মানুষের কষ্টগুলো সহনীয় পর্যায়ে আনতে দৃশ্যমান উদ্যোগ নিন

ছবি : বণিক বার্তা

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ। টেকসই উন্নয়ন ও অবকাঠামোবিষয়ক প্রবন্ধকার। তার লেখায় অগ্রাধিকার পেয়েছে টেকসই উন্নয়নের নিরিখে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পদ্ধতিগত দিক, বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের ডিজাইন ত্রুটিসহ বিভিন্ন খাতের কারিগরি ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত সংস্কার এবং অটোমেশন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশলে স্নাতক অর্জন করেন। টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ তৈয়্যব বর্তমানে সিনিয়র সফটওয়্যার সলিউশন আর্কিটেক্ট হিসেবে ‘ভোডাফোন জিজ্ঞো’ নেদারল্যান্ডস-এ কর্মরত আছেন। বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বিদায়ী সরকারের উন্নয়ন প্রপঞ্চ ও বর্তমান সরকারের করণীয় প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আপনার কাজ ছিল আওয়ামী লীগের শাসনের উন্নয়ন ন্যারেটিভকে প্রশ্ন করা। এ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে তাদের কোন কোন কাজ আমাদের বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে?

গত সরকারের যে রাজনৈতিক প্রপঞ্চ ছিল, তার মধ্যে উন্নয়ন একটি বড় জায়গা করে নিয়েছিল। তাদের উন্নয়নধর্মী প্রপঞ্চ ছিল ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন’। আমরা বাংলাদেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ডোমেইনকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি যে প্রপঞ্চটি একটি বিশেষ শ্রেণীকে প্রতিনিধিত্ব করে। এটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। আওয়ামী লীগ সরকারের যে উন্নয়ন তা দৃশ্যমান প্রকল্পকেন্দ্রিক। কিন্তু অদৃশ্য উন্নয়ন যাকে আমরা টেকসই উন্নয়ন বলে থাকি সেসব প্রকল্প অনুপস্থিত ছিল। যেমন—বিদ্যুৎ খাতে তৎকালীন বিদ্যুৎ,  জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রী ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো মন্ত্রীর এ পরিমাণ অর্থ খরচের সৌভাগ্য হবে কিনা তা আমরা জানি না। কিন্ত আমাদের সবুজ বিদ্যুৎ মাত্র ৫ শতাংশ বা তারও কম। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরও আমাদের বিদ্যুৎ খাত টেকসই হয়নি। এটা একটি সাধারণ উদাহরণ। আমরা যদি শিক্ষা খাতের দিকে লক্ষ্য করি, শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে অথচ প্রায় ১ লাখ শিক্ষকের পদ শূন্য। শিক্ষা খাতের ডিজিটাইলেজন হলো না। মার্ক্স তৈরি, ট্যাবুলেশন, প্রশাসনিক কার্যক্রম ইত্যাদিতে সময় কমিয়ে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের বেশি সময় দেয়া দরকার ছিল। কিন্তু শিক্ষাক্রম বাড়িয়ে সেখানে শিক্ষকদের ব্যস্ত রাখা হলো। আবার শিক্ষক নিয়োগও দেয়া হয়নি। গণপাশের মাধ্যমে শিক্ষার মান নামানো হয়েছে। শিক্ষা খাতে জিডিপির বিপরীতে যে বরাদ্দ তা কমে এসেছে।

একই ঘটনা ঘটেছে কৃষি খাতে, স্বাস্থ্য খাতে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির পকেট ব্যয় বাড়তে বাড়তে ৭০-৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অর্থাৎ আমাদের স্বাস্থ্য খাত হয়ে গেছে দরিদ্র তৈরির মেকানিজম। এরপর জলবায়ুর দিকে লক্ষ করুন। এক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ আমরা করেছি এবং সেজন্য সাধুবাদ জানাই। কিন্তু জলবায়ু প্রকল্পের নামে জলবায়ু তহবিল থেকে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে সেগুলো কোনোটাই জলবায়ুসংশ্লিষ্ট নয়। গত ১৫ বছরে আমরা জ্বালানি খাত নিয়ে কথা বলেছি কিন্তু একটা ভালো পিএসসি করতে পারিনি। অনেক দেরিতে একটা পিএসসি করা হয়েছে, টেন্ডার ডাকা হয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও বিগত সরকারের প্রবণতা ছিল তার পছন্দের ঠিকাদার নিয়োগ করা। ফলে আমরা অফশোর বা অনশোরে নতুন কোনো গ্যাস কূপ অনুসন্ধান করতে পারিনি। ফলে নির্দিষ্ট কূপগুলো যখন গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাচ্ছে তখন আমাদের জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। একদিকে আমাদের ক্রসবর্ডার জ্বালানি আমদানি নিয়ে সমস্যা রয়েছে, অন্যদিকে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে আমাদের বাজেটে ব্যয় বাড়ছে, রিজার্ভ ক্ষয় হচ্ছে। উপরন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও আমাদের ইস্টার্ন রিফাইনারি সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। ফলে আমরা চাহিদার প্রায় শতভাগ পরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করি। এখানেও আমাদের রাজস্ব ক্ষয় হচ্ছে। এছাড়া আগের সরকারের সার আমদানি নীতির কারণেও আমাদের ভুগতে হচ্ছে। বর্তমানে পাঁচটি সারখানার দুটি ছাড়া বাকিগুলো বন্ধ। কারণ সরকার সেখানে গ্যাস সরবরাহ করতে পারেনি। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বাড়ানোর কথা চিন্তা না করে তারা আমদানির দিকে মনোযোগ দিয়েছে। একই সঙ্গে স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি কেনার যে প্রবণতা ছিল এতেও বাজেট ব্যয় বেড়েছে। সব মিলিয়ে বলব, বিভিন্ন খাতে সম্পদ ব্যবস্থাপনার নামে আওয়ামী লীগ যে উন্নয়নটা আমাদের চাপিয়ে দিয়েছিল সেটায় দৃশ্যমান পদ্মা সেতু মেট্রোরেল এমন আরো প্রাসঙ্গিক প্রকল্প ছিল কিন্তু সেটা জীবন মান উন্নয়ন করেনি। 

গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে যেমন বিগত সরকারের দোষ-ত্রুটি কারণ হিসেবে কাজ করেছে, তেমনি তরুণদের একটি নতুন পরিবর্তিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষাও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তরুণরা কেমন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা করে?

আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করি। যে নাগরিকদের ‍বুকে গুলি তাক করে না, নিপীড়ক হবে না। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র আশা করি যার কেন্দ্রে থাকবে জীবনের মানোন্নয়ন। আমাদের দেশের গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সবার যেসব সমস্যা রয়েছে—যানজট, বেকারত্ব, উচ্চ বিদ্যুৎ বিল, নিম্ন ক্রয়ক্ষমতা, আর্থিক নিরাপত্তহীনতা, চাঁদাবাজির শিকার হওয়া, ভোক্তার দিক থেকে উচ্চমূল্য কৃষিপণ্য কেনা কিংবা কৃষকের ক্ষেত্রে উৎপাপদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া প্রভৃতি সেগুলোর সাশ্রয়ী সমাধান হবে। আমরা এমন একটি সরকার চাই যারা মানুষের জীবনের সমস্যা দূর করে মান উন্নত করতে পারবে এবং জীবনে সম্মান আসবে। একই সঙ্গে বিচার ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক দিক থেকে এমন একটি পরিবর্তন আসবে যে পরিবর্তন বৈষম্য, নিপীড়ন ও হয়রানির বিপরীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। পাশাপাশি মানুষের মানবিক মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত করবে।

আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড চাচ্ছিলাম ঠিকই কিন্তু এ নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনে আমাদের বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে? বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে?

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নিয়ে বাংলাদেশের এখনই গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমাদের মাধ্যমিক বা উচ্চ পর্যায়ে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে, সেগুলো মূলত বেকার তৈরির কারখানা। সেখানে অবশ্যই কিছু সাবজেক্ট পড়ানো হয় যেগুলোর শ্রমবাজারে চাহিদা আছে কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় এমন সাবজেক্ট পড়ানো হয় যা শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সুতরাং প্রথম কাজ হলো শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি সংযুক্তি এবং শ্রমবাজারের সংযোগ তৈরি করা। এজন্য এক্ষেত্রে ‍বিনিয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তির জায়গা হলো প্রবাসী আয়। আমরা যদি আমাদের প্রবাসীদের ট্রেনিং দিয়ে তাদের ভাষাগত দক্ষতা উন্নত করি, যোগাযোগের এবং আচরণগত ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করতে পারি বা একাধিক বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে পারি তাহলে মাথাপিছু রেমিট্যান্স পাঠানোর যে হার তা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। এটি করাও তেমন একটা কঠিন নয়। সুতরাং সরকার চাইলে এখনই এটা করতে পারে। আরেকটি বিষয়, প্রবাসীরা বাইরে যান শ্রমবাজারের সিন্ডিকেটের সাহায্যে। এ সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা দরকার। তাহলে প্রবাসী কর্মীরা সাশ্রয়ীভাবে বিদেশে যেতে পারবে এবং এটিও তাদের দক্ষতার এক প্রকার মূল্যায়ন হবে।

এবার স্বাস্থ্য খাতের কথা বলি। বাংলাদেশে দারিদ্র্য তৈরির বড় দুটি মেকানিজম হলো জলবায়ু পরিবর্তনগত প্রভাব ও স্বাস্থ্য খাত। এ দুটি খাতে যদি মানুষের পকেট ব্যয় বন্ধ করা যায় তাহলে সেই টাকা মানুষ শিক্ষা ও দক্ষতা এবং কর্মমুখী কিছুতে বিনিয়োগ করতে পারবে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি।বিগত সরকার অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কিছু নীতি নিয়েছিল যার ফলে ছয়-নয় সুদের নামে বৃহৎ কোম্পানিগুলোকে বেশি ঋণ দেয়া হয়েছিল। এসব ঋণ তারা আর বিনিয়োগ করেনি। বরং একটা বড় অংশই তা পাচার করেছে, একটা অংশ নতুন ঋণ নিয়ে পুরনো ঋণ শোধ করেছে। অর্থাৎ ঋণ অদল-বদল করেছে।কিন্তু বাস্তবে তারা বিনিয়োগ করেনি। ফলে বাজারে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। ফলে আজকে আমরা কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি দেখছি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এমন একটি নীতি নিতে হবে যাতে দেশের ব্যাংকগুলো এসএমই ও ক্ষুদ্র খাতকে টার্গেট করে ঋণ সহায়তা দেয়। আর্থিক সিস্টেমে আমরা যতি তরুণ প্রবেশাধিকার ও ঋণ নেয়া নিশ্চিত করতে পারি তাহলে তরুণরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিড্যান্ডের সুযোগ পাবে।

বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন কোন বিষয়ে মনোযোগ দেয়া দরকার?

এ সরকারের কাজের ক্ষেত্রে অনেক বেশি অবারিত। তাছাড়া তারা দায়িত্ব নিয়েছেন হঠাৎ পরিবর্তনের মুখে। তাই আমি মনে করি তাদের প্রস্তুতি গ্রহণের সময় দিতে হবে।

পরামর্শ হিসেবে আমি বলব, একটি কাজ অতিদ্রুত করা উচিত। শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনা। কেননা তারা দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে শিক্ষায় ছিল না। এছাড়া এরই মধ্যে শিক্ষা ও দক্ষতার কথা বলেছি। এরপর মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কিছু বার্তা দিতে হবে। যেমন বিদ্যুৎ ও সারের দাম কমানো। পাশাপাশি আন্দোলনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা মারা গেছেন সে পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে হবে। একই সঙ্গে অবশ্যই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করাসহ স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ সেবামূলক খাতগুলোয় যেসব সংকট আছে, সরকার যদি সেগুলো দ্রুত চিহ্নিত করতে পারে তাহলে জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা ফেরানোও গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ব্যাংক খাত জালিয়াতি ও লুটেরা ব্যক্তিদের হাতে আছে। সরকার তাদের হাত থেকে ব্যাংক খাত যদি মুক্ত করতে পারে এবং ঋণখেলাপির কাছে থেকে কিছু ঋণ আদায় করতে পারে তাহলে মানুষের কাছে এই বার্তা যাবে যে সরকার মানুষের সব ধরনের সমস্যা নিয়ে সচেতন। সেবা খাত থেকে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত যেকোনো সমাজের ভালো দিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকার যদি এসব খাতের সমস্যা দূর করতে পারে তাহলে এগুলো সরকারের ভালো ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

তৃতীয়ত, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো দূর করতে হবে। জ্বালানি খাতের পেমেন্ট সমস্যা দূর করতে হবে। এরই মধ্যে ইনডেমনিটি আইন বাতিল হয়েছে এটা ভালো একটি বিষয়। একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও পরিকল্পনাগুলো যাচাই-বাছাই করে পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। যেমন এমন অনেক প্রকল্প আছে যেগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সক্ষমতার কথা বলা হয়েছে তা পূরণ করতে পারে না। সেগুলো পর্যালোচনা করে বাদ দিলে সরকারের ওপর ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা কমে আসবে।

সবশেষ পরামর্শ হলো, সরকারের বাজেটে পরিচালনা ব্যয় অনেক বেশি। সরকারকে বাজেট থেকে পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে সরকার রাজস্ব ব্যয়ের জন্য কিছুটা জায়গা পাবে, উন্নয়নে ব্যয় করতে পারবে। পরিচালন ব্যয়ে খরচ কমালে কর্মসংস্থান কমতে পারে কিন্তু উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করার জন্য আবার অন্যদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে। তাছাড়া মাঝারি ও ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে, উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তার পরিমাণ বাড়ালে কর্মসংস্থান বাড়বে। এতে মানুষের জীবন মান উন্নত হবে, তারা বার্তা পাবে যে সরকার তাদের পাশে আছে। পাশাপাশি নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারসহ জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র গড়তে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি সরকারের প্রতি আমার মূল পরামর্শ মানুষের কষ্টগুলোকে সহনীয় পর্যায়ে আনতে দৃশ্যমান উদ্যোগ নিন।

বেশ কয়েকবার জ্বালানির প্রসঙ্গ এসেছে। সেই সূত্র থেকেই বলি, জ্বালানি নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবেলা করতে পারি?

জ্বালানি নিরাপত্তার সঙ্গে অর্থনীতি ওতপ্রোত জড়িত। মাথাপিছু জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রথমত আমাদের সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সম্ভাবনাগুলো রয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করতে হবে।কেন সোলার প্যানেল বাড়ানো হচ্ছে না ও ব্যক্তি খাতে এর বিকাশ হচ্ছে না, যেহেতু আমাদের জমিস্বল্পতা আছে সেক্ষেত্রে ছাদগুলো কেন সৌরছাদ হিসেবে রূপান্তর হচ্ছে না, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবনের ছাদে কেন সৌরছাদ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না—এগুলো যাচাই-বাছাই করতে হবে। অনেকে এগুলোকে ছোট বিষয় বলে থাকে কিন্তু আমার মনে হয় ব্যক্তি যদি এ বিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি পায় তাহলে ব্যক্তি এটিকে বিনিয়োগের খাত হিসেবে নেবে এবং কর্মসংস্থান হবে। তারপর জলবিদ্যুৎসহ অন্য যে প্রকল্পগুলো আছে সেগুলোও পর্যালোচনা করতে হবে।

সরকারের কাছে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি রোডম্যাপ দেয়া হয়েছে। সরকারের সেগুলো রিভিউ করে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। জ্বালানি নিরাপত্তার দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের যতগুলো অনশোর ও অফশোর গ্যাসফিল্ড রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাপেক্সের সক্ষমতা যদি থাকে তাহলে তাদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু জালিয়াতি দূর করতে হবে। উন্নয়নমূলক কূপকে অনুসন্ধানমূলক নতুন কূপ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। এগুলো না করে প্রকৃত অর্থে কূপ অনুসন্ধান করতে হবে। আর যতদিন না অভ্যন্তরীণভাবে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যায়, ততদিন স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি না কিনে বৃহৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে স্থায়ী চুক্তিতে যাওয়া দরকার।যে চুক্তিতে একটি নির্দিষ্ট দাম ঠিক করা হবে লেনদেনের জন্য। আর যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো হয়ে গেছে, বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেটি বন্ধের দাবি কিছু রাজনৈতিক দলগুলো করছে, আমি তা সমর্থন করি না।কারণ এখানে বিনিয়োগ হয়ে গেছে। বরং রাষ্ট্রের এ বোঝা কীভাবে সম্পদে পরিণত করা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঝুঁকি কমানো যায়, জ্বালানি নিরাপত্তাবিষয়ক যেসব গাইডলাইন আছে বা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সঞ্চালনার জন্য যেসব নীতি রয়েছে—এ সবকিছু পর্যালোচনার জন্য একটা বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করা দরকার। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তারা কোনো ত্রুটি খুঁজে পেলে সেগুলো সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। 

নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন আমরা কীভাবে বাড়াতে পারি?

এটি নির্ভর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জ্বালানি আমদানিনির্ভরতা থেকে কতটা সরে আসতে চায় সরকার। এছাড়া রিজার্ভ পরিস্থিতিসহ অন্য যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে বিভিন্ন অংশীজন-অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা সবাইকে নিয়ে বহুপক্ষীয় সেটলমেন্ট হওয়া উচিত। কারণ জ্বালানি নিরাপত্তা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। সবশেষে আমার মনে হয়, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে তাহলে সরকার এক বছরের মধ্যেই একটা ভিশন গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে মাস্টারপ্ল্যান ২০২৩-আইইপিএমপি রিভিউ করা প্রয়োজন। কারণ সেখানে অনেক অর্থনৈতিক ভুল পরিসংখ্যানের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বা সক্ষমতার ব্যাপারে একটা হাইপ তোলা হয়েছে কিন্তু বাস্তব চিত্র তা নয়। আগের সরকারের যে পরিসংখ্যান জালিয়াতি ছিল তা সংশোধন করে বিদ্যুতের চাহিদার প্রকৃত তথ্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাহলে আশা করা যায় সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো দূর করা যাবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন