চীনে প্রথম দেখা দিলেও এরই মধ্যে বিশ্বের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ট্রেলিয়া, হংকং থেকে নেপাল, সৌদি আরব থেকে যুক্তরাজ্য—প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত চীনেই আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ৮ শতাধিক মানুষ। মারা গেছে ৪১ জন। সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রে করোনাভাইরাস। ভাইরাসটি যত দ্রুত ছড়াচ্ছে, আতঙ্কও বাড়ছে তত দ্রুত। কারণ প্রাণঘাতী এ ভাইরাস এখন আক্রান্ত মানুষের কাছ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখনই স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করতে নারাজ। তবে ডব্লিউএইচও ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া রোধে সতর্ক থাকতে বলেছে।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কের কারণে এরই মধ্যে এশিয়ার শেয়ারবাজারে পতন দেখা দিয়েছে। বাদ যায়নি পণ্যবাজারও। ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের জের ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, স্বর্ণ, তুলাসহ কয়েকটি পণ্যের দাম কমে গেছে। বৈশ্বিক পণ্যবাজারে করোনাভাইরাস ও এটি নিয়ে আতঙ্কের প্রভাব নিয়ে এ আয়োজন—
মূল্যবান ধাতু
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে ডব্লিউএইচওর সতর্কতা জারির পর ধাক্কা লেগেছে মূল্যবান ধাতুর বাজারে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সর্বশেষ কার্যদিবসে স্বর্ণের স্পটমূল্য আগের দিনের তুলনায় দশমিক ৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে আউন্সপ্রতি ১ হাজার ৫৫৭ ডলার ৯৩ সেন্টে। এ সময় দেশটির বাজারে ভবিষ্যতে সরবরাহ চুক্তিতে প্রতি আউন্স স্বর্ণ বেচাকেনা হয়েছে ১ হাজার ৫৫৭ ডলার ৫০ সেন্টে, যা আগের দিনের তুলনায় দশমিক ৫ শতাংশ কম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন একসময় চীনজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে, যখন দেশটিতে নতুন চান্দ্রবর্ষ উদযাপনের ছুটি চলছে। এটা চীনের পর্যটন ও উৎসবের মৌসুম। এ সময়ে দেশটিতে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে যায়। মানুষ উপহার হিসেবে স্বর্ণ কেনে। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এরই মধ্যে চীনের একাধিক শহরে পর্যটক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নেই উৎসবের আমেজ। ফলে স্বর্ণের চাহিদাও অন্যান্যবারের মতো বাড়েনি। এ পরিস্থিতি মূল্যবান ধাতুটির বাজারে প্রভাব ফেলেছে।
এদিকে সর্বশেষ কার্যদিবসে প্যালাডিয়ামের দাম দাঁড়িয়েছে আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৪৪৭ ডলার ১১ সেন্টে, যা আগের কার্যদিবসের তুলনায় দশমিক ৬ শতাংশ কম। রুপার দাম আগের দিনের তুলনায় দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে আউন্সপ্রতি ১৭ ডলার ৮২ সেন্টে দাঁড়িয়েছে। তবে সর্বশেষ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পর রুপার সাপ্তাহিক গড় দামে ১ শতাংশ পতন দেখা গেছে। একইভাবে প্রতি আউন্স প্লাটিনাম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪ ডলার ৪৪ সেন্টে, যা ২০ ডিসেম্বরের পর সর্বনিম্ন।
তুলা
ভারতের বাজারে গত দুই সপ্তাহে তুলার দাম ৩ শতাংশ কমে গেছে। আগামী দেড়-দুই মাসে পণ্যটির দাম আরো কমতে পারে। এর পেছনে বাড়তি মজুদ ও করোনাভাইরাসের কারণে চীনের বাজারে চাহিদা কমে যাওয়াকে চিহ্নিত করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
ইন্ডিয়ান কটন অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মহেশ সারদা বলেন, করোনাভাইরাস চীনে তুলার চাহিদা কমিয়ে দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দামে প্রভাব ফেলতে পারে। এর প্রভাব পড়বে ভারতের বাজারেও।
পাম অয়েল
একদিকে ভারত আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে, অন্যদিকে করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কারণে চীনে চাহিদা কমতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে বছরের শুরু থেকে মালয়েশিয়ান পাম অয়েল খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এর জের ধরে সর্বশেষ কার্যদিবসে বুরসা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভস এক্সচেঞ্জে ভবিষ্যতে সরবরাহ চুক্তিতে প্রতি টন পাম অয়েলের দাম দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৬২ রিঙ্গিতে (মালয়েশিয়ান মুদ্রা), যা
আগের দিনের তুলনায় ২ দশমিক ২ শতাংশ কম। ভাইরাস আতঙ্ক দূর হয়ে রফতানি না বাড়লে মালয়েশিয়ার বাজারে পাম অয়েলের দাম আরো কমতে পারে বলে জানান মুম্বাইভিত্তিক সানভিন গ্রুপের পণ্যবাজার গবেষক অনিলকুমার বাগানি।
সয়াবিন
সর্বশেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) সয়াবিনের গড় দাম আগের সপ্তাহের তুলনায় ২ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। চীন বিশ্বের বৃহত্তম সয়াবিন আমদানিকারক দেশ। দেশটিতে ভাইরাস আতঙ্ক পণ্যটির চাহিদা ও আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মূলত এ কারণেই কৃষিপণ্যটির দাম কমতে শুরু করেছে।
প্রাকৃতিক রাবার
টোকিও কমোডিটি এক্সচেঞ্জে সর্বশেষ কার্যদিবসে ভবিষ্যতে সরবরাহের চুক্তিতে প্রতি কেজি প্রাকৃতিক রাবারের দাম দাঁড়িয়েছে ১৮২ দশমিক ২ ইয়েনে (জাপানি মুদ্রা) বা ১ ডলার ৬৬ সেন্টে, যা আগের দিনের তুলনায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কম। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চীনসহ এশিয়ার দেশগুলোয় চাহিদা কমে যাওয়া এবং সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে পণ্যটির সাপ্তাহিক গড় দাম ২০১১ সালের পর সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে।
ব্যবহারিক ধাতু
করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ব্যবহারিক ধাতুর বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সর্বশেষ কার্যদিবসে লন্ডন মেটাল এক্সচেঞ্জে (এলএমই) ভবিষ্যতে সরবরাহের চুক্তিতে প্রতি টন তামার দাম দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯২৫ ডলারে, যা আগের দিনের তুলনায় ১ শতাংশ কম। ২০১৫ সালের জানুয়ারির পর তামার সাপ্তাহিক গড় দামে সবচেয়ে বড় (৫ শতাংশ) পতন দেখা গেছে।
এদিন এলএমইতে ভবিষ্যতে সরবরাহের চুক্তিতে প্রতি টন অ্যালুমিনিয়াম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৭৮১ ডলারে, যা আগের দিনের তুলনায় দশমিক ৮ শতাংশ কম। দিন শেষে ভবিষ্যতে সরবরাহের চুক্তিতে প্রতি টন দস্তা বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৩৪১ ডলারে, যা তিন সপ্তাহের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের দিনের তুলনায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ কমে ভবিষ্যতে সরবরাহের চুক্তিতে প্রতি টন সিসা বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৯৪০ ডলারে। নিকেলের দাম ২ দশমিক ৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে টনপ্রতি ১২ হাজার ৯৭৫ ডলারে।
রয়টার্স, ব্লুমবার্গ ও বিজনেস রেকর্ডার অবলম্বনে