সাম্প্রতিক ঘোষিত চীন-ইরান চুক্তি

উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির ভবিষ্যৎ

সালমান রাফি শেখ

সম্প্রতি ঘোষিত চীন-ইরান চুক্তি উভয় দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে পরিবর্তন আনবে। ইরানের সঙ্গে চীনের এই বহু বিলিয়ন ডলারের চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্য বোধহয় নাটকীয়ভাবে বদলে দেবে। ওই অঞ্চলে শক্তির নতুন কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে ইরান। পারস্য উপসাগর বা হরমুজ প্রণালীজুড়ে চীনের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ইরানের সামরিক অবস্থান সুদৃঢ় করবে, হার্ড পাওয়ার প্রদর্শনে এর সক্ষমতা বাড়াবে, কয়েক শ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ দেশটির অর্থনৈতিক দৃশ্যপটও আমূল পরির্বতন ঘটাবে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে সৌদি আরবসহ প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রগুলোর বিপরীতে দেশটির অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেকখানি বাড়িয়ে দেবে। একইসঙ্গে ওই অঞ্চলে চীনের স্থায়ী পদচারণ বেইজিংয়ের বৈশ্বিক শক্তি চাঙা করবে, আঞ্চলিক উন্নয়নে বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়ায় প্রভাব জাহিরে এর সামর্থ্য বাড়াবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যিক শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জে ফেলবে।

ইরান বেশ সচেতন যে দেশটিতে চীনের উপস্থিতি-বিনিয়োগ এবং তদপরবর্তী অধিকতর ভালো অর্থনৈতিক অবস্থা আবশ্যিকভাবে কেবল প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রগুলোকে মোকাবেলায় সামরিক খাতে আরো বেশি অর্থ লগ্নির ক্ষেত্রে দেশটিকে সমর্থ করে তুলবে না, উপরন্তু অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ইরান ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি স্বার্থও হুমকিতে ফেলবে। এও সত্য যে, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ইরান শক্তি চর্চায় একটা পরিমিতি আনতে পারে এবং উপসাগরীয় ও অন্য আরব দেশগুলোর সঙ্গে দেশটির উদারচিত্তে অধিকতর ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার সমূহ সম্ভাবনাও আছে। এটিও উল্লেখ করা দরকার যে কিছু আঞ্চলিক শক্তি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ইরানের আগের প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রগুলো দেশটির সঙ্গে এরই মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি নতুন পর্বের দিকে এগোচ্ছে। অতএব, অর্থনৈতিকভাবে (এবং সামরিকভাবে) শক্তিশালী ইরান অত্যাবশ্যকীয়ভাবে ওই অঞ্চলে নেতিবাচক প্রতিদ্বন্দ্বিতা-প্রতিযোগিতায় লিপ্ত নাও হতে পারে।

ইরানের ক্ষেত্রে ক্ষমতা চর্চায় একটি মাত্রাজ্ঞান আশা করার আরেকটি বাড়তি কারণ হতে পারে ‘চীন ফ্যাক্টর’। ইরানে চীনের বিনিয়োগগুলো দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে বেশ সঙ্গতিপূর্ণভাবে হচ্ছে। তার মানে চীন নিশ্চিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আরো গভীরতর সম্প্রসারণে দৃষ্টি দেবে এবং চূড়ান্তভাবে ইউরোপের সঙ্গে একটি প্রত্যক্ষ ভূখাণ্ডিক সংযোগের উন্নয়ন ঘটাবে। কাজেই ওই অঞ্চলে চীনের ব্যাপকতর অর্থনৈতিক উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করে দেশটিকে প্রতিযোগী আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটি নতুন ভারসাম্যকারী (নিউ ব্যালান্সার) হিসেবে আবির্ভূত করবে। যেহেতু চীনা স্বার্থ ও উপস্থিতির প্রাথমিক প্রকৃতি অর্থনৈতিক, সেহেতু এটি ওই অঞ্চলে সামরিক সংঘাত উসকে দেবে বলে মনে হয় না। নতুন ভারাসাম্যকারী চীনের আবির্ভাব, বাণিজ্যের নতুন ভূগোল বিন্যাস এবং প্রাচীন সিল্ক রোডগুলোর পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টার একটি যৌক্তিক আউটকাম হলো যে ধারাবাহিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ও মাখামাখি কমিয়ে ওই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কগুলো নতুন করে পুনর্বিন্যাস করতে পারে।

খসড়া চুক্তির সবিস্তারে যেমনটা দেখা যায়, চীন জাস্কে একটি বন্দর উন্নয়ন করতে যাচ্ছে। জাস্ক হরমুজ প্রণালীর ঠিক বাইরে অবিস্থত, যেটি পারস্য উপসাগরে প্রবেশের দ্বার। একটি কৌশলগত অবস্থানে চীন একটি বন্দর উন্নয়ন ও ব্যবস্থপনায় সমর্থ হলে এটি ইরানকে নৌশক্তিতে একটি অভাবিত সুবিধা দেবে এবং চীনকে ওই অঞ্চলে আগের অনুকূল অবস্থান ফিরিয়ে দেবে, যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে সাম্প্রতিক ইতিহাসে যা খর্ব হয়েছিল। যদিও আজো বাহরাইনে অবস্থিত মার্কিন পঞ্চম নৌবহর একই পথ ব্যবহার করে। 

ইরান তার তাৎক্ষণিক স্বার্থ সম্পর্কে কতটা সচেতন তা তেল সরবরাহের বিকল্প পথ হিসেবে দেশটির জাস্ক বন্দর ব্যবহারের আগ্রহ থেকে বোঝা যায়। বলা যায়, আলোচ্য বন্দরটির জন্য দেশটি মুখিয়ে আছে। ইরানের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাম্প্রতিক ঘোষিত বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে একটি বড় ধরনের পাইপলাইন স্থাপন পারস্য উপসাগরের পশ্চিমে গোরেহর সঙ্গে পূর্বে জাস্ক বন্দরের সংযোগ ঘটাবে। এটি তেল রফতানির ক্ষেত্রে হরমুজ প্রণালীতে দেশটিকে স্বনির্ভর ও স্বাধীন করে তুলবে। ইরানের রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, ‘কেবল অর্থনৈতিক নয়, জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকেও এটি (পাইপলাইন স্থাপন) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।’

ব্যবহারিকভাবে যার অর্থ হলো যে ইরান ও তার আঞ্চলিক প্রতিপক্ষগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত বিবদমানতার বাস্তবতায় নিজের তেল রফতানি কোনোভাবে ব্যাহত না করেই দেশটি প্রণালীটি নিরাপদে বন্ধ করে দিতে পারবে। 

এদিকে পাকিস্থানে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত বারবারই পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের সঙ্গে শাবাহার বন্দরের সংযোগের মাধ্যমে একটি ‘গোল্ডেন রিং’ সৃষ্টির কথা বলে আসছে। রাশিয়ারও একটি ‘গোল্ডেন রিংয়ের’ ধারণা রয়েছে (অন্যতম সদস্য হওয়ায় যা এরই মধ্যে সিরিয়ায় শক্তিশালীভাবে বিরাজমান)। এটি (ওই গোল্ডেন রিং) দেখায় যে দুটি পরাশক্তির সমন্বয়ে ঘটে চলা একটি নতুন আঞ্চলিক কনফিগারেশন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর প্রায়ই অপরিপরিবর্তনীয় ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন করে খুব তাৎপর্যপূর্ণ উপায়ে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য বদলে দেবে। 

ইরানের সঙ্গে রাশিয়া ও চীন যে উপায়ে তাদের সম্পর্ক শক্তিশালী করছে তা থেকে স্পষ্ট যে আগামী অক্টোবরে দেশটির ওপর অস্ত্র অবরোধ পুনঃ আরোপ ব্যাহত করার লক্ষ্যে কীভাবে একটি গোল্ডেন রিংয়ের উন্নয়ন ঘটছে। দ্বিতীয়ত, চীন-ইরান চুক্তি এমন এক সময়ে ঘোষিত হয়েছে, যখন প্রায় দুই বছরের নিষ্ক্রিয়তার পর পাকিস্তানে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) আবার নতুন করে গতি পেয়েছে। মৌলিকভাবে পরিবর্তিত আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটের দিকে চোখ রেখে একটি ‘গোল্ডেন রিংয়ের’ কেন্দ্রে কীভাবে বাণিজ্য ও সংযোগের একটি নতুন ভূগোল তৈরি হচ্ছে, এটি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

যেমনটা মনে হচ্ছে ইরান এটা থেকে নিজস্ব সুফল অর্জনে বদ্ধপরিকর। দেশটি বারবারই ‘পশ্চিম’ দ্বারা নিঃস্ব হয়েছে। এ অবস্থায় ‘পূর্বের’ সঙ্গে সম্পর্ক সংহতকরণ-উন্নয়ন বৈশ্বিক ক্ষমতা সম্পর্কে ইরানকে তার অবস্থা পুনর্নিধারণে সাহায্য করবে বৈকি। 

সালমান রাফি শেখ: ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন অ্যান্ড পাকিস্তান’স ফরেন অ্যান্ড ডোমেস্টিক অ্যাফেয়ার্সের রিসার্চ-অ্যানালিস্ট

নিউ ইস্টার্ন আউটলুক থেকে ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন