ইরান-যুক্তরাষ্ট্র তিক্ত-মধুর সম্পর্কের ইতিহাস

বণিক বার্তা অনলাইন

১৯৮০ সাল থেকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। ওই সময় থেকে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রে ইরানের নিরাপত্তা রক্ষক আর ইরানে সুইজারল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে একই ভূমিকা পালন করছে। ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে ইরানিয়ান ইন্টারেস্টস সেকশন হয়ে এবং তেহরানে সুইস দূতাবাসে ইউএস ইন্টারেস্টস সেকশন হয়ে উভয় দেশের যোগাযোগ হতো। ২০১৮ সালে এসে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খোমেইনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নিষিদ্ধ করে দেন।

এ দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয় মূলত ঊনিশ শতকের মধ্য থেকে শেষ নাগাদ। ওই সময় পশ্চিমাদের কাছে ইরানের পরিচয় ছিল পারস্য। ঊনিশ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্য যখন আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে এর পার্শ্ববর্তী মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে তখন ইরান নিজের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রকেই তখন সবচেয়ে বিশ্বাস্যযোগ্য মিত্রশক্তি বলে বিবেচনা করেছিল ইরান। এমনকি ওই সময় শাহ (রেজা শাহ পাহলভী প্রমুখ) সরকারের ট্রেজারার জেনারেল হিসেবে দুই মার্কিনকে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ব্রিটিশ রাজ ও রাশিয়া ইরান আক্রমণ করে। উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হলেও যুদ্ধ শেষে ইরান-মার্কিন সম্পর্ক ভালোই যাচ্ছিল। 

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরানের বিশাল তেলসম্পদের ওপর নজর পড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ তৎকালীন পরাশক্তিগুলোর। ইরানের তেল সম্পদের দখল নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্বাধীন ব্লক ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ব্লক। শুরু হয় উভয় ব্লকের গোপন গোয়েন্দা তৎপরতা। কিন্তু এতে বাধ সাধেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইরানের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। তার তেলশিল্পকে জাতীয়করণের নীতি মার্কিন ব্লকের পছন্দ হয়নি। শেষ পর্যন্ত মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এর যৌথ তৎপরতায় ১৯৫৩ সালে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ক্ষমতায় বসানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকার। মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলো ইরানের তেলশিল্পে প্রবেশের অবাধ সুযোগ পায়। ষড়যন্ত্র করে প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার কথা অবশ্য ২০০০ সালে স্বীকার করেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইট।

পাহলভির সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক ক্রমেই অসম হয়ে ওঠে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে রেজা শাহ পাহলভী অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি সই করে। ১৯৬৮ সালে ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতেও (এনপিটি) স্বাক্ষর করে। এর দুই বছর পর থেকে দেশটি বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য পারমাণবিক কর্মসূচি চালানোর অনুমতি পায়। পাহলভী পাশ্চাত্য ধাঁচে আধুনিক ইরান গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, যা দেশের প্রভাবশালী শিয়া নেতাদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পাহলভীর নীতিতে শহুরে উচ্চবিত্তরা খুশি হলেও ক্রমেই অসন্তোষ বাড়ে কর্মজীবীদের মধ্যে। ভিন্নমত দমনে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন পাহলভী। ইসলামপন্থী ও সেক্যুলার— দুই পক্ষই সমানভাবে জুলুমের শিকার হয়। আর এতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মদদ ছিল বলে মনে করা হয়। ক্ষোভ অসন্তোষের এক সময় বিস্ফোরণ ঘটে। ইসলামপন্থী ও সেক্যুলাররা জোটবদ্ধ হয়ে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। টানা কয়েক মাসের আন্দোলনের মুখে ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ইরান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন রেজা শাহ পাহলভী।

এর দুই সপ্তাহ পর নির্বাসন থেকে দেশে ফেরেন আন্দোলনের অন্যতম নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। মূলত তার নেতৃত্বেই ইরানের ইসলামি বিপ্লব ঘটে। গণভোটের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইরান। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতা হন আয়াতুল্লাহ খোমেনি। ওই বছরের ৪ নভেম্বর ঘটে বিখ্যাত জিম্মি নাটক। তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে কর্মীদের জিম্মি করে এক দল তরুণ। পাহলভীকে ইরানের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানানো হয়। 

৪৪৪ দিনের এ জিম্মি নাটকই ইরান-মার্কিন সম্পর্ককে তিক্ততার চূড়ান্তে নিয়ে যায়। ১৯৮০ সালে ইরানের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ইরানের সব সম্পদ জব্দ করা হয়, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়। জিম্মি উদ্ধার অভিযান এতোটাই নাটকীয় ছিল যে পরবর্তীতে এ নিয়ে হলিউডে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জিম্মি উদ্ধার অভিযান ব্যর্থ হয়। ধূলিঝড়ে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে আটজন মার্কিন নিহত হয়। তবে ১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি জিমি কার্টার পদত্যাগ করলে তাৎক্ষণিকভাবে ৫২ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয় ইরান।

এরপর আর কখনোই দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি। বরং মাঝে মধ্যেই উত্তেজনার পারদ চড়েছে। চলেছে বাগযুদ্ধ। তবে কমবেশি বাণিজ্য চলেছে। যদিও ১৯৮৪ সালেই ইরানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এর মধ্যেই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান  প্রশাসন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গোপনে ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে। অস্ত্র বিক্রির অর্থ নিকারাগুয়ায় কমিউনিস্টদের ঠেকাতে বিদ্রোহীদের সহায়তায় খরচ করা হয়। অবশ্য রিগ্যান প্রশাসন তখন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছিল, লেবাননে হিজবুল্লাহর হাতে জিম্মি সাত আমেরিকানকে মুক্ত করতে তেহরান সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল বলেই তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা হয়। 

১৯৮৮ সালে একটি নৃশংস ঘটনা ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে ২৯০ জন আরোহীর সবাই নিহত হন। পরে ওয়াশিংটন বলে, এয়ারবাস এ-৩০০ মডেলের উড়োজাহাজটিকে যুদ্ধবিমান ভেবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল মার্কিনবাহিনী। উড়োজাহাজটি ইরান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাচ্ছিল।

এরপর ইরানকে চাপে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায় দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি। যদিও এ কর্মসূচি শুরু হয়েছিল মার্কিন মদদপুষ্ট পাহলভী সরকারের আমলেই। অবশ্য ইরানও পারমাণবিক ইস্যুটিকে বিভিন্ন সময় পশ্চিমে দর কষাকষির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ তোলে ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০০২ সালে বুশ প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ তোলে এবং দেশটির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে।

২০০৬ সালে ওয়াশিংটন সম্পর্কের বরফ গলার ইঙ্গিত দেয়। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বন্ধ করলে আলোচনায় বসতে আপত্তি নেই বলে জানানো হয়। ২০০৭ সালে মে মাসে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানুচের মোত্তাকি মিসরে এক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি পরস্পরের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সরাসরি আলোচনায় বসতে ইরানের প্রতি আনুষ্ঠানিক বার্তা পাঠান। এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ২০১২ সালে ইরানের সঙ্গে গোপনে আলোচনা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন বারাক ওবামা। তিন দশকের মধ্যে শীর্ষ নেতাদের সরাসরি কথা বলার ঘটনা এটিই প্রথম। ২৩ নভেম্বর পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরে আসার বিষয়ে চুক্তিতে সই করে ইরান। ২০১৬ সালে তেহরানের ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে ওয়াশিংটন।

তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই এ চুক্তিকে অসম বলে আখ্যা দিলেন। চুক্তি বাতিলকেই তিনি প্রশাসের অগ্রাধিকার বিবেচেনায় নিলেন। অবশ্য নির্বাচনী প্রচরণাতেও বারবার তিনি এ কথা বলেছিলেন। গত বছরের মে মাসে ট্রাম্প চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এমনকি ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানিকারক দেশগুলোরও ওপরও চাপ সৃষ্টি করেন তিনি। ফলে ইরানও পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করার ঘোষণা দেয়। যদিও ইউরোপের দেশগুলো ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছে। 

চুক্তি বাতিলের পর উপসাগরীয় অঞ্চলে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। বিশেষ করে তেল আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পথ হরমুজ প্রণালীতে ইরানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও অস্থিরতা তৈরি করে। গত বছরের মে ও জুন মাসে উপসাগরীয় অঞ্চলে ছয়টি তেলবাহী ট্যাংকারে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায়  ইরানকে দায়ী করে ট্রাম্প প্রশাসন। এ নিয়ে উভয়পক্ষে শুধু কথার লড়াই চলছে। এর মধ্যে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনার জেরে ইরানে হামলার অনুমোদন দেন ক্ষুব্ধ ট্রাম্প। অবশ্য শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন তিনি।

এর মধ্যে গত ৩১ ডিসেম্বর ইরাকে মার্কিন দূতাবাসে হামলা, ভাঙচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা। ইরান-সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়া বাহিনীর ওপর মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলায় বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা বাগদাদের সবচেয়ে নিরাপত্তাবেষ্টিত গ্রিন জোন এলাকায় ঢুকে পড়ে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়। দূতাবাসের দরজা ভেঙে তারা ভেতরে ঢোকে, বাইরের দেয়াল ভাঙচুর করে। যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পদদলিত করাসহ ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিপাত যাক’ স্লোগান দেয় তারা। নিরাপত্তারক্ষীদের একটি টাওয়ারেও বিক্ষোভকারীরা আগুন দিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে মার্কিন সেনারা কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলায় ইরান উস্কানি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এক টুইটবার্তায় ট্রাম্প বলেন, কোনো প্রাণহানি বা আমাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে তার জন্য ইরানই দায়ী থাকবে৷ সেজন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে৷ এটা কোনো সতর্কবার্তা নয়, এটা হুমকি৷ শুভ নববর্ষ!

উইকিপিডিয়া, রয়টার্স ও নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে

ট্রাম্পের নির্দেশে ইরাকে ইরানি জেনারেলকে হত্যা

ইরানি জেনারেল হত্যাকাণ্ডে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম, অস্থিরতার শঙ্কা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন