বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক কনজিউমার ব্র্যান্ড ইস্পাহানি টি

সুজিত সাহা

ছবি : সংগৃহীত

ব্রিটিশ ভারতে চা চাষ শুরুর পর যে কয়েকটি কোম্পানি পাকিস্তান, পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে চা শিল্পে রাজত্ব করেছে তার অন্যতম ইস্পাহানি পরিবার। দেশী-বিদেশী একাধিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সম্প্রসারণের পরও ইস্পাহানি এখনো দেশের শীর্ষস্থানীয় চা ব্র্যান্ড। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে বহুজাতিক বড় বড় কোম্পানির আধিপত্যের মধ্যে ইস্পাহানি গ্রুপের চা ব্র্যান্ড প্রথম সারিতে। ১৮২০ সালে পারিবারিক ব্যবসার গোড়াপত্তনের পর ইরানের ইসফাহান থেকে ব্যবসা করতে করতে ইস্পাহানি পরিবারটি মুম্বাই, কলকাতা এবং সবশেষে চট্টগ্রামে এসে থিতু হয়। ভারতের বিভিন্ন শহরে ব্যবসায়িক পরিধি বিস্তৃত করলেও ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে চট্টগ্রামে ব্যবসায়িক সম্ভাবনার দূরদৃষ্টিতে অবলোকন করেন ইস্পাহানি পরিবারের কর্ণধাররা। চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের পরও ভারতে ব্যবসা জারি থাকে। তবে ১৯৬৫ সালে ভারত ইস্পাহানি পরিবারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে ইস্পহানি পরিবার। ২০২২ সালে ইস্পাহানি এ অঞ্চলে পারিবারিক ব্যবসার ৭৫ বছরপূর্তি উদযাপন করেছে। নানা ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেও চা-কে ঘিরে ইস্পাহানি পরিবারের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বিস্তৃত।

ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি) হিসেবে ইস্পাহানি গ্রুপের বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে চা-ই প্রধান। বাংলাদেশের কনজিউমার পণ্যের ভিড়ে কয়েক দশক ধরে ইস্পাহানি চা অনন্য অবস্থান ধরে রেখেছে। মাঝে বিভিন্ন বিদেশী ব্র্যান্ড বাংলাদেশের বাজার সৃষ্টি ও ইস্পাহানির আধিপত্য ভাঙার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে নানা ব্র্যান্ডের আবির্ভাব হলেও উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে পাড়ার বস্তিতেও ইস্পাহানি চা সমানভাবে সমাদৃত। ইস্পাহানি লাভজনক নানা ব্যবসার ভিড়েও চা-কে তাদের ব্যবসায়িক উৎকর্ষের মূল পণ্য হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে আসছে প্রায় আট দশক ধরে। মূলত গুণগত মান বজায় রেখে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিপণন পদ্ধতির কারণে ইস্পাহানি চা দেশের অন্যতম এফএমসিজির স্বীকৃতি পেয়েছে। চা-কে নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট, টি-ব্যাগসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের চাহিদাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সহজলভ্য করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ইস্পাহানি চা-কে দেশের শ্রেষ্ঠ কনজিউমার ব্র্যান্ডে রূপান্তর করতে সহায়তা করেছে। বছরের পর বছর চা খাতে টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নেতৃত্ব ছাড়াও বাংলাদেশীয় চা সংসদেও ভূমিকা রাখছে ইস্পাহানি গ্রুপ।

বাংলাদেশের ১৬৮টি চা বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের ক্ষেত্র থাকলেও ইস্পাহানি গ্রুপের চা বাগানের সংখ্যা মাত্র চারটি। চারটি বাগানই দেশের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের চা উৎপাদনে বিখ্যাত। চাহিদার চেয়ে বাড়তি উৎপাদন, উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজারমূল্য কম হওয়ায় লোকসানের যে প্রবণতা বাংলাদেশের চা শিল্পে সেখানে ইস্পাহানির চারটি বাগান হাঁটছে ভিন্ন পথে। বাগানের কর্মচারীদের সবার থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও একরপ্রতি ভালোমানের চা উৎপাদনের মাধ্যমে অন্য বাগান মালিকদের চেয়ে লাভজনক পর্যায়ে আছে ইস্পাহানি গ্রুপ। দেশী-বিদেশী একাধিক পুরনো শিল্প গ্রুপ চা খাতের বিনিয়োগ সংকুচিত কিংবা ব্যবসা পরিবর্তনের চিন্তা করলেও ইস্পাহানি গ্রুপ চা উৎপাদন ও বিনিয়োগে ক্রমে বিনিয়োগ বর্ধিত করছে প্রতি বছর। যদিও ২০০৫ সালে ইস্পাহানি গ্রুপ দ্য কনসোলিডেটেড টি আন্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (ফিনলে) সাতটি বাগানের শেয়ার কিনে চা উৎপাদন ব্যবসার সম্প্রসারণ করে।

দেশের চা খাতের উৎকৃষ্টতম স্থান সিলেট ভ্যালিতে ইস্পাহানি গ্রুপের চা বাগান রয়েছে তিনটি। বাগানগুলো হলো মির্জাপুর, গাজীপুর ও জেরিন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ভ্যালির চা বাগানটির নাম নেপচুন। নেপচুন চা বাগানের অবস্থান চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর ইউনিয়নের নারায়ণহাট গ্রামে। সিলেট ভ্যালির চা বাগান তিনটি মৌলভীবাজার জেলার কুড়াউড়া উপজেলায়। প্রতি বছর বাংলাদেশের বাগানগুলোয় উৎপাদিত চায়ের মধ্যে একক কোম্পানি হিসেবে ইস্পাহানি গ্রুপের তিনটি চা বাগান ভালোমানের চা উৎপাদনে প্রথম ২০টি বাগানের তালিকায় অবস্থান করে।

চা বোর্ডের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ মৌসুমে দেশে ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়। শুধু চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক নিলামে ইস্পাহানি গ্রুপের চারটি বাগান ৪৪ লাখ ২৫ হাজার ৮০৩ দশমিক ৭০ কেজি চা বিক্রি করেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ দামে চা বিক্রির তালিকায় আট নম্বরে থাকা নেপচুন চা বাগান ২১৮ দশমিক ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছে ৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৬৪ দশমিক ৮০ কেজি, নয় নম্বরে থাকা গাজীপুর চা বাগান ২১৬ দশমিক ৮৫ টাকা কেজি দরে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৩১১ দশমিক ৬০ কেজি, ১৭ নম্বরে থাকা নেপচুন চা বাগান ২১১ দশমিক শূন্য ৩ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৫ দশমিক ৯০ কেজি এবং ১৮ নম্বর অবস্থানে থাকা মির্জাপুর চা বাগান ২০৯ দশমিক ৪৫ টাকা কেজি দরে ১৫ লাখ ১৬ হাজার ৩২১ দশমিক ২০ কেজি চা নিলামে বিক্রি করেছে।

শুধু বিগত নিলামবর্ষই নয়, চলতি নিলামবর্ষেও (২০২৪-২৫) ইস্পাহানি গ্রুপের বাগানগুলো ভালোমানের চা উৎপাদনে এগিয়ে। ১৫ সেপ্টেম্বরের নিলাম প্রতিবেদন অনুযায়ী গাজীপুর চা বাগান ১৬ নম্বর অবস্থানে থেকে এ পর্যন্ত ২৩৪ দশমিক ৯২ টাকা কেজি দরে চা বিক্রি করেছে ৩ লাখ ৬ হাজার ১৫৮ কেজি, ১৯ নম্বর অবস্থানে থেকে নেপচুন চা বাগান ২২৯ দশমিক ৯৫ টাকা কেজি দরে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৮৫ কেজি, ২২ নম্বর পজিশনে থেকে মির্জাপুর চা বাগান ২২৮ দশমিক ৮৮ টাকা কেজি দরে ৩ লাখ ৯৮ হাজার ২৯৭ কেজি এবং ২৩ নম্বর অবস্থানে থাকা জেরিন চা বাগান ২২৮ দশমিক শূন্য ৭ টাকা কেজি দরে চা বিক্রি করেছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৯৪ কেজি। ১৭টি নিলামের তথ্য থেকে এ প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও মৌসুম শেষে ৫০টি নিলামে ইস্পাহানি গ্রুপের বাগানগুলো শীর্ষ দশে চলে আসবে বলে আশা করছেন চাসংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশে চা খাতের উৎপাদক, মোড়কজাত ও বিপণন কোম্পানি হিসেবে ইস্পাহানি চা ব্র্যান্ড ২০১৫-২১ সাল পর্যন্ত অন্তত ২১টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে সেরা হট বেভারেজ, সেরা ব্র্যান্ড, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্র্যান্ড, সর্বাধিক প্রিয় ব্র্যান্ড ক্যাটাগরিতে এসব পুরস্কার পেয়েছে ইস্পাহানি টি, ইস্পাহানি মির্জাপুর টি। এমনকি ২০১৯ সালে ন্যাশনাল প্রডাক্টিভিটি অ্যান্ড কোয়ালিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড বৃহৎ শিল্প ক্যাটাগরি (ফুডস) প্রথম হয়েছে ইস্পাহানি টি লিমিটেড। ইস্পাহানি টি ট্রেড, টি ব্র্যান্ড, টি গার্ডেন, কটন অ্যান্ড টেক্সটাইল, ফুডস, এগ্রো, আইসিটি, হসপিটালিটি অ্যান্ড লেইজর, এনার্জি, প্যাকেজিং, শিপিং ও রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ থাকলেও বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী চা নিয়েই আধিপত্য, প্রভাব ও সুনাম কুড়িয়েছে ইস্পাহানি পরিবার। দেশে উৎপাদিত চায়ের ৫ শতাংশের বেশি অবদান রাখলেও চা বিপণনে ইস্পাহানির বাজার শেয়ার প্রায় ৫০ শতাংশ। এমনকি টি-ব্যাগ বিপণনে ইস্পাহানির মার্কেট শেয়ার ৮০ শতাংশেরও বেশি। প্রচলিত ডিলারশিপ পদ্ধতিতে বিপণন কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশব্যাপী ইস্পাহানির রয়েছে ৩০০টির বেশি সেলস সেন্টার। মূলত ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিপণন, পরিচিতকরণ, প্রদর্শনীর জন্য এসব সেন্টারকে ব্যবহার করে ইস্পাহানি গ্রুপ। ফলে দেশের আনাচেকানাচে ইস্পাহানি চা একটি সমাদৃত ব্র্যান্ড হিসেবে দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে পরিচিত।

শুধু চা উৎপাদনই নয় দশকের পর দশক ধরে ইস্পাহানি টি লিমিটেড দেশের প্রধানতম চা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। নিলাম থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে ক্রয়ের পর ওই চা মোড়কজাত করে দেশে বাজারজাত ও বিদেশে রফতানি করে তৃণমূল থেকে করপোরেট পর্যায়ে জনপ্রিয় হয়েছে ইস্পাহানি চা। এর মধ্যে ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ নিলাম মৌসুম পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নিলাম থেকে সবচেয়ে বেশি চা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইস্পাহানি টি লিমিটেড। ২০২১-২২ মৌসুমে ইস্পাহানি নিলাম থেকে ১ কোটি ৮৭ লাখ ৬ হাজার ৪৮৮ দশমিক ২০ কেজি চা সংগ্রহ করেছে, যা নিলামে বিক্রি হওয়া চায়ের ২১ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২২-২৩ সালে নিলামে বিক্রি হওয়া চায়ের ২২ দশমিক ২০ শতাংশ বা ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩২ হাজার ৪৮৬ দশমিক ৪০ কেজি চা কিনে নিয়েছে ইস্পাহানি টি লিমিটেড। বাকি ৭৭-৭৮ শতাংশ কিনেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ৩৪টি কোম্পানিসহ অন্য ছোট বায়ার প্রতিষ্ঠানগুলো।

দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড পুরস্কার ছাড়াও জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ইস্পাহানি টি কোম্পানি। ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো আয়োজিত জাতীয় চা পুরস্কারে দুটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পায় ইস্পাহানি টি লিমিটেডের চা বাগান। ‘শ্রমিক কল্যাণের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ চা-বাগান’ ক্যাটাগরি ছাড়াও ‘শ্রেষ্ঠ চা-পাতা চয়নকারী’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পায় নেপচুন চা বাগানের চা শ্রমিক ‘উপলক্ষী ত্রিপুরা’। ২০২৪ সালেও জাতীয় চা পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চা পাতা চয়নকারী শ্রমিক হিসেবে দেশসেরা হয়েছেন নেপচুন চা বাগানের চা শ্রমিক জেসমিন আক্তার। এভাবে শ্রমিক কল্যাণ, গুণগত মানের চা উৎপাদন, সর্বাপেক্ষা কমমূল্যে ভালোমানের চা বিপণনের মাধ্যমে ইস্পাহানি টি দেশের অন্যতম এফএমসিজি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন