ডালপালা মেলছে নানা গুঞ্জন

ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে আজ গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে বসছে বিএবি

হাছান আদনান

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ বা মার্জারের বিষয়ে চলছে নানা আলোচনা। ডালপালা মেলছে নানা গুঞ্জনও। এর মধ্যে প্রথম সারির একটি ব্যাংকের সঙ্গে চতুর্থ প্রজন্মের দুর্বল এক ব্যাংক একীভূত হচ্ছে বলে কানাঘুষা চলছে। আবার প্রথম প্রজন্মের দুটি বেসরকারি ব্যাংকও একীভূত হওয়ার গুঞ্জন ছড়িয়েছে। শরিয়াহভিত্তিক একাধিক ব্যাংকও পরস্পরের সঙ্গে একীভূত করার আলোচনা চলছে। এ পরিস্থিতিতে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও শঙ্কা। 

বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) নেতারা। গুলশানে বিএবি কার্যালয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে আলোচনার জন্য তারা গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বিএবি চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আজ বেলা ৩টায় গভর্নরের কাছে যাবে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বিএবি চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মার্জার-অ্যাকুইজিশনের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে বিএবির সদস্যদের মধ্যে অস্পষ্টতা ও সংশয় আছে। তাই আলোচনার জন্য বিএবির সভা আহ্বান করা হয়েছিল। সভায় ব্যাংক মার্জারের বিষয়ে বিএবি সদস্যরা নিজেদের মতামত জানিয়েছেন।’

বিএবির পক্ষ থেকে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি জানিয়ে এক্সিম ব্যাংকের এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘পাঁচ-সাতটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সোমবারের এ বৈঠকে অংশ নেবেন। মার্জার-অ্যাকুইজিশনের পদ্ধতি কী হবে, সে বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানতে চাইব।’

সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন বাড়ানোর পক্ষে থাকলেও এখন ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে চাইছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সম্প্রতি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগের কথাও জানানো হয়। দেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে গত ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ নামে একটি ফ্রেমওয়ার্ক দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় খেলাপি ঋণ কমানো ও ভেঙে পড়া সুশাসন ফেরাতে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ১৭টি কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ওই দিন তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের বলেছিলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারীকৃত পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক ২০২৫ সালের মার্চ থেকে কার্যকর হবে। এজন্য সব ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে পিসিএ বাস্তবায়ন কমিটি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ, তারল্য, মূলধন ও সুশাসন—এ চার মানদণ্ডের ভিত্তিতে র‍্যাংকিং হবে আগামী বছর। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদন মূল্যায়ন করা হবে। কোনো ব্যাংক পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কে উল্লিখিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে ব্যর্থ হলে সেটিকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো চাইলে নিজেরাও একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিতে পারবে।’ এ বিষয়ে ঘোষিত রোডম্যাপে বলা হয়, একাধিক ব্যাংক একীভূত হলে পরিচালনা পর্ষদ শক্তিশালী হবে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দূর হবে। একই সঙ্গে কমে আসবে প্রশাসনিক ব্যয়।

এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংক নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমরা একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে চাই। কোনো দুটি ব্যাংক নিজ থেকে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিলে সেটি বিবেচনায় নেয়া হতে পারে।’ ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে কমিয়ে ৪৫-এ নামিয়ে আনার বিষয়েও ইঙ্গিত দেন গভর্নর।

এর পরই ব্যাংক খাতে মার্জার-অ্যাকুইজিশনের বিষয়ে নানা আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের শীর্ষ একটি ব্যাংকের সঙ্গে চতুর্থ প্রজন্মের এক দুর্বল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার গুঞ্জন ওঠে। বিষয়টি নিয়ে প্রথম সারির ব্যাংকটির পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়। আবার বেসরকারি খাতের ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত পাঁচ-সাতটি ব্যাংকের সঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলক একীভূত করে দেয়া হতে পারে বলেও কানাঘুষা চলে। এ অবস্থায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অনেক উদ্যোক্তা বিএবি নেতাদের কাছে প্রকৃত অবস্থা জানতে চান। অনেকে মার্জারের বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ও জানতে চেষ্টা করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতেই বিএবির পক্ষ থেকে বৈঠকের আয়োজন করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের তৃতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমরা আরো ভালো করার চেষ্টা করছি। এখন নানা মাধ্যমে শুনছি, আমাদের সঙ্গে একটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে দেয়া হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের পর্ষদ উদ্বিগ্ন।’

বিএবির একটি সূত্র জানায়, দেশের শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক একে অন্যের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে দেশে শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে এ সংখ্যা ৫-৬-এ নেমে আসতে পারে। প্রথম প্রজন্মের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও একে অন্যের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা চলছে। আবার চতুর্থ প্রজন্মের একাধিক ব্যাংকও দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারে।

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ (রাকাব) কয়েকটি ব্যাংক বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এগুলোকে একীভূত করে দেয়ার বিষয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচনা চলছে। শেষ পর্যন্ত কোনো আলোচনাই চূড়ান্ত রূপ পায়নি। এবার সরকারি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও মনে করেন, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে। মার্জার-অ্যাকুইজিশনের মাধ্যমে এ সংখ্যা কমিয়ে আনা দরকার। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এ শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু কোন পন্থায়, কিসের ভিত্তিতে মার্জার হবে, সে বিষয়ে আমরা এখনো তেমন কিছু জানি না। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে গাইডলাইন আসুক। সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে গিয়ে ভালো ব্যাংকও যেন খারাপ না হয়ে যায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’ 

এ বিষয়ে চেষ্টা করেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় আগামী বছর ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা নিরূপণ করা হবে। যেসব ব্যাংক ফ্রেমওয়ার্কে বেঁধে দেয়া শর্ত পূরণে ব্যর্থ হবে, সেগুলোর বিষয়ে তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তার মানে চলতি বছর কোনো ব্যাংক একীভূত হওয়ার সুযোগ নেই। বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদেরও এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন