বিশ্লেষণ

সাংস্কৃতিক বহুত্বেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

আহমেদ দীন রুমি

ছবি : বণিক বার্তা

পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন বরিশালের যোগেন মণ্ডল। তাকে বিবেচনা করা হয় পাকিস্তানের স্থপতিদের একজন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু জিন্নাহর মৃত্যুর পরই বদলে গেল ক্ষমতার সমীকরণ। মুসলিম আমলাতান্ত্রিক আধিপত্যে তিনি মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে পারলেন না। অল্প সময়ের মধ্যেই খসে পড়েন সরকার থেকে। হাল আমলে বরিশালের যোগেন মণ্ডলের কথা খুব কম মানুষই জানে। কিন্তু যোগেন মণ্ডলের গল্পেই পাকিস্তানের গল্প নিহিত। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ভারতে সংখ্যালঘু নিরাপদ নয়—এ অনুসিদ্ধান্তকে মাথায় নিয়ে। কিন্তু ক্রমে পাকিস্তান নিজেই যেন এমন রাষ্ট্রে পরিণত হলো যেখানে সংখ্যালঘু নিরাপদ নয়। অর্থাৎ পাকিস্তান তার জন্মের পাটাতনকেই নাকচ করে দিল। এই যে ভিন্ন মতবাদকে নাকচ ও বাতিল করার নীতি, এটাই এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের ভঙ্গুরতার পেছনে অন্যতম অনুঘটক। অবশ্য কথাটা শুধু পাকিস্তান না, যেকোনো দেশের জন্যই প্রযোজ্য। ক্ষমতা দিয়ে বিজয় অর্জন করা যায় সত্য, কিন্তু স্থিতিশীলতার জন্য বহুত্ববাদী মনোভঙ্গি জরুরি। কেবল চেঙ্গিস খানের মতো জয় করে যাওয়াই তো সভ্যতার মূল কথা নয়। সভ্যতা প্রতিষ্ঠার মূল সূত্র বহুত্বকে ধারণ করতে পারার মধ্য দিয়ে চিন্তার ঝুলি সমৃদ্ধ করা।

সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা কালচারাল হেজেমনির এ যুগে সংস্কৃতির বহুত্বের আলাপ যথেষ্ট দুর্লভ ও দুর্বোধ্য। অথচ পরিচয়ের বহুত্ববাদী সংজ্ঞায় অমর্ত্য সেন বৈচিত্র্যের সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক ও আইনি পরিসর জোগান দেয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক গতিময়তার কারণেই তাতে বৈচিত্র্যের সমাবেশ দেখা যায়। পেশা, অর্থনৈতিক অবস্থা, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, লিঙ্গ, ভাবাদর্শ ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য থাকে। বৈচিত্র্য থাকতে পারে সমাজে বসবাসকারী মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। বিদ্যমান সে বহুত্বকে কীভাবে ধারণ করা হবে, সেটা সবার আগে বিবেচ্য। কারণ সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের সর্বোচ্চ ভালো কামনা করার জরুরত যেমন সত্য, পাশাপাশি সত্য কম সংখ্যক উপেক্ষিত মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও অধিকারবঞ্চিত হওয়া থেকে সুরক্ষিত রাখা। লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ কিংবা জাতীয়তার ভিত্তিতে মানুষ তার মানবিক মর্যাদা হারায় না। যদি কোনো রাষ্ট্র কোনো বিশেষ শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের প্রতি পিঠ প্রদর্শন করে, তাহলে সেই বিশেষ শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের থেকে আনুগত্য দাবি করতে পারে না। যদি দাবি করে, তাহলে সেটা আর আধুনিক শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক থাকে না। আদিম যুগের দাস ও মুনিবের সম্পর্কে পরিণত হয়। 

আরেকটা জরুরি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। চতুর্দশ শতাব্দীর সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন আসাবিয়া তত্ত্বের কারণে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি তার কিতাবুল ইবারের ভূমিকা পর্বে তথা মুকাদ্দিমায় যুদ্ধনীতি নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছেন। আসাবিয়া মানে গোত্রীয় বন্ধন। এর বন্ধন রক্তের মাধ্যমে হতে পারে কিংবা আদর্শের মাধ্যমে। ইবনে খালদুনের দাবি ছিল, যুদ্ধের সময় সে পক্ষে আসাবিয়া শক্তিশালী থাকে, সে পক্ষে জয়ের সম্ভাবনা বেশি। কারণ কয়েকটা গোত্র যখন মৈত্রীর মাধ্যমে একটা পক্ষ হিসেবে যুদ্ধ করে তখন তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা সহজ। বিপরীতে একই গোত্রের হলে বিভাজন তৈরি করাটা এত সহজ না। ইবনে খালদুন অনেক দিক থেকেই প্রাসঙ্গিক এখনো। কিন্তু জাতীয়তাবাদ পরবর্তী সময়ে আসাবিয়ায় প্রভাবিত যুদ্ধনীতির বিপরীত উদাহরণও তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ যখন একাধিক জাতিগোষ্ঠী ও বর্ণের মানুষ একটা সাধারণ পাটাতন তৈরি করে, সে পাটাতনের প্রতি অন্য জাতিগোষ্ঠীর আস্থা বেড়ে যায়। বহুত্ববাদী সমাজের প্রতি প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষও ভরসা রাখে। ভারতের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই হয়েছে। বর্তমান প্রান্তিক নীতির কথা বাদ দিলে ভারত কোনো না কোনোভাবে সাংস্কৃতিক বহুত্বকে ধারণ করে এসেছে ইতিহাসের দীর্ঘ সময় ধরে। গ্রিক, পর্তুগিজ, আরমেনীয়, আফগান, আরব ও পারসিকদের মতো অজস্র জাতিগোষ্ঠীর বাস। এ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য দেশ হিসেবে অনেকটাই স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পেরেছে পরবর্তী সময়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তান ব্যস্ত ছিল নাকচ করার প্রবণতায়, বিপরীতে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় তৃষ্ণা ছিল বহুত্ববাদের। 

এ কথা সত্য, যে সমাজ বৈচিত্র্যকে যত বেশি ধারণ করতে পারে, তা তত সমৃদ্ধ। তবে এ বৈচিত্র্যকে হজম করতে গেলে প্রয়োজন সহনশীলতা। দরকার বিপরীত মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীলতাও তো কোনো বায়বীয় জিনিস নয়। সমাজে ও প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের বৈচিত্র্য হাজির করতে গেলে কিছু প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। বিশেষ সংস্কৃতির ওপর চড়াও হয়ে তাকে কোণঠাসা করে রাখতে পারে। কিংবা কোনো বিশেষ শ্রেণী যখন সংস্কৃতি উৎপাদন শুরু করে ক্ষমতাকে পোক্ত করার জন্য। ক্ষমতা মানে তো কেবল দাবিয়ে রাখা না। কখনো ‍নীরব থাকাও ক্ষমতাচর্চারই একটা ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অবস্থা এর সর্বোৎকৃষ্ট নজির হতে পারে। দেশে ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যা সব মিলিয়ে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯। এই ৫০টি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, অনেকের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা ও কতেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাস ও পুরাণ। সে অনুপাতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই মূল ধারায়। গারো পুরাণ ও সাংসারেক ধর্মের মতো অনেক বিশ্বাসই যে বিলুপ্তির দিন গুণছে, তা মূলধারায় আলোচনাহীন। ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিক পরিবেশ কীভাবে রক্ষা করা হচ্ছে, সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক থাকছে না। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রের সব স্তরে বৈষম্যহীন সেবাপ্রাপ্তির অধিকারের প্রশ্ন। উদাহরণস্বরূপ, একটা বড় অংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য বাংলা মাতৃভাষা নয়, দ্বিতীয় ভাষা। ফলে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের জন্য সুবিধা সংকুচিত। সেই সংকোচন কাটাতে কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে? পেশাগত জীবনেই পরিবেশের আনুকূল্য তাদের জন্য ঠিক কতটুকু? পাহাড়িদের মধ্যে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার সমতলের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। অর্থাৎ শিক্ষাক্ষেত্রের পরিবেশ, সেখানকার শিক্ষকদের পড়াশোনার মান কিংবা শিক্ষা প্রদান পদ্ধতির কোনো একটা জায়গা ঠিকঠাক কাজ করছে না। এ বিষয়ে কোনো মহলে প্রশ্ন উত্থাপন না হলে বা নীরবতা থাকলে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজের বহুত্ববাদী ধারণা। সমাজে কোনো একটা অংশ যত ক্ষুদ্রই থাক, তার প্রতিনিধিত্ব না থাকার মানে দিন শেষে তার অস্তিত্বের অস্বীকৃতি। 

বহুত্ববাদী প্রবণতার পেছনে সবচেয়ে বড় সমালোচনা আসে নৈতিকতা বিবেচনায়। সমাজে বসবাসকারী মানুষের সাধারণ অভিজ্ঞতা ও নৈতিকতা চর্চার ভেতর দিয়ে সমাজের নৈতিক সক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু সেই প্রোটাগোরাসের আমল থেকেই দার্শনিকরা নৈতিক আপেক্ষিকতা স্বীকার করে আসছেন। বিংশ শতাব্দিতে এসে ফ্রাঞ্জ বোয়াস এবং ক্লিফোর্ড গিয়ার্জদের মতো নৃবিজ্ঞানীরা সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতার সঙ্গে নৈতিক আপেক্ষিকতার বৈধতা দিয়েছেন। দাবি করেছেন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মানুষের একটি প্রধান অধিকার হিসেবে। কিন্তু সাংস্কৃতিক বৈচিত্র‍্যের একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। ব্যক্তি, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রথা ও প্রতিষ্ঠানভেদে মূল্যবোধের ভিন্নতা রয়েছে বলে যে যার মতো করে নৈতিক মানদণ্ড নির্ধারণ করে তা দ্বারা ভালোমন্দ, ঠিক-বেঠিক, ঔচিত্য-অনুচিত্য বিচার করবে। বাধাগ্রস্ত হবে সমাজের নৈতিক প্রগতি। এভাবে নৈতিক আপেক্ষিকতায় তৈরি হয় নৈতিক নৈরাজ্য। অবশ্য আজকাল নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদের চেয়েও বড় বাধা সেনসেশন। হঠাৎ কোনো একটা বিষয় নিয়ে সমাজে যখন অতিমাত্রায় সেনসেশন তৈরি হয় তখন মানুষের মধ্যে নৈতিক বিচারবোধ কাজ করে না। দেশপ্রেম, ধর্মপ্রেম কিংবা ফ্যাশনপ্রেমে ব্যবহৃত হয় ঢাল হিসেবে। সমাজের শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িতদের নিয়ে যেন গণপরিসরে আলোচনা না হয়, এজন্য আফিমের মতো ভূমিকা রাখে হালের সেনসেশন। সেক্ষেত্রে সমাজের এবং সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিদের নৈতিকবোধকে অকার্যকর রাখতে ভূমিকা রাখে। 

সামাজিক গতিশীলতার জন্য সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ অপরিহার্য। পাশাপাশি জরুরি একটি সাধারণ নৈতিক পাটাতন। সেক্ষেত্রে নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক বহুত্বকে পাশাপাশি রেখে পাঠ করতে পারাটা জরুরি। স্পষ্ট হওয়া জরুরি দুইয়ের মধ্যকার সীমারেখা নির্ধারণের ব্যাপারে। সে দায়িত্বটা অবশ্যই সমাজের সর্বস্তরের ওপরেই। 

আহমেদ দীন রুমি: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন