বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তায় বড় হুমকি পশ্চিমা রসনা রুচি

জাতিসংঘের হিসাবে, ২০০৫-১৫ সালের মধ্যে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমলেও এখন সেটি ধীরগতিতে হলেও অব্যাহতভাবে বাড়তে শুরু করেছে। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৮২ কোটি, যেখানে চার বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ৭৮ কোটি ৫০ লাখ।

-ই যখন খাদ্যনিরাপত্তার হাল, তখন গবেষকরা জানালেন আরেক অশনিসংকেত। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গত চার দশকের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, পশ্চিমা রসনা রুচি বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে তাদের খাদ্যতালিকায় অ্যাভোকাডো, কফি, লেবুজাতীয় ফলের চাহিদা মেটাতে ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের কৃষিবৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলছে।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে একক ফসলে ঝুঁকছেন চাষীরা। ধান ও গমের মতো স্বপরাগায়ন ফসলের চাষ বৃদ্ধিতে মৌমাছির মতো পরাগায়ন সহায়ক কীটপতঙ্গ ও পাখির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফলের মতো বিভিন্ন পর-পরাগায়ন ফসল চাষও বাড়ছে তবে তা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ফুল দেয় বলে মৌমাছির মতো পরাগায়ননির্ভর পতঙ্গের বছরজুড়ে বেঁচে থাকা ও বংশবিস্তারের সহায়ক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। এতে পরিবেশের প্রাকৃতিক চক্র অর্থাৎ পুরো বাস্তুতন্ত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়ছে।

শুধু তা-ই নয়, অ্যাভোকাডো, কফি, পাম অয়েলের মতো ফসলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ব্যাপকভাবে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে আবাদি জমি তৈরি করা হচ্ছে। এতে মাটির গুণাগুণ নষ্ট, ভূমিক্ষয় ও ওরাংওটানের মতো অনেক বিপন্ন প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকি মুখে পড়ছে।

গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে মূলত গ্লোবাল ওপেন ডাটা ফর এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড নিউট্রিশন (গোডান) নামে একটি সংস্থার অধীনে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এ সংস্থাটির পৃষ্ঠপোষক।

গোডানের নির্বাহী পরিচালক আন্দ্রে লাপারিয়ের বলেন, পোকামাকড় ও পরাগায়নে সহায়ক প্রাণী যেমন মৌমাছি, যদি বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্লুমিং প্যাটার্ন (ফুল ফোটার আলাদা মৌসুম) যুক্ত গাছ থেকে বছরজুড়ে খাদ্য ও পুষ্টি না পায়, তাহলে তারা অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। এ পরিস্থিতি বিশ্বের খাদ্য চক্রের ভারসাম্যই নষ্ট করে দিতে পারে।

বিদ্যমান পরিস্থিতি একইভাবে অব্যাহত থাকলে বৈশ্বিক কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও পরাগায়ন সহায়ক কীটপতঙ্গবান্ধব শস্যের আবাদ ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন আন্দ্রে লাপারিয়ের।

এফএওর ৪০ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেছেন, সয়াবিন, সরিষা ও পামের মতো একক ফসলের আবাদ যে পরিমাণ কৃষিজমি দখল করে আছে, তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এতে বৈশ্বিক শস্যবৈচিত্র্য অভূতপূর্ব হ্রাস পেয়েছে। এ ধরনের শস্যে পরাগায়ননির্ভর কীটপতঙ্গের জন্য খুবই অল্প সময় ও অল্প এলাকায় পুষ্টিপ্রাপ্তির সুযোগ থাকে। ফলে এসব শস্য কীটপতঙ্গের খুবই অস্থিতিশীল খাদ্য উৎস। যেখানে একক ফসল ও ব্যাপকভাবে কীটনাশকের ব্যবহার ও বন ধ্বংসের কারণে এরই মধ্যে এ ধরনের কীটপতঙ্গের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। রাসায়নিক সারের ব্যাপক ব্যবহার এ পরিস্থিতিকে ত্বরান্বিত করেছে।

গবেষণা প্রতিবেদনের সহলেখক মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডেভিড ইনৌয়ে বলেন, চাষীদের মধ্যে ফল, বাদামজাতীয় শস্য ও তেলজাতীয় ফসল আবাদের প্রবণতা বেড়েছে, যেগুলোয় পর-পরাগায়ন প্রয়োজন। কারণ এসব ফসলের বিশ্বব্যাপী চাহিদা বাড়ছে এবং বাজারমূল্যও বেশ উচ্চ। আমরা গবেষণায় দেখেছি, বর্তমান এ প্রবণতা পরাগায়ননির্ভর কীটপতঙ্গের জন্য মোটেও ভালো কিছু নয়। যেসব দেশ কৃষিতে বৈচিত্র্য আনছে, তারা নির্দিষ্ট কিছু ফসল চাষে সীমাবদ্ধ দেশগুলোর তুলনায় সবদিক থেকে উপকৃত হচ্ছে, এটি প্রমাণিত।

১৯৬১-১৬ সাল পর্যন্ত মাঠফসল সম্পর্কিত এফএওর উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, পরাগায়ন সহায়ক কীটপতঙ্গ কমে যাওয়া মানে ফসলের উৎপাদনও হ্রাস পাওয়া। এমনকি এমন পরিস্থিতিতে ফলন একেবারে শূন্যেও নেমে যেতে পারে। অথচ অনেক দেশের কৃষিতে পরাগায়ন সহায়ক কীটপতঙ্গের ওপর নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

তাছাড়া ফসলের ফলন বিপর্যয় গরিব দেশগুলোকেই সবচেয়ে বেশি বিপদে ফেলবে এমনটি ধারণা করা হলেও ওই পরিস্থিতি তৈরি হলে কিন্তু বিশ্বের অন্য প্রান্ত প্রভাবমুক্ত থাকবে না।

ইউরোপে আবাদি জমিতে নগরায়ণ কৃষির ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে ফেলছে। এতে পর-পরাগযোগের ওপর নির্ভরশীল ফসলের স্থান দখল করছে স্ব-পরাগায়ন ফসল, যেমন ধান ও গম। এ পরিস্থিতি কিন্তু যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশকে এরই মধ্যে সমস্যায় ফেলেছে।

দেখা গেছে, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ার কৃষি সবচেয়ে অস্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এসব দেশে সয়াবিন চাষের জন্য বন ধ্বংস করা হচ্ছে। আর এ সয়াবিনের উল্লেখযোগ্য অংশ ইউরোপে পশুখাদ্য হিসেবে রফতানি হচ্ছে।

গবেষক দলের প্রধান আর্জেন্টিনার ন্যাশনাল কাউন্সিল ফল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল রিসার্চের অধ্যাপক মার্সেলো আইহেন বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রতি দশকে প্রায় ৩০ শতাংশ হারে সয়াবিন উৎপাদন বেড়েছে। এটা ভয়ানক সমস্যা। কারণ সয়াবিন চাষের জন্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয়, প্রায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন ও তৃণভূমিসহ বিশ্বব্যাপী বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক ও আধা প্রাকৃতিক আবাস ধ্বংস করা হচ্ছে।

গ্লোবাল চেঞ্জ বায়োলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাম চাষ একই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করছে। বন পরিষ্কার করে একক ফসলের আবাদ সম্প্রসারিত করা এসব দেশ সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে।

নানা কারণে এমনিতেই কৃষি এখন হুমকির মুখে। অব্যাহত উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, দাবদাহ ও শৈত্যপ্রবাহের মতো বিরূপ আবহাওয়া এবং নতুন নতুন রোগের সংক্রমণের কারণে কৃষি উৎপাদন ও ব্যবসায় ঝুঁকি কয়েক বছরের মধ্যে ১০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিক্ষয় এবং নগরায়ণ ও জনসংখ্যার চাপে দ্রুত কৃষিজমি হ্রাস। এ পরিস্থিতিতে ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার লক্ষ্য অর্জন খুব কঠিন হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

২০১৮ সালের খাদ্যনিরাপত্তা সূচক অনুযায়ী, বিশ শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ব তার ঐতিহ্যবাহী খাদ্যবৈচিত্র্য হারিয়েছে ৭০ শতাংশ। বৈশ্বিক কৃষি এখন প্রধান ১২টি ফসল আবাদে সীমিত হয়ে গেছে। যেসব ফল ও শিমজাতীয় ফসলের উৎপাদন ব্যয় কম এবং অধিকপুষ্টি সমৃদ্ধ, সেসব আবাদে ঝুঁকছে মানুষ। এ বৈচিত্র্য সংকট পরিবেশ ও মানুষের পুষ্টি ভারসাম্যের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে পশ্চিমা সমাজে অন্যতম জনপ্রিয় ফল অ্যাভোকাডোর কথাই ধরা যাক। এ ফলের স্বাস্থ্য উপকারিতার প্রচার-প্রচারণার কারণে পশ্চিমে এক ধরনের অ্যাভোকাডো অবসেশন তৈরি হয়েছে! এ ফলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ব্যাপক হারে উৎপাদন বাড়াতে হচ্ছে। ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মেক্সিকোসহ যেসব অঞ্চলে অ্যাভোকাডোর ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে, সেসব দেশে শুরু হয়েছে ভূমিক্ষয় এবং মাটির মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারণ এ ফল চাষে প্রচুর সেচ দিতে হয়। এতে স্থানীয় জলাধারের ওপর চাপ বাড়ছে। এক হিসাবে জানা যায়, আধা কেজি অ্যাভোকাডো উৎপাদনে প্রায় ২৭২ লিটার পানির সেচ লাগে। অর্থাৎ মাঝারি আকারের মাত্র দু-তিনটি ফল উৎপাদনে প্রায় ৩০০ লিটার পানি খরচ হচ্ছে। এ কারণেই বিশ্বের সর্বোচ্চ সেচনির্ভর ফসলের খেতাবটি অ্যাভোকাডোর।

এছাড়া ব্যাপকভাবে অ্যাভোকাডোর চাষ মাটিকে অনুর্বর করে ফেলছে। প্রচুর পরিমাণে খনিজ শোষণের ফলে মাটি রোগাবালাইয়ের প্রতি অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। এতে বাড়ছে ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

অ্যাভোকাডোর ব্যাপক চাষের মতো অন্যান্য ফসলও পরিবেশের প্রতি একই ধরনের প্রভাব ফেলছে। পশ্চিমে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং উত্তরোত্তর দাম বাড়ছে এমন কৃষিজাত পণ্যের কারণেও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। পাম অয়েল, সয়ামিল্ক, কফি, লেবু ও কলার মতো ফল চাষ পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি করছে।

১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পাম অয়েলের চাহিদা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। কারণ এটির বহুমুখী ব্যবহার। সাবান, শ্যাম্পু, রুটি, ভাজার তেল ও কসমেটিকস পণ্যে পাম অয়েলের ব্যবহার রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষের প্রত্যেকে বছরে আট কেজি পাম অয়েলের ভোক্তা।

উচ্চ চাহিদার কারণে উৎপাদন বাড়াতে যে হারে পামের আবাদ বাড়ছে, তাতে অচিরেই বিশ্বের আবাদযোগ্য জমির এক-চতুর্থাংশ এ ফসলের অধীনে চলে যাবে। এরই মধ্যে বৈশ্বিক শস্যক্ষেত্রের ১০ শতাংশে পাম চাষ হচ্ছে। নতুন নতুন পাম বাগান করতে নির্বিচারে বন ধ্বংস করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় এভাবে বন ধ্বংসের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি আবাস হারাচ্ছে ওরাংওটান, সুমাত্রা টাইগার ও সুমাত্রা গণ্ডারের মতো বিপন্ন প্রাণী। পাশাপাশি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণেও বড় ভূমিকা রাখছে এ বন ধ্বংস ও পাম চাষ। ইন্দোনেশিয়ায় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ কর্মকাণ্ড হচ্ছে পামের নতুন নতুন বাগান সৃজন। কীটপতঙ্গ ও বন্যপ্রাণীবান্ধব টেকসই কৃষির বিস্তার ছাড়া এ বিপর্যয় থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই বলে মনে করছেন গবেষকরা।

 

জাহাঙ্গীর আলম

সূত্র: ফারইস্টার্ন এগ্রিকালচার, দ্য গার্ডিয়ান, জিওগ্রাফিক্যাল ডটকো

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন