অনেক গ্রামবাসীর সাক্ষাত্কার থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতু স্থাপনের পরবর্তী সময়ে ভূমির মূল্য আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। আগে কৃষি পেশায় নিয়োজিত ছিল এমন অনেককেই দেখা গিয়েছে যে তারা জমি বিক্রি করে শহরে গিয়ে দোকান কিনে ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করছে। এসব অঞ্চলে গ্রামে এখন কৃষিকাজের ব্যাপকতা নেই, ইটভাটা বা শিল্পায়নের ফলে কৃষিজমির পরিমাণও কমেছে। জমি বিক্রি করে ব্যবসার কারণে শহরে অভিবাসনের হারও বেড়ে গিয়েছে। ভূমিহীন বা স্বল্পবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ঢাকা বা শহরে অভিবাসিত হয়ে শ্রমিক বা অন্য কোনো পেশায় নিযুক্ত হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা, যাবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামে অবস্থান করেও মোটরযান শ্রমিক, মেকানিক কাজে বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানোর কাজে নিযুক্ত হচ্ছে। স্বল্প শিক্ষিতদের অন্যান্য চাকরি নিয়েও অভিবাসনের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। গ্রামের অনেক নারীও ঢাকা বা সাভার এলাকায় অভিবাসিত হয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করছে। কৃষিকাজে যে পরিমাণ শ্রম দিতে হয়, প্রযুক্তির জন্য নগদ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়, ফসল বিক্রি করে সে পরিমাণ অর্থ আসে না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে আয় ব্যয় সমান। তাই তারা কৃষিকাজে অংশগ্রহণ না করে চাকরিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে, যেখানে মাস শেষে নগদ অর্থের নিশ্চয়তা থাকে। জমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সেখানে কৃষিকাজ না করে জমি ভাড়া দিলেও ক্ষেত্র বিশেষে কৃষিকাজের চেয়ে অধিক উপার্জন সম্ভব হয়।

প্রযুক্তিয়ানের প্রভাবে বাজারের সম্প্রসারণ শুধু কৃষিক্ষেত্রেই নয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষত মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থায় নতুন সংযোজন। ফোন রিচার্জের দোকান, মোবাইল ফোনে গান ডাউনলোড যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে তেমনি নতুন নতুন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেরও সৃষ্টি করেছে। যুবক সম্প্রদায়ের কাছে ফেসবুক, ণড়ঁঃঁনব-এর ব্যবহার খুব জনপ্রিয় হলেও স্বল্প শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে এর প্রাথমিক ব্যবহার দুরূহ কাজ। গবেষণায় দেখা যায়, স্বল্প শিক্ষিতদের মাঝে অর্থের বিনিময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অ্যাপস ডাউনলোড করে দেয়া হয়। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের কাছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ২০১৭ সালে গবেষণাকালে একটি দোকানের সাইনবোর্ডে লিখিত বিজ্ঞাপন চেখে পড়ে, যেখানে লেখা ছিল— 

‘এখানে ফেসবুক, ইউটিউবসহ সকল ধরনের গান ডাউনলোড করা হয়, ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে’। 

আরেকটি বিজ্ঞাপন সাইনবোর্ডের লেখাও উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক—

‘সকল প্রকার ইন্টারনেটের কাজ করা হয়। ফেসবুকে ছবি আপলোড করা হয়; ১০ টাকার বিনিময়ে ফেসবুক ডাউনলোড করা হয়; ১০০ টাকার বিনিময়ে ফেসবুক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়; ফেসবুক প্রশিক্ষণ নিলে ডাউনলোড ফ্রি’। 

আশি ও নব্বইয়ের দশক হতে গ্রাম থেকে চাকরির উদ্দেশ্যে শুধু শহরে অভিবাসনই নয়, বিদেশে অভিবাসিতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিদেশে অভিবাসিতদের রেমিট্যান্সের প্রবাহ গ্রামের বাজার ব্যবস্থার পরিবর্তন এনেছে। গ্রামে বাসস্থানের জন্য যেমন দালানকোঠা তৈরি হচ্ছে ঠিক তেমনি সুপার মার্কেটের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, যেখানে কর্মরত আছেন অভিবাসিতের ভাই বা অন্য কোনো আত্মীয়। এ ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য গ্রামের অর্থনীতি তথা কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পরিবর্তন আনছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগের ব্যাপারটিও লক্ষ করা গিয়েছে। শুধু বিদেশ অভিবাসনকারীরাই নয় অভ্যন্তরীণ অভিবাসনকারীদেরও কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে দেখা যায়। ট্রাক্টর বা পাম্প ক্রয় করে তা ভাড়া খাটানোর ব্যাপারটিও এখানে অনেকটাই প্রচলিত।

বর্তমান সময়ে পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি এবং মাছ চাষ প্রকল্পও লাভজনক ব্যবসা হিসেবে পরিচিত। অভিবাসনকারীদের অনেকেই বেশ কিছুদিন পর জমানো টাকা নিয়ে গ্রামে ফিরে এসে মাছ চাষ বা হাঁস-মুরগির খামার দিচ্ছেন। পুকুর কেটে মাছ চাষ বা হাঁস-মুরগির খামার প্রতিষ্ঠা করা গ্রামে এখন বেশ জনপ্রিয় ব্যবসা। পোলট্রি বা ফিশ ফিডের দোকান কিংবা বিক্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাও গ্রামের বাজারের একটি প্রচলিত ঘটনা। তবে সাপ্তাহিক হাটের গুরুত্ব এখনো শেষ হয়ে যায়নি। মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের গ্রাম গবেষণায় দেখা যায়, কিছু গ্রামে সবজি উৎপাদন আগের চেয়ে বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সবজি উৎপাদন ধানের চেয়ে লাভজনক। সবজির বাণিজ্যিক ভিত্তিক উৎপাদনও বেড়েছে। অনেক গ্রামেই সাপ্তাহিক হাটের গুরুত্ব বাড়ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ার কারণে নিকটস্থ অনেক শহুরে মানুষ স্বল্পমূল্যে সবজি ক্রয়ের জন্য গ্রামের হাটে আসছে। অনেক সময় শহুরে ক্রেতারা সবজি ছাড়াও গ্রামের হাট থেকে ‘স্বল্প মূল্যে পাওয়া যায়’ এ বিচেনায় গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে। শহুরে বাজারের পাইকাররা গ্রামে এসে সবজি ক্রয় করে পিক-আপ ভ্যানে নিয়ে যাচ্ছে। এগুলো ঢাকার বাজারেও বিক্রি হচ্ছে। এ ধরনের পাইকার শ্রেণীর আবির্ভাব গ্রামের সাপ্তাহিক হাটের অবকাঠামোগত পরিবর্তনে প্রভাব না ফেললেও বাজার ব্যবস্থাপনাকে পরিবর্তন করছে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকেও নতুন বাজার ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত করছে।

আবার গ্রাম্য বাজারের আয়তনগত পরিধিও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারের আশপাশে যেসব খালি যায়গা ছিল, সেই জমির মালিক ইটের তৈরি বা টিনের তৈরি ঘর নির্মাণ করে তা দোকান হিসেবে ভাড়া দিচ্ছেন। এ ধরনের নির্মাণকাজের সাথেও রেমিট্যান্সের যোগসূত্র রয়েছে। গ্রামীণ মানুষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে জানা যায় বিদেশ থেকে অভিবাসিতদের প্রেরিত অর্থ বাজারে বিনিয়োগের বড় উৎস হিসেবে কাজ করে। এ রেমিট্যান্সের অর্থ বিনিয়েগের মাধ্যমে বাড়ি বা দোকান তৈরি করে তা ভাড়া দেয়া হচ্ছে। বাজারের আশপাশে যাদের যায়গা আছে বিনিয়েগের মাধ্যমটি তাদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আগে যেখানে গ্রামের অর্থনীতি, রাজনীতি ও মর্যাদার সাথে ভূমির মালিকানা প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে ভূমিহীন পরিবারের সন্তানও অভিবাসনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে গ্রামে বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন ধরনের সামাজিক শ্রেণীর সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। বিদেশফেরত অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি গ্রামে নিজেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করছে। এ ধরনের প্রভাব-প্রতিপত্তিও গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। বিত্তশালীদের আত্মীয়স্বজন গ্রামের বাজারে ব্যবসা স্থাপন করে নতুন ধরনের সামাজিক শ্রেণীর উত্থান ঘটাচ্ছে, যা চিরায়ত কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে ছিল অনেকটাই অনুপস্থিত।

কৃষিজমিতে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও ইটভাটার মতো স্থাপনার কারেণ শিক্ষিত বা পেশাজীবী জনগোষ্ঠী চাকরির উদ্দেশ্যে গ্রামে আসছে। ফলে গ্রামের কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হচ্ছে। গ্রামে এনজিওর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেও শহর থেকে শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষকে গ্রামে এসে চাকরি করতে হচ্ছে, যার প্রভাবে গ্রামে ক্লিনিক, ব্যাংক, সন্তানদের পড়াশোনার জন্য কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টারসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। বিশ বছর আগেও যেখানে কাঁচাবাজার, মুদি দোকান, হাট এবং দু-একটি চায়ের দোকান ছাড়া কোনো বাজার ছিল না, বর্তমানে সেখানে বেকারি শপ, বৃহৎ মুদি দোকানসহ নানা ধরনের বাজার গড়ে উঠেছে, পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যাংক-বীমার মতো প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক, বীমা, এনজিও ও কিন্ডারগার্টেনের মতো প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মেটানোর জন্য কম্পিউটার কম্পোজ ও প্রিন্টার, ফটোকপির দোকান গ্রামের বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শহর ও গ্রামের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যোগাযোগের এ উভয়মুখী কারণকে কেন্দ্র করে গ্রামেও নাগরিক জীবনের ভোগবাদী আচরণের সম্প্রসারণ ঘটছে। কোনো কোনো গ্রামে চিরায়ত বাজার ব্যবস্থার পাশাপাশি কফি শপ, বিউটি পার্লার, ফাস্ট ফুড শপ, ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী যাদের পূর্বপুরুষ কৃষির সাথে যুক্ত ছিল তারা অনেকেই নতুন ধরনের বাজার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হচ্ছে। গ্রামকে যেভাবে কৃষিভিত্তিক সমাজ আর শহরকে শিল্পভিত্তিক সমাজ হিসেবে সংজ্ঞায়ন করা হতো তার চিরায়ত রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে। অভিবাসন ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ একদিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তৃতি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নতুন নতুন পণ্যের সাথে যোগাযোগ ঘটাচ্ছে। এর প্রভাবে গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থার শুধু কাঠামোগত পরিবর্তনই হচ্ছে না, বাজারে নতুন নতুন পণ্য ও বিক্রয় ব্যবস্থাপনা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নতুন অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করছে। 


ড. রঞ্জন সাহা পার্থ: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন