বিশ্ব অর্থনীতি

পলিসিগত বৈপরীত্য থেকেই কি চীন-মার্কিন দ্বৈরথ

ড্যানি রড্রিক

ছবি : বণিক বার্তা

পলিসিগত জায়গা থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে স্পষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে পুরোপুরি পুঁজিবাদী অর্থনীতি, অন্যদিকে চীনের অর্থনীতি পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত। নানা ত্রুটি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র একটি গণতান্ত্রিক দেশ। পক্ষান্তরে চীন একদলীয় শাসন ব্যবস্থার দেশ, যেখানে কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বলে কেউ নেই। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ হওয়া সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ক্ষমতাবলে মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে চীন। 

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নীতিমালায় কিছু সাদৃশ্যও রয়েছে, যার ফলে ক্রমেই তাদের দ্বন্দ্ব বেড়েছে। বিশ্বপরিসরে অবস্থানের আপাত ক্ষয়ের কারণে  আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতিগুলোয় এর প্রভাব পড়ছে। তাদের গৃহীত নীতিমালা মূলত দশক আগে চীনের নীতিমালারই যেন প্রতিচ্ছবি। চীনের পরিকল্পনায় একসময় মুক্তবাজার অর্থনীতির ওপর অগ্রাধিকার পেয়েছিল জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ এবং নবায়ন। আমেরিকার বর্তমান নীতিমালা স্ববিরোধী এবং তা চীনের জন্য সুবিধাজনক। ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তেজনা বহু গুণে বাড়ছে।

যদিও চীন ১৯৭৮-পরবর্তী সময়ে বাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকেছে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে অর্থনীতিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে ধাবিত করেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নীতিগুলো অর্থনৈতিক অগ্রগতির আশাতীত প্রতিফলন দেখিয়েছে। চীনকে পুনরায় প্রধান ক্ষমতাসীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গৃহীত জাতীয় নবায়নযোগ্য পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল ওই নীতিমালাগুলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী চীন ‍নিজস্ব নিয়মে বিশ্বায়নের পথে অগ্রসর হয়েছে। নিজেদের শিল্প খাতকে রক্ষা করেছে এবং উত্তরণে সহায়তা করেছে। বিপরীতে বাইরের বাজারগুলোকে স্বাধীনতাও দিয়েছে। দেশটি কখনই বাণিজ্যিক কিংবা জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় পরিকল্পিত শিল্প খাতের অগ্রগতির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে ও ভর্তুকি প্রদানে পিছপা হয়নি।

একজন চীনা নীতিনির্ধারক এ কৌশলকে পর্দাবৃত খোলা জানালা হিসেবে বর্ণনা করছেন, এমনটি শুনেছিলাম একবার। এ কৌশলের মাধ্যমে চীনা অর্থনীতি নির্মল বাতাস পাবে—বিদেশী প্রযুক্তি, বিশ্ববাজারে প্রবেশাধিকারসহ অন্য প্রভাববিস্তারকারী জোগানগুলো। একই সঙ্গে এটি স্বল্পমেয়াদি পুঁজিপ্রবাহকে অস্থিতিশীল ও অতিরিক্ত প্রতিযোগিতায় ঊর্ধ্বমুখী শিল্প সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বা শিল্পনীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে—এমন ধরনের ক্ষতিকারক উপাদানগুলোকে দূরে রাখবে। চীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি বড় আশীর্বাদ ছিল। যেহেতু দেশটি অন্যান্য দেশের ফার্ম ও বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় বাজার তৈরি করেছে। এছাড়া দেশটির সবুজ শিল্পনীতিগুলো বিশ্বে স্বল্প কার্বন নিঃসরণে ভূমিকা রেখেছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে সৌর ও বায়ুশক্তির মূল্য হ্রাস করায়।

স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য দেশ চীনের হস্তক্ষেপবাদী এবং ব্যবসায়িক চর্চা সম্পর্কে অভিযোগ জানিয়েছে। বিশেষত চীনের রফতানি বাণিজ্যের দ্রুত সম্প্রসারণ, যাকে বলে তথাকথিত ‘‌চায়না শক’, পশ্চিমা অর্থনীতির উৎপাদনকারী সম্প্রদায় এবং পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে। কেননা তা ডানপন্থী কর্তৃত্ববাদী পপুলিস্টদের চূড়ান্ত উত্থানের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। যে কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান ঘটেছে। তবু যত দিন উন্নত অর্থনীতির নীতিগুলো একটি ভোগবাদী, বাজার-মৌলবাদী যুক্তির মাধ্যমে চালিত হয়েছিল, এসব প্রভাব মার্কিন-চীন সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করেনি।

পক্ষান্তরে অনেক বুদ্ধিজীবী ও অভিজাত নীতিনির্ধারক ভেবেছিলেন অর্থনীতিতে পশ্চিমা ও চীনা পন্থাগুলো পরিপূরক এবং পারস্পরিকভাবে সহায়ক। ঐতিহাসিক নিয়াল ফার্গুসন এবং মরিৎজ শুলারিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পারস্পরিক সম্পর্ককে বর্ণনা করতে ‘কাইমেরিকা’ শব্দবন্ধটি উদ্ভাবন করেছেন। চীন নিজস্ব শিল্প খাতে ভর্তুকি দেয় এবং পশ্চিমারা আনন্দের সঙ্গে চীনের তৈরি সস্তা পণ্যসামগ্রী গ্রহণ করে। যত দিন   ধারণাটি পশ্চিমে বজায় ছিল, হারানো শ্রমিক ও সম্প্রদায়গুলো সামান্য সাহায্য বা সহানুভূতি পেয়েছে এবং তাদের  প্রশিক্ষণ নিয়ে অধিক সুবিধাসংবলিত এলাকায় স্থানান্তরিত হতে বলা হয়।

কিন্তু পরিস্থিতিটি টেকসই ছিল না এবং ভালো চাকরির অপ্রতুলতা, ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক বৈষম্য এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের জন্য আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধি—এসব থেকে উৎসারিত সমস্যাগুলো এত প্রকট হয়ে দাঁড়ায় যে উপেক্ষা করার উপায় ছিল না। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা উৎপাদনমুখী অর্থনীতিতে মনোনিবেশ করেন, প্রথমে ট্রাম্পের অধীনে এবং ধারাক্রমে জো বাইডেনের অধীনেও। জো বাইডেনের প্রশাসন এমন কিছু ভিন্নধর্মী বিষয়াদিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, যা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণী, সরবরাহ শৃঙ্খলের স্থিতিস্থাপকতা এবং সবুজ বিনিয়োগের পক্ষে।

যদিও নতুন কৌশল চীনের দীর্ঘদিন ধরে চর্চাকৃত শিল্পনীতিগুলোর চেয়ে খুব বেশি স্বাতন্ত্র্য ছিল না। নবায়নযোগ্য প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব শিল্প খাতের মতো নতুন প্রযুক্তি এবং আধুনিক উৎপাদন কার্যক্রমে ভর্তুকি দেয়।  স্থানীয় সরবরাহকারী এবং দেশীয় পণ্যকে প্রণোদনা দেয়া হয়। অন্যদিকে বিদেশী উৎপাদকরা বৈষম্যের শিকার হন। আমেরিকায় চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ শক্ত হাতে যাচাই-বাছাই করা হয়। ‘ছোট আঙিনা, উঁচু বেষ্টনী’ প্রবাদকে মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি খাতে চীনের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করতে চায় যেন জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখীন না হয়।

যদি এ নীতিগুলো আরো সমৃদ্ধ, সমন্বিত এবং সুরক্ষিত আমেরিকান সমাজ তৈরি করতে সফল হয় তাহলে পুরো বিশ্বই উপকৃত হবে, ঠিক যেভাবে চীনা শিল্পনীতি চীনা বাজার সম্প্রসারণ এবং নবায়নযোগ্য পণ্যের মূল্য হ্রাস করে বাণিজ্য অংশীদারদের উপকৃত করেছিল। সুতরাং ওই নীতি ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়গুলো প্রয়োগের জন্য মার্কিন-চীন বিরোধকে গভীরতর করার প্রয়োজন নেই। তবে দেশ দুটির সম্পর্ক পরিচালনা করার জন্য কিছু নতুন নিয়মের প্রয়োজন রয়েছে। 

কপটতা পরিহার করে তাদের পদ্ধতিগত সাদৃশ্যকে স্বীকৃতি দেয়া দুই পক্ষের জন্য একটি ভালো উদ্যোগ। চীনের বাণিজ্যবাদী ও রক্ষণশীল নীতি অনুসরণ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির আন্তর্জাতিক আদেশ লঙ্ঘন করার অভিযোগকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সমালোচনা করে চলছে। বিপরীতে চীনা নীতিনির্ধারকরা বিশ্বায়নের স্রোতের বিমুখে যাত্রা করা এবং চীনের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কোনো পক্ষই দুর্ভোগ সম্পর্কে সচেতন বলে মনে হয় না: চীন তার খোলা জানালা পর্দাবৃত করেছে আর যুক্তরাষ্ট্র তার ছোট আঙিনার চারপাশে বড় বেষ্টনী নির্মাণ করেছে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো তাদের নীতির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা এবং যথাযথ যোগাযোগ বজায় রাখা। আন্তঃনির্ভর বিশ্ব অর্থনীতির যুগে অনিবার্যভাবেই জাতীয় অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর এবং গার্হস্থ্য সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রবর্তিত নীতি অন্য দেশের অর্থনীতির ওপর কিছুটা অবাঞ্ছিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। যখন দেশগুলো বাজারের গুরুতর ক্ষতি উতরানোর জন্য শিল্প নীতি বিবেচনায় নেয়, তখন তাদের বাণিজ্য অংশীদারদের সহনশীল এবং সমঝদার হওয়া বাঞ্ছনীয়।  পাশাপাশি যে নীতিগুলো বৈশ্বিক ক্ষতির বিনিময়ে দেশীয় মুনাফা অর্জনে সহায়তা করে সেসব নীতি থেকে ওই নীতিগুলোকে আলাদা করে বিচার করা উচিত। 

তৃতীয়ত, আরোপিত জাতীয় নিরাপত্তা নীতিগুলোকে সুপরিকল্পিত করা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, যেসব উন্নত প্রযুক্তি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকিস্বরূপ, কেবল সেগুলোর রফতানি নিয়ন্ত্রণে তারা সীমিত পরিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এসব আত্মস্বীকৃত বিধিনিষেধ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে যে সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে গৃহীত নীতি তাদের ব্যাখ্যার সঙ্গে মানানসই কিনা এবং তাদের অন্যান্য নীতি কী হতে পারে। উপরন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা নীতির সংজ্ঞাকে অতিরঞ্জিত করার প্রবণতা রয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতোই তার চিন্তায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়কে প্রাধান্য দেবে এবং চীনও তার রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিত্যাগ করবে না। রাতারাতি পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব নয়। তবে সে কাজটি কিছুটা সহজ হয়ে উঠতে পারে যদি উভয় দেশই স্বীকার করে নেয়, তাদের নীতিমালা প্রায় অভিন্ন এবং একে অন্যের জন্য ক্ষতিকারকও নয়।


স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ভাষান্তর: সাবরিনা স্বর্ণা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন