যাদের রক্তের বিনিময়ে এ অর্জন, তাদের যেন না ভুলি

বণিক বার্তার সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় উপস্থিত অতিথিরা ছবি: তাওহীদুজ্জামান তপু

ন্যাশন-বিল্ডিং: বাংলাদেশের গতিমুখ শিরোনামে সম্প্রতি একটি মতবিনিময় সভা আয়োজন করে বণিক বার্তা। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ আয়োজিত ওই সভায় আমন্ত্রিত ছিলেন বিভিন্ন স্টাডি সার্কেলের মুখপাত্র, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও ক্রিয়াশীল চিন্তকরা। ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ ও অন্তর্বর্তী সরকারের নানাবিধ চ্যালেঞ্জ উঠে আসে তাদের আলোচনায়। এছাড়া বাংলাদেশ কীভাবে ন্যাশন-বিল্ডিংয়ের চ্যালেঞ্জগুলো উতরে যেতে পারে সে রূপকল্পও সেখানে উঠে এসেছে। বণিক বার্তার সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন সাবিদিন ইব্রাহিম    


অলিউর সান

বোধিচিত্ত

সাংস্কৃতিক একতা তৈরি করতে হবে

জাতি মানে হচ্ছে সাংস্কৃতিক একতা। এখন সেই সাংস্কৃতিক একতা পরিগঠনের ক্ষেত্রে আমরা কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে অবস্থান গ্রহণ করব, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ মুহূর্তে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র এবং বিশ্বের সব দেশ আমাদের শ্রোতা। আমরা যা করব, বিশ্বের সব দেশ দেখবে। তাদের সঙ্গে আমাদের অংশগ্রহণ রাজনৈতিক, মতাদর্শিক। কূটনৈতিকভাবে সেই যোগাযোগগুলো আমাদের রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট একটা বড় ভূমিকা পালন করবে। আমরা যখন ন্যাশন বিল্ডিংয়ের কথা বলছি, তখন ’৭১, ’৪৭ কিংবা তারও আগের সময় নিয়ে একটা বিতর্ক হতে পারে যে জাতির ইতিহাস আমরা কখন থেকে ধরব। বেঙ্গল ডেটা অববাহিকার যে পরিচয়, সেখান থেকে যদি জাতি পরিচয়ের ক্ষেত্রে আমরা বিবেচনা করি, তাহলে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম ও পরিচয় জাতিগোষ্ঠীভাবে কীভাবে আমরা ধারণ করব, সে বিষয়টা ভাবতে হবে। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের চারপাশ ভারতবেষ্টিত। সাংস্কৃতিক একতা তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের ভাবতে হবে যে আমরা কী কী রাজনৈতিক পরিচয় বা বাইনারি—যেগুলো চলে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে, এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নিচ্ছি কিংবা বলে আসছি। কিন্তু সেগুলোর রূপায়ণটা কেমন, দেখতে কেমন কিংবা সেগুলো কীভাবে গঠিত হচ্ছে। সেখানে কাদের রাজনৈতিক মতাদর্শিক লড়াই চলছে, তা আমাদের চিহ্নিত করা দরকার।

বিপ্লবের পরের সময়গুলো অনেক কঠিন। কারণ বিপ্লবের সময় আমাদের একতা থাকে। বিপ্লবের পরের দিন থেকে সবাই নিজের স্বার্থ, নিজের দলগোষ্ঠীভুক্ত হয়ে আমাদের কাজ শুরু করে দিই। এটাকে আমি বিশ্বাসঘাতকতার সময় বলব। যেটা আমরা এখন পার করছি। আমাদের মাঝে একধরনের একটা অবিশ্বাস আছে। এ সময়ে ঢাকা শহরে অন্তত ৮০-১০০ নাগরিক পরিসর কিংবা নানান কিছু তৈরি হয়ে গেছে। এটা কিন্তু আগে ঘটেনি। আমি এটাকে অবশ্যম্ভাবী ও ইতিবাচক অর্থে দেখি। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে মানুষের মাঝে একটা অবিশ্বাস তৈরি হয়ে আছে। বিপ্লবের আগের দিন পর্যন্ত আমরা সবাই শেখ হাসিনার পতনের বিষয়ে একমত ছিলাম। কিন্তু পতনের পর কী হবে—এ ব্যাপারে আমরা একমত হতে পারিনি। আমি এটাকে একটা উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করতে চাই যে আমাদের দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চর্চা ও উদ্যেগ, সেগুলো নিয়েই জাতিগঠনের যে একতা তৈরি করার কথা ছিল, তা পারিনি বলেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে পারিনি এবং আমরা নানান পরিসরে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের মাঝে এ অবিশ্বাস এখনো কাজ করছে। এটার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমরা যে ঐক্যের ডাক দিচ্ছি, সেটা আমাদের কল্পনা করতে পারতে হবে এবং তা করার জন্য আমাদের যে মতাদর্শিক কাজ করা দরকার, সেখানে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা আছে। এ জায়গায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বড় ব্যর্থতা রয়েছে। আমাদের হাতে এখন সুযোগ আছে, এ জায়গাটাতে কাজ করার।


সাইয়েদ আব্দুল্লাহ

অ্যাক্টিভিস্ট

উইল অব দ্য পিপলের ভিত্তিতেই কাজ করা উচিত

ন্যাশন বিল্ডিংয়ের আলোচনায় এর পরও আত্মসমালোচনার উদ্দেশ্যে আমাকে বলতেই হবে যে তরুণরা সব পারে না। শুধু আমাদের শক্তিমত্তার সম্পর্কে যদি ধারণা থাকে, তাহলে আমরা আরেকটা ভুল কাজ করব। আমাদের শক্তির পাশাপাশি দুর্বলতা কোথায় আছে, সেটা চিহ্নিত করাটাও জরুরি। হয়তো আমাদের যে বয়স চলছে, সে বয়সের কারণে আমাদের সীমাবদ্ধতাকে আমরা বিবেচনায় রাখতে পারি না। সেজন্য বাংলাদেশের জাতিগঠনের গতিমুখ কোন দিকে হবে, সেটা বিবেচনা করার জন্য তরুণদের অংশগ্রহণ যেমন জরুরি, তেমনি বিভিন্ন কারিগরি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ যারা আছেন তাদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশে কিন্তু সবসময় বিশেষজ্ঞদের উপেক্ষা করা হয়। বাংলাদেশে সাচিবিক দৌরাত্ম্য নামে একটা কথা আছে। বিভিন্ন কারিগরি প্রতিষ্ঠান কিংবা বড় বড় অধিদপ্তরে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাদের শিক্ষাগত পটভূমি কারিগরি যোগ্যতাকে পূরণ করে না। এ রকম অনেক জায়গায় দেখা যাবে যে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো একজনকে এমন জায়গায় বসিয়ে রাখা হয়েছে, যা সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কাজেই তরুণ এবং এ বিশেষজ্ঞদের বয়স কত, কোথা থেকে এসেছে—এ বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের পদায়ন করার বিষয়ে ভাবা উচিত।

যখনই ন্যাশন বিল্ডিংয়ের  কথা বলি, আমরা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা সাংবিধানিক সংস্কারের কথা বলি। আমরা ভাবি, সংবিধান সংস্কার করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ন্যাশন বিল্ডিং একটা বিমূর্ত ধারণা। সংবিধান আপনি পরিবর্তন করতেই পারেন, কিন্তু কিছুদিন পর আরেকজন হাসিনা এসে যে সংশোধনী আনবে না, তার মতো করে সংস্কার করবে না—এর নিশ্চয়তা কি পৃথিবীর কেউ দিতে পারে? আপনি যদি সভ্য রাষ্ট্র হন, তাহলে আপনার ছোট্ট সংবিধান দিয়েই অনেক কিছু রক্ষা করা যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট সংবিধানের একটি যুক্তরাষ্ট্রের। আর সবচেয়ে বড়গুলোর তালিকায় পাশের দেশ ভারত। কিন্তু এতে কি এখানে মানবিক মর্যাদা তৈরি হয়েছে? কাজেই সংবিধান পরিবর্তন করলেও সেখানে পরবর্তী সময়ে কাটাছেঁড়ার জায়গা থাকে। আমাদের আগে ভাবা উচিত উইল অব দ্য পিপল (জনগণের ইচ্ছা) নিয়ে। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের আবির্ভাব ঘটেছে, সেটারও মূল ভিত্তি ছিল উইল অব দ্য পিপল কী বলছে! এটা একটা বিমূর্ত ধারণা। একে আপনি প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা সাংবিধানিক সংস্কার দিয়ে পরিবর্তন করতে পারবেন না।

আর আমাদের ন্যাশন বিল্ডিং যদি শুরু করতে হয়, তাহলে আমাদের একদম গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। যেমন শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে কথা বললেই আমাদের আলোচনাটা চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। আলোচনাটা হওয়া উচিত ছিল একেবারে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত। এ জায়গায় সংস্কারের যে প্রয়োজনীতা, সেখানে কেউ স্পর্শ করতে চায় না। একটা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা যদি ঠিক করা যায়, তাহলে উইল অব দ্য পিপল স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উন্নতি করবে। 


সাধনা মহল

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন

অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে

এ সরকার আমাদের সরকার। এ সরকারকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। এ সরকারকে যদি আমরা না চাই, তাহলে আমাদের রাস্তার ধুলো পরিষ্কার করতে হবে। আমাদের স্লোগান হতে হবে—এ পরিস্থিতিতে ‘করণীয় কী’।

সচিবালয়ের দরজা বন্ধ কেন? এটা তো মানুষের সরকার। সচিবালয়ের দরজা বন্ধ রাখা যাবে না। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সামনে একটি করে সার্ভিস ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। এতে সচিবালয়ের পাস খুঁজতে হবে না। এটা খুব দুঃখজনক। উপদেষ্টা সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ পুলিশ আমরা চাই না। এ পুলিশ ঘুস খায়। 

এক-এগারোর পর অনেক কমিশন দেখেছি। কিন্তু কার্যকর হয়নি। পরে হাসিনা ক্ষমতায় এসে সে প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণ করেছে। সেই চর্চা আমরা পুনরাবৃত্তি হতে দেব না। এ সরকারও কমিশন করছে, ঠিক আছে। কিন্তু কমিশনের পলিটিক্যাল উইল বলতে হবে। এ কমিশনকে কোনোভাবে দলীয় কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আগে এটা জানাবেন, তারপর একজন ব্যক্তিকে কমিশনের সদস্য নিয়োগ দেবেন।


তাহসিন বিন বাশার

সমাজচিন্তা

হীনম্মন্যতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত

আমাদের আফসোসের বিষয় হলো যে ২০২৪-এ এসেও আমাদের ন্যাশন বিল্ডিং নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। ১৯৪৭-এ আমরা কলোনিয়াল থেকে বের হয়ে এসেছি। কিন্তু আমাদের আলাপটা এখনো সে সময়ে পড়ে আছে। যেকোনো ভূমিতেই অনেক জাতি, ধর্ম, বর্ণ থাকে। কিন্তু জাতির একতার যে বিষয়, সে প্রশ্নটা আমরা এখনো সমাধান করতে পারিনি। সেজন্য ঘুরেফিরে জাতি গঠনের বিষয় আমাদের আলোচনায় আসে। রাষ্ট্র গঠন তো অনেক পরের ব্যাপার। আর সভ্যতা তো আরো অনেক পরের বিষয়। এটা আমাদের জন্য একটা দুর্ভাগ্য। ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বলব, আমাদের এ ভূমির মানুষের মাঝে এক ধরনের হীনম্মন্যতা আছে। সে হীনম্মন্যতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।


শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি

সাবেক ভিপি, শামসুন্নাহার হল, ঢাবি

যাদের রক্তের বিনিময়ে এ জায়গায় পৌঁছেছি, তাদের উপেক্ষা করছি কিনা

আমরা নানান রকম মতাদর্শের কথা বলি, নানান আদর্শে বিভক্ত। আমাদের সহিষ্ণুতার এত অভাব যে আমরা এখন এখানে বসে আছি, কিন্তু দেশের কোথাও কোনো মানুষ নির্যাতিত কিংবা নিষ্পেষিত হচ্ছে কিনা, তা আমরা কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। সম্প্রতি আমরা দেখলাম, বিএনপির দুই নেতাকে গোপালগঞ্জে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে একজন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের আম্পায়ার ছিলেন। অথচ যারা ক্রিকেটার, তাদের থেকেও আমরা কোনো প্রতিবাদ পাইনি। কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামে একজন স্টাফ মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি পানি চেয়েছিলেন, আমরা তার হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিয়েছি; পানি দিতে পারিনি। আবার নিরস্ত্র আবু সাঈদ, যে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যার হাতে কোনো লাঠিও ছিল না, তার দিকে পুলিশ গুলি চালাল। ব্যাপারটা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ না। অনেক বাবা-মা ৪০ দিন পরও তাদের সন্তানদের খোঁজ জানেন না। আমাদের এখন পর্যন্ত কতজন শহীদ হয়েছেন, তা-ও আমরা জানি না। আমার মনে হয়, যে ছোট্ট একটা দেশে আমরা বাস করি, সেখানে সে শহীদদের প্রতি যদি আমাদের শ্রদ্ধা বা স্বচ্ছতা থাকত, তাদের জীবনটাই যদি আমাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হতো, তাহলে আমরা খুব সহজেই শহীদের তালিকা করে ফেলতে পারতাম। সে আধুনিক সম্পদ আমাদের আছে। তারপর যারা আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে, আমরা ক’জন তাদের খোঁজ নিয়েছি। আমি যদি ভুল না হই, আমাদের পুরো আলোচনা এখন বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। কিন্তু যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা এ জায়গায় পৌঁছেছি, তাদের এরই মধ্যে আমরা উপেক্ষা করা শুরু করেছি কিনা—এ ব্যাপারটি আমাদের স্মরণে রাখা উচিত।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, নারী হিসেবে আমি আমার সম্মান কেন পাই না। আমি যেকোনো রকমেরই পোশাক পরিধান করতে পারি। কিন্তু আমার ডান, বাম, শিবির—সব বন্ধুর থেকেই কেন আমাকে নেতিবাচক কথা শুনতে হবে? সেজন্য ন্যাশন বিল্ডিং কিংবা নীতিনির্ধারণ, সেগুলো পরের বিষয়, আগে আমাদের দেশের মানুষ বাঁচবে কীভাবে, নিরাপত্তা পাবে কীভাবে, এটাই আমাদের প্রথম বিবেচ্য বিষয় হওয়া দরকার।


ফাতিমা তাসনিম ঝুমা

ইনকিলাব মঞ্চ

সবার কথা শুনে রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি হোক

ন্যাশন-বিল্ডিংয়ের এ আলোচনা আমাদের আরো অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সবাই নিজেদের মতাদর্শ কেন জানি যার যার ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। কেউ সেক্যুলার বাংলাদেশ লিখতে চাইছে, সেটাকে আবার মুছে দিয়ে আমাকে ইনক্লুসিভ লিখতে হচ্ছে। সেখানেও আবার আমি ইনক্লুসিভ চাই, সেটা মুছে দিয়েও লিখতে হচ্ছে। এটা এক ধরনের কালচারাল ফ্যাসিজম। এটা নির্দিষ্ট একটা কালচার কিংবা চর্চাকে সীমাবদ্ধ করে দিতে চায়। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে এসে আমরা আরো একটা জিনিস দেখছি যে মব জাস্টিস। এ মব জাস্টিসকে কেন সম্পূর্ণ সরকারিভাবে দমন করার চেষ্টা করা হচ্ছে না? কিংবা সরকারের এক মাস হয়ে যাওয়ার পরও কেন এখনো আইনের শাসনকে সক্রিয় করা যাচ্ছে না? সেজন্য আমাদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, সরকার কার্যকর হোক। এখন পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন জায়গায় আলাপ করে সরকার পর্যন্ত পৌঁছতে হচ্ছে। এমন যাতে না হয়। এ সরকার তো আমাদের আকাঙ্ক্ষার সরকার। আমাদের যে আকাঙ্ক্ষার জায়গা, সেটা যেন আমাদের বারবার বলে বলে করাতে না হয়। আর নারী-পুরুষ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের যাতে ইনসাফ নিশ্চত হয়। সে ইনসাফের ক্ষেত্রে আমি সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু ইত্যাদি পরিভাষা না এসে, আমি বাংলাদেশের একজন মানুষ, এ দেশের নাগরিক সে হিসেবেই আমার কথা শোনা হোক। এছাড়া নতুন বাংলাদেশের সব ধরনের আধিপত্য বাদ হওয়া দরকার। সেটা আওয়ামী লীগ হোক বা বিএনপি। আমরা যাদের হাতে এখন দেশটাকে অর্পণ করেছি, তারা বা পরবর্তী সময়ে যারা আসবে, কেউ যাতে কোনোভাবে ফ্যাসিজমকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ১৫-১৬ বছরের বেইনসাফি শাসন থেকে মুক্তি পেতে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী সবারই অংশগ্রহণ ছিল। সেজন্য সবাইকে ইনক্লুসিভ করে, সবার কথা শুনে যাতে একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি হয়, সে পদক্ষেপ নেয়া উচিত।


নাঈমা জান্নাত

রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট

সব মতের মানুষের একসঙ্গে কথা বলার পরিবেশ বজায় থাকুক

ন্যাশন বিল্ডিংয়ের প্রথম ধারণায়ই আসে ঐক্য। আগের সরকারেও একটা ঐক্য ছিল। তাদের মতের বাইরে কেউ গেলেই তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী ইত্যাদি ধারণা তৈরি করা হয়েছিল। আমরা যদি এখন জাতিগঠনের কথা বলি, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো কেমন হবে? আমরা কি আবার সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক ফিরে যাব নাকি আমাদের এখানে যে বিভিন্ন জাতিসত্তা রয়েছে, তাদের অধিকার দিয়ে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র হব, এ বিষয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।

আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমরা যে বিভিন্ন ধরনের ট্যাগিং বা দমনপীড়ন দেখেছি, সেগুলো ব্যবহার করে আবার যেন প্রতিহিংসার রাজনীতি আর ফিরে না আসে। আমরা চাই, গত সরকারের আমলে যে ধরনের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে, সেগুলোর বিচার হোক। এরপর আমরা সুস্থ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চাই। আমাদের সবারই স্বপ্ন একটি নতুন দেশ গড়া, আমাদের স্বপ্ন একই হলে পথ ভিন্ন কিংবা পন্থা ভিন্ন হতে পারে। এর পরও সবাই একসঙ্গে বসে কথা বলার এ পরিবেশটা যেন বজায় থাকে।


মাহমুদুল হাসান

বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম (বিডিএসএফ)

ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্র কায়েমে বিচার ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে

আমরা ন্যাশন বিল্ডিংয়ের কথা বলছি। ন্যাশন বিল্ড করতে হলে আমাদেরকে ইনস্টিটিউশন বিল্ড করতে হবে। ধরুন, আপনার অনেক টাকা আছে। আপনি অসুস্থ হলে বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করতে পারবেন। কিন্তু আপনার জমিজমার একটা মামলা দরকার বা আপনার কেউ অবিচারের শিকার হয়েছে, সেক্ষেত্রেতো আপনি বাইরের আদালতে গিয়ে বিচার দিতে পারবেন না। দেশের আদালতেই বিচার হতে হবে। বা আপনার কোনো পুলিশি সহায়তা দরকার। আপনিতো কোনো বেসরকারি পুলিশ দিয়ে কাজ করতে পারবেন না। আপনাকে রাষ্ট্রের কাছেই যেতে হবে। সুতরাং ন্যাশন বিল্ড করতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্র একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হলেও এটা মূলত তিনটা প্রধান বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আইন, বিচার ও শাসন বিভাগ। শুধু বিচার বিভাগের কথা বলতে গেলেই দেখা যাবে, গত ১৫-১৬ বছরে কত মায়ের কোল খালি হয়েছে, কত পরিবার অবিচারের শিকার হয়েছে, সেসব পরিবারের একটা রাত যে কত দীর্ঘ হয়, এটা একটু অনুধাবন করার চেষ্টা করলে বোঝা যাবে যে, বিচারব্যবস্থা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে হতে হবে ইনসাফপূর্ণ বাংলাদেশ। যেখানে স্বচ্চতা ও জবাবদিহিতা থাকবে। মনে করুন, বিচার বিভাগকে আপনি সংবিধানের রক্ষক বলবেন, কিন্তু সে বিচার বিভাগ সংবিধানের রক্ষক কীভাবে হবে? এখানে বিচারকদের নিয়োগ কীভাবে হচ্ছে বা তারা কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার করছে? তারা নিজেরাই যদি অগণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচার হয়, তাহলে তারা কীভাবে একটা গনতান্ত্রিক সংবিধানকে রক্ষা করবে? 

দ্বিতীয়ত আমরা ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের কথা বলি যে, আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশ। আগে যেমন কেউ কিছু বললেই তাকে জামাত-শিবির বা রাজাকার ট্যাগ দেয়া হতো। বাইনারির এ ব্যাপারটা এখনো রয়ে গেছে। এখন কেউ যৌক্তিক কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে আসলে আমরা বলি সে লীগ হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের যে নেতা শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে, কিংবা তার হাতে অবৈধ অস্ত্র আছে, এ বিষয়গুলো যদি আমরা পুনর্বিবেচনা না করি, তাহলেতো তারা আমাদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে থাকবে, তারাওতো আমাদের এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। এ বিষয়গুলোও আমাদেরকে ভাবতে হবে।

আরেকটা কথা আমি বলি, রুয়ান্ডাতে ১৯৯৪-এ গণহত্যা হয়েছিল। সেখানে ১০০ দিনে ৮ লাখের ওপর মানুষ মারা গিয়েছিল। তারপর গত ৩০ বছরে রুয়ান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরো অনেকগুলো দেশ যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেটা একটা মডেল হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কী কাজ করবে, সেটা যদি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের মতো করে চিন্তা করি, তাহলে মনে হয় না যে, এখানে সমাধান হবে। এখানে বসে এখানকার সমাধান এখানেই করতে হবে।


নাভিদ নওরোজ শাহ্

স্পিক বাংলাদেশ

গণমাধ্যম যেন ভিন্ন ন্যারেটিভ দাঁড় না করে

প্রথমেই বলি, আগামীর বাংলাদেশে কোনো মিডিয়া যেন ভিন্ন ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা না করে। উদাহরণস্বরূপ, গত ১০-১২ বছরে দেখেছি, কিছু গণমাধ্যম আওয়ামী লীগের কেউ অপরাধ করলে তাকে দুর্বৃত্ত হিসেবে প্রচার করে আর বিএনপির কেউ অপরাধ করলে তাকে বিএনপি বলে প্রচার করে। আমরা চাই দেশের মানুষ সত্যটা জানুক, সেটা বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা জামায়াত যে-ই হোক। ঘটনা যেটা সত্য, সেটাই যেন তারা প্রচার করে। কিংবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যেন শুধু শুধু ভারত বা অন্যান্য দেশকে দোষ দেয়া না হয় বা শত্রু বানানো না হয়। যেটা সত্য, সে ন্যারেটিভটাই যাতে প্রচার করা হয়।

দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়ের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে এরই মধ্যে ’২৪-এর ইতিহাস বিকৃতির বিভিন্ন চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা সবাই কিন্তু যার যার জায়গা থেকে গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছি। আমাকে কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেউ ফোন দেয়নি বা কেন্দ্রীয় কোনো সমন্বয়কের সঙ্গে আমার কিন্তু কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি এবং আমার বন্ধুরা নিজ উদ্যোগে গিয়েছি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। এভাবেই সবাই আন্দোলন করেছে, শুধু ছাত্ররা। এ আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে যখন সব পর্যায়ের চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী অংশগ্রহণ করেছে। এখানে কিন্তু সবারই একটা গল্প আছে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক আমরা ’৭১-এর নতুন ইতিহাস দেখেছি। আমরা জানি না যে ’৭১-এ কী হয়েছিল। আমরা চেষ্টা করব ’২৪-এর ইতিহাসটাকে যেন সংরক্ষণ করা হয় এবং যে যার জায়গা থেকে যেভাবে অংশগ্রহণ করেছি, সেটাই যেন আমরা প্রচার করি।

আরেকটা বিষয়, গত ১০-১৫ বছরে ধর্মনিরপেক্ষতার নাম দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ধর্মবিদ্বেষকে প্রচার করা হয়েছে। আমরা কেউ ধর্মবিদ্বেষী হতে চাই না। যে যে ধর্মের মানুষই হোক না কেন। আমাদের দেশে সংখ্যাগুরু নাম দিয়ে গত ১০-১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষগুলো। আমরা এর বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই। আবার নতুন বাংলাদেশে অনেকেই নিজেকে নিরাপদ মনে করছে না। এটা যেন না হয়। আমাদের সবার কথা শুনতে হবে। সবাই মিলেই বাংলাদেশ।


সারোয়ার তুষার

জুলাই গণপরিসর

বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে যতটুকু এগিয়েছে রাষ্ট্র ততটুকু এগিয়েছে 

রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে ছিল। ২০১৮ সালে যখন ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ হলো তখন ছাত্ররা বলেছিল যে রাষ্ট্র সংস্কার, রাষ্ট্র মেরামত ও রাষ্ট্র গঠন। এ টার্মগুলো সেই সময় থেকে এসেছে। এ আন্দোলন হঠাৎ করে হয়নি। এ আন্দোলনের পেছনে সমাজের প্রস্তুতি ছিল। বিভিন্ন স্টাডি সার্কেল ছিল, তাদেরও অনেক প্রস্তুতি ছিল। বুদ্বিবৃত্তিকভাবে সমাজ যতটুকু এগিয়েছে বাংলাদেশও ততটুকু এগিয়েছে। আমাদের একটা ‘পলিটিক্যাল কমিউনিটি’ হিসেবে দাঁড়াতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের যে শক্তি রয়েছে তা ধারণ করতে হবে। এসব থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দিল্লি বাংলাদেশকে ‘ওয়েস্ট ব্যাংক’ বানাতে চায়। ঈর্ষা, ইগো বাদ দিয়ে এক হতে হবে। এক না হলে ৫ আগস্টের পর থেকে দিল্লির যে আচরণ দেখা যাচ্ছে তা বাড়বে। অনেকেই আবার মুসলিম জাতিবাদ গঠন করতে চাইছে, এ ধরনের জাতিবাদী চিন্তা গঠিত হলে দেশের অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা দুশ্চিন্তায় থাকবে। আরেকটা বিষয় হলো, অনেকেই সংবিধান সংস্কারে কথা বলছেন! কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার পালানোর সঙ্গে সঙ্গে সে সংবিধানও রহিত হয়ে গেছে, নতুনভাবে সংবিধান লিখতে হবে। মূলনীতি কী হবে এ নিয়েও অনেক আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। আসলে মূলনীতির চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো মৌলিক অধিকার। সরকার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে কিনা সেদিকে নজর দিতে হবে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের কথা বলছে। আগে তো রাষ্ট্র হতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রের যে ভঙ্গুর অবস্থা তা মেরামত হওয়ার আগে নির্বাচন বেমানান।


জাহিদ আহসান

প্রাগ্

জুলাই বিপ্লবে অজ্ঞাত লাশ চিহ্নিত করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে

বাংলাদেশে যেন রাজনীতির পুরনো ধারা ফিরে না আসে। যারা জুলাই গণহত্যায় বিভিন্নভাবে সরকারকে সহায়তা করেছে কিংবা মৌন সমর্থন দিয়েছে তারা ফিরে আসছে বিভিন্নভাবে। তারা ফিরে আসা মানে এ দেশে রাজনীতির পুরনো ধারা ফিরে আসা। এটা বন্ধ করতে হবে। নতুন বাংলাদেশে সংস্কৃতির ভাব ও ভাষা কেমন হবে তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কবিতা, সিনেমা কিংবা অন্যান্য সাহিত্যের ভাব ও ভাষাকে নতুন রূপ দিতে হবে। আরেকটা বিষয়ে গুরুত্ব দেব, সেটা হলো সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। যে কৃষক মাঠে ঘাম জড়িয়ে ফসল উৎপাদন করেছেন সে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। কৃষকের অল্প দামের শাকসবজি ঢাকায় এসে হয়ে যায় অনেক বেশি। কৃষক মাঠে কাজ করেন আর মধ্যস্বত্বভোগীরা কিছু না করে টাকা নিয়ে যায়। এটা বন্ধ করতে হবে। আমি কয়েকদিন আগে রায়েরবাজার গিয়েছিলাম, যেখানে গণকবর দেয়া হয়েছিল। ওখানে দায়িত্বে থাকা একজনের কাছে জিজ্ঞেস করেছি, লিস্ট আছে কিনা, তিনি সরাসরি উত্তর দিলেন নেই। অজ্ঞাতনামা লাশগুলো শনাক্ত করা হোক। এখনো অনেক পরিবার আছে যার সন্তান আন্দোলনে গিয়েছিলেন কিন্তু এখনো ফিরে আসেননি। মা অপেক্ষায় আছেন। লাশগুলো ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে হলেও শনাক্ত করে মা-বাবাকে জানানো হোক। যাতে অন্তত সন্তানের কবর জেয়ারত করতে পারেন।


মোহাম্মদ রোমেল

ভাববৈঠকী

রাষ্ট্রের ক্ষমতা যেন জনগণের হাতেই থাকে

গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষ একটা ইলিউশনের মধ্যে আছে। সবাই ভাবছে, ক্ষমতা এখন জনগণের হাতে এসেছে। আমরা গণ-অভ্যুত্থান করেছি। কিন্তু ক্ষমতা কি আদৌ আমাদের হাতে এসেছে? যারা এখন ক্ষমতায় বসেছে তারা কি গণ-অভ্যুত্থানে রক্ত দেয়া মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পেরেছে? ৫ আগস্ট আমরা এক দখলদার বাহিনীর সরকার থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। সরকার চলে গেলেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে একদম অধঃস্তন জায়গা পর্যন্ত আমলা থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রয়ে গেছেন। যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে সরকার-বিশ্বস্ততার ওপর নির্ভর করে। এ জটিল বিষয়ে নতুন সরকার কীভাবে কাজ করবে তা সমাধান করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া মানুষের দরকার ক্ষমতা তাদের হাতে রাখা, পুরোপুরি সরকারকে না দেয়া। সরকার যদি মানুষের কথা না শুনে তাদের আবার উচ্ছেদ করা যাবে এমন ক্ষমতা ও চিন্তা মানুষের মধ্যে রাখতে হবে।


মো. জহির উদদীন সোহাগ

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন

রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে দার্শনিক মতবাদ নয়

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। যেখান আমরা সংবিধানসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করি। এসব আলোচনা সে সময় প্রকাশ্যে করা কঠিন ছিল। আমরা এখন গোলটেবিলে বসে এসব আলাপ-আলোচনা করছি, যার দ্বারা সবাই সবার কথা শুনতে পারছে। সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে বড় একটা সমস্যার জায়গা দেখতে পাই। যুদ্ধের আগেও যে মূলনীতি ছিল তিনটি, নয় মাস পর তা পরিবর্তিত হয়ে চারটি হয়েছে। এমনকি সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেসব মূলনীতি তুলে ধরে নির্বাচন করেছিল পরে তা তারা সরিয়ে দিয়েছে। মওলানা ভাসানী এ কথাই বলতে চেয়েছিলেন, যে সংবিধান রচিত হচ্ছে সেখানে মানুষের মতামত নেয়া হবে না কেন? সংবিধান এমনভাবে রচিত হবে, শুধু দার্শনিক মতবাদকে প্রাধান্য দিয়ে নয়, বরং প্রাধান্য দিতে হবে গণমানুষের মতামতকে। শুধু দার্শনিক মতবাদ সংবিধানের মূলনীতি হলে তা মানুষের মাঝে যথাযথ কাজ করে না। সংবিধানের এখন যে মূলনীতিগুলো রয়েছে তা দিয়ে শুধু বিভাজন তৈরি হচ্ছে। এমন সংবিধান চাই, যেখানে গণমানুষের মূল্য থাকবে।


আব্দুল্লাহ যোবায়ের

বাংলাদেশ ইনিশিয়েটিভ ফর পলিসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইপিডি)

রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গনে পরিবর্তন আনতে হবে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৌলিক কাজ করতে হবে তিনটি ক্ষেত্রে। এ তিন ক্ষেত্র হলো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক। রাজনীতির কথা যদি বলি, এ বাংলার ভূখণ্ডে মোট পাঁচটি বড় পরিবর্তন হয়েছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে তিনটি সূত্র পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও গণতন্ত্র। এ তিন অধিকারের জন্য মানুষ ১৯০৫, ১৯১১, ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সালে লড়াই করেছে। আফসোসের বিষয় হলো আমরা এ তিনটি জিনিসের বাস্তবায়ন এখনো দেখতে পাইনি। যদি আমরা বিপ্লব সূত্রগুলোকে চিহ্নিত করতে না পারি এবং সে জায়গায় মূল কাজগুলো করতে ব্যর্থ হই তাহলে ৫০ বছর পর আবার আমাদের আরেকটি বিপ্লব করতে হবে। আবার আবু সাঈদের মতো তরুণকে প্রাণ দিতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের কাউকে যেন প্রাণ দিতে না হয়। আমরা যে বিপ্লব পেয়েছি এর মাধ্যমে যেন নতুন বাংলাদেশ গড়ে ওঠে। এ সংবিধান বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। নতুনভাবে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। সাংস্কৃতিক পরিবর্তন খুব প্রয়োজন। এমন সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হোক, যেন একই জায়গায় কাওয়ালি, জারি, মুর্শিদি গান গাইতে পারে। কাউকে যেন বাধা দেয়া না হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখেছি, কোরআন পাঠে বাধা দেয়া হয়েছিল, সেটার রিপিটেশন যেন না হয়। যার সংস্কৃতি সে যেন পালন করতে পারে। আমাদের দেশের তরুণদের শক্তি আছে, মেধা আছে। এসব যেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হয়। সবাইকে নিয়ে যেন সবার বাংলাদেশ গঠিত হয়।


পুন্যতা ন্যান্সি

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

আমি যেহেতু আইন বিভাগের শিক্ষার্থী তাই আইনের ভাষায় বলতে চাই। বাংলাদেশকে এমন এক দেশ হিসেবে দেখতে চাই, যেখানে মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষিত থাকবে এবং আমাদের দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে। আগের সরকার কেন কোনো বাধা ছাড়া অন্যায়-অপকর্ম করতে পেরেছে, সেদিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, আইনের শাসনকে তারা পুরোপুরি বিলুপ্তির দিকে নিয়ে গেছে। আমি মনে করি, একটি সুন্দর রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রথমত, যেটা প্রয়োজন সেটা হলো জুডিশিয়াল যে সিস্টেমটা আছে সে সিস্টেমকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হবে। সংবিধান সংস্কারের অনেক কথাই বলা হয়েছে। আমি চাই, সংবিধান হবে জনগণের জন্য। সংবিধান যেন জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া না হয়। এছাড়া একটা বিষয় লক্ষণীয়, একটা দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও অনেক প্রকাশ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যেন সংস্কার হয়। নতুন বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। এ রাষ্ট্রে যেন সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং নিজের মতামত জানাতে পারে। একজন অ্যানিমেল। অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে আমি আরেকটা কথা বলতে চাই, আমরা সামনে যে বাংলাদেশ দেখতে চাই, সে দেশে যেন অ্যানিমেলদের খাবার, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। জনগণের পাশাপাশি যেন প্রাণীরাও সুস্থভাবে এ দেশে বাস করতে পারে।


সাব্বিব বিন সাত্তার

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সীমান্ত হত্যা বন্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে

আমরা ‘ন্যাশন বিল্ডিং’য়ের আলাপ-আলোচনা করছি, কিন্তু ‘ন্যাশন’ থাকে কোথায়? এটা থাকে তো একটি রাষ্ট্রের মধ্যে। আর এ রাষ্ট্র ন্যাশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। মানুষ স্বাধীনচেতা প্রাণী। মানুষের মধ্যে স্বাধীনচেতা ভাব আছে, প্রবৃত্তি আছে এবং চিন্তাশক্তিও আছে। মোটা দাগে একেকটা রাষ্ট্র যেন একেকটা পাড়ার মাস্তান, যাদের সীমারেখা টানা। যদি সীমারেখা লঙ্ঘন হয় তখন কিন্তু বিভিন্ন পাড়ার মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পরই দুজন শিশু সীমান্তে হত্যা হয়েছে। জয়ন্ত কুমার ও ঝর্ণা দাসকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সীমান্তে হত্যা ঠেকাতে আমাদের রাষ্ট্রের ভূমিকা কই? অনেকেই অনেক কিছু চাচ্ছেন; ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি এত কিছু চাই না। অতটুকু চাই, কেউ আমার সীমানায় ঢুকে আমার নাগরিককে হত্যা করবে না।



সৈয়দা রাইদা তাসনিম রিদি

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

সবাই বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করেছেন। তবে আমি গুরুত্ব দিতে চাই আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি। তাদের নিয়ে কথা হয়নি। গত বছর আমার পরিবারের সঙ্গে আমি রাঙ্গামাটি যাই, সেখানে আদিবাসীদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, পাহাড়ে মৌলিক অধিকার একেবারে শূন্যের কাছাকাছি। হাসপাতাল ও বিদ্যালয় আছে মাঝে মাঝে, যা খুবই অপ্রতুল। পাহাড়ে আদিবাসীদের এমন অবস্থা হয় যে তারা যদি নিত্যদিনের বাজারও কিনতে যায় সেনাবাহিনীর অনুমতি নিতে হয়। আমি চাই পাহাড়ের সমস্যাগুলোও মিডিয়ার মাধ্যমে উঠে আসুক, যেভাবে দেশের সমস্যাগুলো উঠে আসছে এবং পাহাড়িরা নিজেদের অধিকার অর্জন করুক।



সাবিকুন নাহার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রান্তিক পর্যায় থেকে সবকিছু শুরু করতে হবে

কয়েক দিন আগে আমি এক সংগঠনের হয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছি। একবার এক রিকশাওয়ালার কাছে জিজ্ঞেস করেছি, ট্যাক্স নিয়ে জানেন কিনা? অজান্তে ট্যাক্স দিচ্ছে, কিন্তু এ ব্যাপারে সে জানে না। এ গোলটেবিল বৈঠকে সবাই জ্ঞানী মানুষ উপস্থিত হয়েছেন, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ নিজেদের ব্যাপারে সচেতন না। তারা জানেই না, তাদের একটা ভোটে রাষ্ট্রের সরকার নিযুক্ত হয়। আরেকটা বিষয় হলো অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার ৪০ দিন পেরিয়ে গেলেও ‘শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠিত হয়নি। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ক্লাসরুমে দেখতে পাই, শিক্ষকেরা পাশ্চাত্যের জ্ঞানের পুনরুৎপাদন করেন। অথচ আমাদের দেশের মধ্যে অনেক ভালো ভালো উদাহরণ লুকিয়ে থাকে। এসব বিষয় সংস্কার করতে এবং গুরুত্ব দিতে হবে।


মো. আজাহার উদ্দিন অনিক

সদস্য, জাতীয় নাগরিক কমিটি

মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

এতদিন পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্র পরিপূর্ণভাবে কাজ করেনি, এর প্রধান কারণ হচ্ছে অনেকদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করেনি। এর মধ্যে সাংবাদিকতাও ভালোভাবে কাজ করেনি। ৫ আগস্টের আগে সরকারের বিভিন্ন সেক্টরের দুর্নীতির সংবাদ হয়নি কিন্তু ৫ আগস্টের পর দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এসব তথ্য একদিনে বা এক মাসে পাওয়া সম্ভব না। দীর্ঘদিন ধরে এসব তথ্য সাংবাদিকদের কাছে ছিল কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনি। কাদের প্রেশারে এই সংবাদ প্রকাশ করা সম্ভব হয় নাই তা চিহ্নিত করতে হবে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। 

সংবিধান নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন, তবে আমি জোর দিব সংবিধান যেন মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করে। সংবিধানের মূল ভিত্তির জায়গায় সিভিল লিবার্টি আর মানবাধিকার রাখলে হয়ত রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্র এবং আইনে তার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হবে। আইন এবং সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি রাষ্ট্র এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে সাধারণ মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, কারণ মানুষ তার নিজের অধিকার কী কী তা পরিষ্কার ভাবে জানলেই শুধু সে নিজের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হতে পারবে।


আলাউদ্দীন মোহাম্মদ

সদস্য, জাতীয় নাগরিক কমিটি

বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন ‘দ্য গ্রেট বাংলাদেশী ড্রিম’

আজ যখন একসঙ্গে বসে সবাই কথা বলছি তখন বারবার ভাবছি, এক হাজার শহীদ যদি একটি জায়গায় ধারণ করা হয় কত বড় জায়গার প্রয়োজন হবে একবার ভাবুন? এ শহীদরা যে আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ গড়তে আত্মদান করেছেন সে আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ কেমন হবে? আজকের আলোচনার টাইটেলে যে বাংলাদেশের গতিমুখের কথা বলা হয়েছে সে প্রেক্ষাপটে আমাদের তাকাতে হবে এ জনপদের মানুষের তিন হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার দিকে। সে সভ্যতায় আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের বয়স অনেক অল্প, এবং একই প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান। কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষের একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে তাদের অবস্থান নিয়ে আমি খুব উচ্ছ্বসিত। তাই আমি বলব আমেরিকার গ্রেট আমেরিকান ড্রিমের মতো বাংলাদেশীদেরও একটি গ্রেট বাংলাদেশী ড্রিম তৈরি করতে হবে। যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য অনুপ্রেরণা, সারা বিশ্বের অন্য সব মানুষের কেন্দ্রস্থল হবে আমাদের শহরগুলো। আমাদের শহরগুলোকে একটি নতুন সভ্যতার ভিশনের আলোকে সাজাতে হবে। এমন স্বপ্ন যদি আমরা সত্যি সত্যি ধারণ করতে পারি এবং ভাবতে পারি আগামী একশ বছর পর কোনদিকে যাবে আমাদের মানুষের জীবনযাত্রা তাহলে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির দিকে এগোবে। সে স্বপ্নের আলোকে কাজ করার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।



আসলাম বেগ সায়েম

বাংলাদেশ ডায়ালগ

অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে

আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সব ধরনের চিন্তার মানুষেরা একসঙ্গে বসেছি। যেটা দুই মাস আগেও সম্ভব ছিল না। আমি একটা কথা বলতে চাই, শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক অর্থনীতির ধস জুলাই বিপ্লবকে গণমানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনীতি একটি দেশের মেরুদণ্ড। করোনার পর বাংলাদেশের রিজার্ভ দাঁড়িয়ে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এর পর থেকে রিজার্ভ হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে। এ কারণে গণ-অসন্তোষ বেড়ে চলেছিল। এ অসন্তোষ বিস্ফোরিত হয় জুলাই বিপ্লবে। আমরা ’৭১-এ স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু ’২৪-এ এসে আমরা ‘ন্যাশন বিল্ডিং’-এর কথা তুলছি। আমরা এর মাঝেও ন্যাশন বিল্ডিং নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু হয়নি। এখন এর রিবিল্ডিং করতে হবে। ন্যাশন বিল্ডিংয়ের কথা বলতে গেলে অবশ্যই অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে হবে। ন্যাশন রিবিল্ডিংয়ের পাশাপাশি বাজারও রিবিল্ডিং করতে হবে। এ দুটো বিষয় একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কিত। এ আন্দোলন ছিল মোটাদাগে অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন।


সারজানা আক্তার লিমানা

বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

ট্যাগিং রাজনীতি বন্ধ করে অধিকার নিশ্চিত করতে হবে 

আমাদের দেশের অবস্থা হয়েছে এমন—সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দিব কোথা! আমাদের সব বিষয় নিয়ে কথা বলে যেতে হবে। কিছুদিন আগে আমরা দেখেছিলাম আনসার সদস্যরা তাদের চাকরি সরকারি করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। অনেকেই তাদের আনসার লীগ বলে ট্যাগিং করেছেন। আবার অনেকেই বলেছেন, সবকিছু জেনেই তো তারা চুক্তিভিত্তিক চাকরি নিয়েছে তাহলে তারা কেন এখন সরকারীকরণের দাবি জানাচ্ছেন! এতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্র নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি, তাই তারা বাধ্য হয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে গিয়েছে। নতুন বাংলাদেশে আমি চাই, এ ট্যাগিং রাজনীতি থেকে আমাদের দূরে সরে আসতে হবে এবং যেকোনো সমস্যার মূল চিহ্নিত করতে হবে। এছাড়া সরকারের পরিবর্তন হলেও খেটে খাওয়া মানুষের জীবনমানের কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। তারা এখনো জনবিচ্ছিন্ন। গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যতদিন হবে না ততদিন পর্যন্ত গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে না। এ আন্দোলনে আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল, নারীদের অংশগ্রহণ। কিন্তু এখন দেখা যায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া নারী সমন্বয়কদেরও একপেশে করে ফেলা হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বৈষম্য হলে এ আন্দোলনের স্পিরিট ব্যাহত হবে।


ফয়সাল আহাম্মদ

বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও সংস্কৃতি গঠনে গুরুত্ব দিতে হবে

দুর্নীতি জালের মতো সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আমরা আর কাউকে বিশ্বাস করতে চাই না। জনগণের মাঝে এ মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু  কার কাছে জবাবদিহি করব? যার কাছে জবাবদিহির ক্ষমতা যায় সে-ই ভূতে পরিণত হয়। সাংস্কৃতিক পরিগঠন (কালচারাল বিল্ডআপ) ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু তা সহনশীল হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কাওয়ালি চর্চা হচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু মাদ্রাসাগুলোয় লালনের চর্চার কথা বললে আমি বাধার সম্মুখীন হতে পারি। 

৫ আগস্টের পর থেকে আমি রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্র পড়ছিলাম। চমৎকার গঠনতন্ত্র সব! পড়ে মনে হলো যে কেউ গঠনতন্ত্রগুলো পড়লে ওই দলে যুক্ত হতে ব্যাকুল হয়ে পড়বেন, যদি একান্তই আদর্শিক দ্বন্দ্ব না থাকে। কিন্তু কোনো দলই পরিপূর্ণভাবে ধারাগুলো অনুসরণ করে না। বরং আমরা রাজনীতিতে যুক্ত হই কিছু আয় করতে। আর এ আয়ের মাধ্যম নৈতিকভাবে চিন্তা করা হয় না। বিশেষ করে ছাত্রনেতারাও একইভাবে চিন্তা করে। এ দীর্ঘদিনের প্র্যাকটিস থেকে পরে আর বের হতে পারে না। এ বিষয়গুলো পরিবর্তন করতে হবে। এটা আইন করে একদিনে সম্ভব না। আইনকে ধারণ করতে হবে। মননে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের অনেক আইন আছে কিন্তু সেটা আমাদের চর্চা করতে হবে।


সুলতানা জেসমিন জুঁই

সাবেক সহসভাপতি ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ

সম্ভাবনাময় জনমিতিক লভ্যাংশের সঠিক ব্যবহার চাই

২০০৮ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এক্সট্রিম ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্যে বসবাস করছে। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি, সর্বোচ্চ শতকরা ৬৭ ভাগ। ২০২৪ সালে এসে এখনো ৬৫% ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড রয়েছে। জনসংখ্যার এ কর্মক্ষম অংশের পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ এগিয়ে গেছে। এগিয়ে যাচ্ছে চায়নার মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের এ শক্তি তরুণরা,  যারা অদক্ষতা ও বেকারত্বের মতো নানাবিধ সমস্যা নিয়ে এরই মধ্যে এ লভ্যাংশের ২% হারিয়ে ফেলেছে। বাকিদের দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়েও আন্তরিক কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা নেই, দিন যত যাবে এ সুযোগ তত হারাতে থাকবে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ছাড়া ২০৫০ সালের পর দেশে পরনির্ভরশীল বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং তাদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই আমাদের কিছু করার থাকবে না। 

জাতি গঠনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইলে আমাদের দরকার টাকা, সময় ও জনশক্তি। আমাদের ছোট্ট দেশ কিন্তু অনেক বেশি জনগোষ্ঠী। প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের এ যুগে অর্থ আমার কাছে প্রধান সমস্যা বলে মনে হয় না। বরং এ সময়টা আইডিয়ার। সরকারের কারিগরি সহযোগিতা ও সদিচ্ছা পেলে আমরা তরুণরাই দেশকে পুনর্নির্মাণ করতে পারব।


মো. নিজাম উদ্দিন

সহসভাপতি, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ

তরুণদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে

১৯৭১, ১৯৯০ কিংবা ২০২৪—ইতিহাসে কখনই কোন একটি বিশেষ জাতিকে প্রাধান্য দিতে সংগ্রাম করা হয়নি। আমরা ৫ আগস্টের পরবর্তী বিভাজন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু একটি সফল বিপ্লবের পর বিভাজন মারাত্মক খারাপ লক্ষণ। বিপ্লবে অংশ নেয়া সব শ্রেণী-পেশার মানুষের স্পিরিট যদি আমরা ধারণ করতে না পারি, তবে আমরা পুরোপুরি ব্যর্থ হব। এদেশের ২৫-৩০টি রাজনৈতিক দল গত ১৫ বছর অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ফাঁসির মঞ্চে ঝুলেছেন অনেক নিরপরাধ রাজনৈতিক নেতা। এভাবে দেড় যুগেরও অধিক সময়ের পরিশ্রমে একটি চারাগাছকে বড় করে তুলেছে ওই রাজনৈতিক দলগুলো। আর জুলাই-আগস্টে দেশের সব মানুষের প্রচেষ্টায় সেই গাছে গোলাপ ফুল ফুটেছে। সুতরাং কারোরই অবদান অস্বীকার করা যাবে না। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে জামায়াত-বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের বাইরেও কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশগ্রহণ করেছে। সুতরাং একক কৃতিত্বের দাবি করা বোকামি। এটা বাংলাদেশের মানুষের লড়াই। কেউ নেতৃত্ব দিয়েছে, কেউ জীবন দিয়েছে—সবাই এক!

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে তরুণরা কাজ করেছিল, রাষ্ট্র কিংবা জাতি গঠনে তাদের যুক্ত করা হয়নি। রাষ্ট্রগঠনে তরুণদের কাজে লাগাতে হবে।


দিদারুল ভূঁইয়া

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন

বিপ্লবের একটা সর্বোত্তম প্রাপ্তি হতে পারে নতুন সংবিধান

সম্ভাবনার সঙ্গে কিছু নিরাশাও রয়েছে আমাদের মাঝে। অভ্যুত্থানে হতাহতদের কাছে রাষ্ট্র এখনো পৌঁছতে পারেনি। রিকগনিশন, রিয়ালাইজেশনকে এড়িয়ে চললে রিকনসিলিয়েশন কাজ করবে না। আমরা আইন সংস্কারের কথা বলছি। রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান সংস্কারের কথা বলছি। কিন্তু আইন প্রয়োগেরও একটি আইন আছে। আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রদলের কেউ ধর্ষক থাকে না। আবার বিএনপির আমলে ছাত্রলীগের কেউ ধর্ষণ, দুর্নীতি, পাচার করে না। অর্থাৎ বিরোধী দলে থাকলে সবাই ভদ্র হয়ে যায়। বাংলাদেশে প্রায় সব অপরাধ সবসময় ক্ষমতাসীনরা করে। এর কারণ যখন যে ক্ষমতায় থাকে তখন সে আইনের ঊর্ধ্বে থাকে।

অন্তর্বর্তীমূলক মনোভাব যদি সবার মধ্যে না আসে এবং এখনো যদি চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা থাকে, তাহলে সিস্টেম কাজ করবে না। গত ৪০ দিনে কি আমরা এ সরকারের জবাবদিহিতার কোনো মেকানিজম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি? সরকারের জবাবদিহিতার জন্যই তো আমরা যুদ্ধটা করেছি। কিন্তু সরকারের মধ্যে তা দেখা যায়নি। উল্টো বৃহত্তর সরকারের মধ্যে এক্সক্লুসিভনেস দেখা যাচ্ছে। সংবিধান সংশোধন এবং পুনর্লিখন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। এখানে একে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা দেখা যায়। বিপ্লবের একটা সর্বোত্তম প্রাপ্তি হতে পারে নতুন সংবিধান। কিন্তু কী মূল্যে, কত সময়ে আমরা তা পেতে পারি, সেই বিবেচনাও জরুরি। অনেকে আমেরিকা, ব্রিটেনের উদাহরণ দেন। আমি মনে করি নেপাল আমাদের জন্য বেশি প্রাসঙ্গিক। তারা কিন্তু আজকে ১০ বছর ধরে চেষ্টা করেও নতুন সংবিধানের ফয়সালা করতে পারে নাই। এত সময় আমাদের হাতে নেই।


আব্দুল্লাহ মাসুদ 

বোধিবৃক্ষ

বাংলাদেশের গতিমুখটা আসলে কোন দিকে

গত ৫ আগস্টের পর বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। এটা এতটাই এলোমেলো যে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বাংলাদেশে গতিমুখটা আসলে কোন দিকে। ১৯৪৭ ও ১৯৭০ সালের মতো প্রতিটি বড় সংকটের পর মানুষের মাঝে দ্বিধাদ্বন্দ্বের জন্ম হয়েছে। এবারো তাই হয়েছে। আমাদের মধ্যে ধর্ম ও ভাষাভিত্তিক জাতিবাদের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ জাতিবাদের দিকে না গিয়ে একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় গড়ে তোলা দরকার। আমাদের দরকার সিস্টেম্যাটিক একটি পরিবর্তন, যা রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্র আর জাতি এক বিষয় না। রাষ্ট্র হলো তত্ত্বগত অবকাঠামোর কৌশলগত একটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান থাকে। আর সেই রাষ্ট্রে পৌঁছাতে একটি ভিত্তি দরকার। ন্যাশন-বিল্ডিংয়ের জন্য একটি লম্বা সময় দরকার। এখন আলোচনার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এটাকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে চিন্তা করা দরকার।



সালেহ উদ্দিন সিফাত

স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (স্যাট)

বাংলাদেশ প্রশ্নে এক হতে হবে

পলিটিক্যাল কমিউনিটির কথা আলোচিত হয়েছে। এটা ‘দুনিয়া কাঁপানো ৩৬ দিনে’ গড়ে ওঠেনি বলে আমি মনে করি। এটাতে দীর্ঘ ১৫ বছরের সিলসিলা আছে। সে ইতিহাসকে ভুলে গেলে আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলোকে ভুলে যাব। আর সেটা ভুলে গেলে আমরা ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামকে টিকিয়ে রাখতে পারব না। এরই মধ্যে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সম্প্রদায়কে বহাল রাখতে অন্তর্ভুক্তিমূলক চিন্তা দরকার। এ অন্তর্ভুক্তির ভিত্তি হওয়া উচিত সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইট এবং বাংলাদেশ প্রশ্ন। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে এ দুই ভিত্তির ওপর ভর করেই সব মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। পাশের দেশের রাজনৈতিক কমিউনিটির কাছে ভারত প্রশ্নে সবাই এক। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একমত না। এটা দূর করতে হবে।

সংবিধান সংস্কার নিয়ে এখানে কথা হচ্ছে। কিন্তু সংবিধানে আমরা যে সংশোধনগুলো আনতে চাই, সেগুলো হলো স্রেফ পজিটিভিস্ট অ্যাপ্রোচ। রাষ্ট্র এই করবে সেই করবে। কিন্তু রাষ্ট্রের সামগ্রিক কাঠামোয় ভ্যালুজ, ইথোস, মূল্যবোধ হিসেবে ‘মানবাধিকার’ প্রত্যয়টি যুক্ত কিনা এটা দেখা জরুরি।


সাইমুন নাহার

মঙ্গলবারের গপ্পোসপ্পো

রাষ্ট্রকে সবার জন্য হতে হবে

আমাদের দেশে নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ রয়েছে। জাতি গঠন বলতে আমরা যদি তাদের সবার মধ্যে একটি ঐক্য গঠন করতে পারি। এটা নিশ্চিত করতে পারি যে সবার মধ্যে একটি সুসম্পর্ক, সাম্য, সমানাধিকার বজায় থাকবে। সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে, তাহলেই হয়তো আমরা একটি সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হব। সব মানুষ যখন বুঝতে পারবে যে নাগরিক হিসেবে সবার সমান একটি অংশগ্রহণ আছে, তখন সবাই রাষ্ট্রকে নিজের মনে করতে পারবে। এভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে রাষ্ট্রকে সবার জন্য হতে হবে।




আরিফ বিল্লাহ

গণঅধিকার পরিষদ

পার্বত্য জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটাতে হবে

পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে বড় সমস্যা চিকিৎসা, শিক্ষা, অর্থনীতি ও যাতায়াত ব্যবস্থা। একজন গর্ভবতী মাকে যদি সেখান থেকে আনতে হয় তাহলে প্রায় একদিন লেগে যায়। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু সেখানে দক্ষ শিক্ষকের সংকট রয়েছে, ভালো চিকিৎসক নেই। আবার কোনো সরকারি কর্মকর্তা সেসব অঞ্চলে যেতে চান না। এখানে শুধু সেনাদের কিছু সহযোগিতা পাওয়া যায়। তাদের জীবনমান উন্নত করতে হবে।




সৈকত আরিফ

ছাত্র ফেডারেশন

অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে হবে

নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বারবারই আসছে, আমরা যে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ অবস্থানে এসেছি। আমরা চাইলে সব সমস্যার সমাধান এ মুহূর্তে করতে পারব না। প্রথমত, এ দেশে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করা দরকার। কেননা, এখানে পাঁচ বছর পরপর স্বচ্ছ ভোট হতো না। রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা ছিল না। এজন্য যে যে সংস্কার দরকার তার সবই করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছে সেসব সম্পন্ন করতে চাইলে অনেক বেশি সময় লাগবে। সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক সম্পর্কের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে অনেক বেশি সময় লাগবে। নতুন সংবিধান তৈরির বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। ’৭২-এ সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল ’৭০-এর নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া অনেক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী সেখানে ছিল না। কেননা, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছিল একক সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে সংবিধান আওয়ামী লীগের একক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে ছাত্রনেতারা সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করছে। 


শরীফ উসমান বিন হাদি

ইনকিলাব মঞ্চ

স্লোগান গুমকারীরা নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে বাধা

এ গুমের কথা বলছি। এটা কি শুধু ফ্যাসিস্ট হাসিনা করেছে। এটা তো একটা ঐতিহ্য হয়ে গেছে। যেসব গ্রাফিতি আমাদের বাচ্চারা করল সেগুলোকে অনেকে অশ্লীল, ভালো শোনা যায় না বলে সমালোচনা শুরু হলো। এ শ্লীলতার নামে আমাদের গ্রাফিতিগুলো গুম করে দেয়া হলো। এ সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। আমাদের স্লোগান ছিল ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’—এটা বলতে আমাদের এত লজ্জা কেন? সুন্দর শব্দ দিয়ে, সুন্দর কথা দিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদ নামাতে পারিনি, পারছিলাম না। আমাদের বাচ্চাগুলো মিছিলে যখন সবচেয়ে বাজে শব্দগুলো ব্যবহার করল, তখনই ফ্যাসিবাদ বিদায় হলো। সুতরাং এ শব্দগুলো তো আমাদের মহাকাব্য। এ শব্দগুলোকে মুছে দেয় কারা। সুতরাং আমি মনে করি যারা আমাদের লেখাগুলো মুছে দেয়, আমাদের স্লোগানগুলো গুম করে, তারাই আমাদের নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে বাধা। তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে বিরাজনীতিকীকরণের চিন্তা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমরা সবাই তো একই ব্যানারে যুক্ত হয়েছি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বলতে চাই—এ আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ কয়জন? এ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ধরে ছিঁড়ে ফেলবে। বারবার ছাত্রদের আন্দোলন বলছেন। আমি যদি প্রশ্ন করি এ আন্দোলনে নিহত ছাত্র কয়জন আর সাধারণ মানুষ কয়জন? দেখা যাবে সাধারণ মানুষই বেশি। সুতরাং আমাদের দাবি ছাত্রদের ডাকে সাড়া দিয়ে যেসব মানুষ জীবন দিয়ে আন্দোলন করেছেন, তাদের ক্ষমতায়িত করতে হবে। তবেই এ অভ্যুত্থান সফল হবে।


আসিফ উদ্দিন

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সচ্ছল ও মধ্যবিত্তদের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে হবে

এ আন্দোলনে হতাহতদের নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু যারা মানসিকভাবে আহত হয়েছেন তাদের নিয়ে কথা বলতে শুনছি না। তারা মারাত্মকভাবে ট্রমাটাইজড। যারা ভিশন হারিয়েছে তারা সুইসাইডাল। সুতরাং এ মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের জন্য আমাদের পদক্ষেপ কী? তাদের জন্য সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে? যদি ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমে সিলেবাস দেখা যায়, তাহলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আমি মনে করি শিক্ষা যদি সমানভাবে না এগোয় জাতি কখনই সমানভাবে এগোবে না। পুলিশের ওপর সরকার এখনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। একটি রাস্তার নাম ‘শহীদ ফেলানি’ করায় পুলিশ বাধা দেয়। অন্য শহীদদের নিয়ে সড়ক কিংবা সরণির নাম দিলে তো বাধা আসে না! আমরা যারা সচ্ছল ও মধ্যবিত্ত তারা রাজনৈতিক আলোচনা থেকে দূরে থাকতে চাই। অর্থনীতি ও রাজনীতি যে প্যারালাল সেটা আমরা চিন্তা করি না। এ দুই শ্রেণী যখন রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে শুরু করবে, তখনই পরিবর্তন সম্ভব।


দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

সম্পাদক ও প্রকাশক বণিক বার্তা

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও ন্যাশন-বিল্ডিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ

ন্যাশন-বিল্ডিং একটা বিবর্তনশীল ধারণা। আগের মতো জাতি-গোষ্ঠী ধারণার মধ্যে আর নেই। ন্যাশন-বিল্ডিং বলতে বোঝায় বিশ্ব পরিমণ্ডলে কোনো রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের অবস্থান কেমন তার ওপর। এর কিছু পরিমাপকও আছে; আপনার পাসপোর্ট কত শক্তিশালী, আপনার মুদ্রার মান কেমন, আপনার দেশে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান কতটুকু ইত্যাদি।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রয়োজনীয় ব্যয় করে আপনি আপনার জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে পেরেছেন কিনা, দেশে মানবাধিকার ও আইনের শাসন কতটুকু সুপ্রতিষ্ঠিত তাও বিবেচ্য বিষয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও ন্যাশন-বিল্ডিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিগত সময়ে সাংবাদিকতা নিয়ে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। তার পরও অনেক বিষয় আপনারা গণমাধ্যমেই জেনেছেন। যেমন হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংক কেলেঙ্কারি। আপনারা যে কথাগুলো বলছেন তারা অধিকাংশই কিন্তু গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছেন। আপনাদের মতো গত ১৫ বছরে অনেক গণমাধ্যমকর্মী নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এমনকি গণ-অভ্যুত্থানকালেও অনেক মিডিয়া হাউজ সংগ্রাম করেছে। অনেকে রাতে বাসায় ফিরতে পারেননি। অনেকে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, শহীদ হয়েছেন।

কোনো কিছুই তো আসলে পারফেক্ট না। আপনারা নিজেরাও তো প্রশ্ন তুলছেন যে আন্দোলনের পরে ভিন্নমত তৈরি হয়েছে, ভিন্ন চিন্তা আসছে। কিন্তু এই যে সবাই একসঙ্গে বসে কথা বলা। নতুন নতুন চিন্তা নিয়ে আসা। নিজেদের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করা। এগুলো খুব জরুরি। বণিক বার্তার এ মতবিনিময় সভায় উপস্থিত হওয়া এবং আপনাদের মহামূল্যবান মতামতগুলো উপস্থাপনের জন্য অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন