যুক্তরাষ্ট্রের উত্তোলনে ধস অব্যাহত

আরো বেশি মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর হয়ে উঠবে জ্বালানি তেলের বাজার?

বণিক বার্তা ডেস্ক

কয়েক বছর ধরে জ্বালানি তেলের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য রীতিমতো হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে অন্যান্য উত্তোলন রফতানিকারক দেশগুলোর জন্য। আর জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম সহায়ক হলো শেল অয়েল (পাথরের ভাঁজে থাকা জ্বালানি তেল) কয়েক বছর ধরে দেশটিতে শেল অয়েল উত্তোলন উত্তরোত্তর বাড়ছে। তবে তথ্য বলছে, চলতি আগামী বছর দেশটির শেল অয়েল উত্তোলন বড় পরিমাণে কমে যেতে পারে। সেটি হলে জ্বালানি তেলের বাজারে মধ্যপ্রাচ্যের যে নির্ভরতা ছিল সেটি আরো বেশি ঘনীভূত হওয়ার সম্ভাবানা দেখা হবে। খবর সিনহুয়া এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটস।

জ্বালানি তেলের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত হিস্যা বাড়ানোর পেছনে অন্যতম আশীর্বাদ হিসেবে ধরা হয় শেল অয়েলকে। কারণ দেশটিই পৃথিবীর অন্যতম শেল অয়েল উত্তোলন সরবরাহকারী দেশ। ফলে শেল অয়েলের ওপর ভর করে দ্রুত বাজার দখল করা যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি তেলের রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ঠেকাতে রাশিয়ার নেতৃত্বে অন্যান্য উত্তোলনকারী দেশ নিয়ে গঠিত হয় ওপেক প্লাস জোট, যার একদিকে রয়েছে সৌদি আরব অন্যদিকে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসীভাবে বাজার দখল থামাতে এবং জ্বালানি পণ্যটির দাম নিয়ন্ত্রণ করতে দীর্ঘদিন ধরে জোটটি উত্তোলন কমিয়ে আসছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম একক দেশ হিসেবে বাজারে সবসময় সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে। সেটি সম্ভব হয়েছে শেল অয়েলের কারণে। এতে ওপেক প্লাস জোটের উত্তোলন হ্রাস আদতে কোনো ফল বয়ে আনেনি। ফলে প্রথাগতভাবে জ্বালানি তেলের বাজার যে মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর ছিল সেটিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চলতি আগামী বছর মোটেই ভালো যাবে না বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টর বিশেজ্ঞরা। কারণ তারা বলছেন, চলতি আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রের শেল অয়েল উত্তোলন কমবে। সেটি হলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে অন্যতম উৎস হিসেবে আরো বেশি মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর হয়ে উঠবে জ্বালানি তেলের বাজার।

জ্বালানি অন্যান্য পণ্যবিষয়ক তথ্য প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটসের তথ্য বলছে, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের শেল অয়েল দৈনিক উত্তোলন নয় লাখ ব্যারেল কমে যাবে। পরের বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালে উত্তোলন আরো কমে আসবে ১১ লাখ ব্যারেলে।

এসঅ্যান্ডপির গ্লোবাল হেড অব অ্যানালিটিকস ক্রিস মিডগিলি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তোলন কমতে থাকাটা ওপেকের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। এটি কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে সরবরাহ ঘাটতি থাকবে সেসব বাজার ধরতে পারে জোটের সদস্য দেশগুলো। তবে এটিও ঠিক, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তোলন কমে এলেও ওপেকের বাইরের দেশগুলো, যেমনকানাডা, ব্রাজিল ইউরোপের উত্তর সাগরের তীরবর্তী দেশগুলোও কিন্তু সরবরাহশূন্যতা পূরণের চেষ্টা করবে। এর পরও এটি ওপেকের জন্য বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি বড় সুযোগ হয়ে থাকবে। কারণ জ্বালানি তেলের বাজারে কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র পরই উৎস দেশ হিসেবে পছন্দের শীর্ষ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। এক সংবাদ বিফ্রিংয়ে বাজারবিষয়ক বিশ্লেষক ক্রিস মিডগিলিও সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ ঘাটতির ফলে যে বাজার তৈরি হবে সেটি আসলে ওপেকের দেশগুলোকেই পূরণ করতে হবে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তেলের উত্তোলন যে অব্যাহতভাবে কমে আসছে সেটি উঠে এসেছে দেশটির এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) প্রতিবেদনেও। ইআইএর তথ্য বলছে, অক্টোবর শেষ হওয়া সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় উত্তোলন ছিল কোটি লাখ ব্যারেলে, যেখানে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মার্চের সময়ও উত্তোলন ছিল কোটি ৩০ লাখ ব্যারেল বা তার চেয়ে বেশি।

আইইএর প্রাক্কলন বলছে, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দৈনিক গড় উত্তোলন ছিল কোটি ২২ লাখ ব্যারেল। যেটি চলতি বছর নেমে আসতে কোটি ১৫ লাখ ব্যারেল। আর আগামী বছর দৈনিক গড় উত্তোলন দাঁড়াতে পারে কোটি ১১ লাখ ব্যারেলে।

এখানেই শেষ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তোলন আরো বেশি কমে আসবে যদি আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় আসতে পারে। কারণ তারা ক্ষমতায় এলে শেল অয়েল গ্যাস উত্তোলনের ওপর বাধানিষেধ আরোপ করতে পারে। এজন্য ২০২৪ সালের মধ্যে দেশটির অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দৈনিক উত্তোলন ২০ লাখ ব্যারেল কমে আসতে পারে বলে মনে করছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাজারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। এটি হলে বিগত বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র বাজারে হিস্যা সরবরাহ বাড়ানোর যে পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল সেটি ২০৩০ সাল নাগাদ গিয়ে লক্ষ্যে থেকে আরো বেশি পিছিয়ে থাকবে। আর সরবরাহের শূন্যতা পূরণে সর্বশেষ এগিয়ে আসবে ওপেক জোটের সদস্যরা।

তবে জ্বালানি তেলের সরবরাহের ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রায় মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর হওয়ার ফলে তখন বাজার আরো বেশি নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে প্রবল। এসঅ্যান্ডপির সাপ্লাই অ্যান্ড প্রডাকশন অ্যানালিটিকসের প্রধান শিন কিম মনে করেন, এমনিতেই বাজার চাঙ্গা করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সরবরাহ কমিয়ে আসছে ওপেক প্লাস জোটের সদস্যরা। তবে এখন লিবিয়া অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন ব্যাপক মাত্রায় বাড়িয়েছে। তাছাড়া দেশটির বাজারে সরবরাহ ভারসাম্য আনার মতো যথেষ্ট সক্ষমতাও রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে পারলে ইরানের জ্বালানি তেলও বাজারে প্রবেশ করবে। ফলে তখন জ্বালানি পণ্যটির বাজার নিম্নমুখী প্রবণতায় চলে আসতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার রোধ এবং বাজার চাঙ্গা করার যে দীর্ঘ চেষ্টা ওপেকের, সেটির অন্তত একটি পূরণ হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেটিও ওপেকের জন্য কম কী?

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন