দেশে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে সাতটি ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। স্বল্পমেয়াদের এসব কেন্দ্রের কাজ পেয়েছিল স্থানীয় ও বিদেশী তিন কোম্পানি। এরপর ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইনের আওতায় ব্যাপক হারে শুরু হয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন। জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞদের অভিমত, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়েই এ খাতে লুণ্ঠনের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল।
দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (ইনস্টল ক্যাপাসিটি) এখন ২৮ হাজার ১৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বড় একটি অংশই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সংকটকালীন এসব ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হলেও প্রতিশ্রুতি ছিল ২০২৪ সালের মধ্যে সব বন্ধ করে দেয়ার। তবে বিশেষজ্ঞদের নানা আপত্তি সত্ত্বেও ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্টের’ যুক্তি দেখিয়ে বছরের পর বছর নবায়ন করা হয়েছে চুক্তি। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাত থেকে লুটে নেয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, যা বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে জানান, পুরো বিদ্যুৎ খাতে লুণ্ঠনের পরিকল্পনা হিসেবে কাজ করেছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে লুণ্ঠনের সংস্কৃতি ২০০৭ সাল থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বলে দাবি তার।
অন্তর্বর্তী সরকার যদিও সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের আর কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করবে না। এরই মধ্যে স্থগিত করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইনটিও, যার মাধ্যমে বিনা দরপত্রে কাজ পাওয়ার সুযোগ নিত বিশেষ একটি মহল। এখন আর এ আইনের আওতায় নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হলে চুক্তি নবায়ন করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১০ সালের বিশেষ আইনের আওতায় নির্মিত কুইক রেন্টালের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। একই সঙ্গে যেসব কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে, সেগুলোও অবসরে চলে যাবে, এ নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে আমরা এখনই বাদ দিতে পারছি না, কারণ এটার একটা কন্ট্রাক্টচুয়াল অবলিগেশনস রয়েছে। কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়া এগুলো বাতিল করলে তারা (কেন্দ্র মালিক) আবার মামলায় চলে যাবে। এরই মধ্যে তিন-চারটি পাওয়ার প্লান্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য এসেছিল, সেগুলোকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়, সেই সময় অর্থাৎ ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ছিলেন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে বিদ্যুৎ সমস্যার সাময়িক সমাধান হিসেবে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়। কিন্তু সেটা স্বল্প সময়ের জন্য। সক্ষমতায় এখন আমাদের বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চলে এসেছে। তাই এগুলো (ভাড়াভিত্তিক) রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বিগত সরকার এ স্বল্পমেয়াদি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দীর্ঘ সময় চালিয়েছে।’
জানা গেছে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ করতে পারবেন, এমন সব নতুন উদ্যোক্তাদের এ খাতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে প্রকিউরমেন্ট রিভিউ করার জন্য একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে হাই পাওয়ার ন্যাশনাল কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্রের মাধ্যমে আটটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসার পর এ খাতটিকে অর্থ লুটে নেয়ার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বিনা দরপত্রে কাজ দিতে ২০১০ সালে করা হয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইন। জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য সেটি পাস করা হয়, যা জরুরি বিশেষ আইন নামে পরিচিত। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়। বিশেষ এ আইনের মাধ্যমে বড় সক্ষমতার কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের অনুমোদন দেয়া হয়। বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয় কেবল ২০১০ সালেই।
বিশেষ আইনের অধীনে ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেয়া হয়। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব কেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড, এনার্জিপ্যাক অন্যতম।
দেশে বিদ্যুৎ সক্ষমতায় এখনো ঠিক কতগুলো ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোর তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে বিপিডিবির সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, বেসরকারি খাতে গ্যাসভিত্তিক কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে তিনটি। আর জ্বালানি তেলচালিত (এইচএফও) কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে নয়টি। গ্যাস ও জ্বালানি তেলচালিত এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৯৮৩ মেগাওয়াট। আর রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে মোট নয়টি। এগুলোর সক্ষমতা মোট ৪১২ মেগাওয়াট।
এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনেকগুলোই এখন পুরনো এবং উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বিপিডিবি সেগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনছে না। ফলে চুক্তি অনুযায়ী এসব কেন্দ্র বসিয়ে রেখেই প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর ১৫ বছরের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১৬ অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার বড় অংশই গেছে বেসরকারি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পেছনে।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতের মতো পাকিস্তানের বিদ্যুৎ খাতে প্রধান সমস্যা ছিল উৎপাদন সক্ষমতার ঘাটতি। এ সমস্যাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে দেশটি। ঘাটতি কাটিয়ে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার দেশে রূপ নেয় পাকিস্তান। তবে একটা সময় সে সক্ষমতাই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। এসব কেন্দ্রকে চালু রাখতে গিয়ে চাপে থাকা অর্থনীতিকে আরো সংকটাপন্ন করে তুলেছে। কেউ কেউ বিষয়টিকে দেশটির সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখছেন।
কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট নিয়ে আদ্যোপান্ত কাজ করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)। ‘কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টস ইন বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনমিক অ্যাপ্রাইজাল’ শীর্ষক এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মুস্তফা কে মুজেরী। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) এ নির্বাহী পরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ খাতে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ব্যয়বহুল পদ্ধতি। তবে এটাকে স্বল্পমেয়াদে বিদ্যুৎ চাহিদা সমাধানের জন্য গ্রহণযোগ্য সমাধান হিসেবে ধরা হয়। বিগত সরকারও স্বল্প সময়ের সমাধানের জন্য কুইক রেন্টাল এনেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র তিন বছর, পাঁচ বছর করে রিনিউ করেছে। এর মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ খাতে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এটা বছরের পর বছর ধরে চলে এসেছে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে এটাকে ব্যবহার করে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে এ খাতে ধস নামানো হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের সমস্যার সমাধান না করে বরং মেয়াদ বৃদ্ধি করে এ খাতে আর্থিক বোঝাটা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে কিছু ব্যক্তি লাভবান হয়েছে এবং এ খাতের সংকটকে ঘনীভূত করেছে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১০০ মেগাওয়াট একটি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বছরে গড়ে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় ৯০ কোটি টাকার বেশি। ফলে কোনো বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন না করে বসিয়ে রাখলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া দিতে গিয়ে সরকারের লোকসান বাড়ে। এর বাইরেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিস পরিচালনা-সংক্রান্ত ব্যয় বাবদ আরো অন্তত ৫-১০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে বছর বছর।