আলোকপাত

অসম বাণিজ্য সম্পর্ক ও ক্রমবর্ধমান ভারতবিদ্বেষ বোঝাপড়া

ড. মইনুল ইসলাম

ছবি : বণিক বার্তা

২০২২-২৩ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক নমিনাল ডলারের ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই নির্ধারণ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ ডলার, যার মানে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই এখনো বেশি হতে পারে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ভাষ্য মোতাবেক ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) ভিত্তিতে ২০২২ সালে ভারতের প্রাক্কলিত মাথাপিছু জিএনআই ৮ হাজার ২১০ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮৯০ পিপিপি ডলার। এর মানে, ভারতে বেশির ভাগ পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম হওয়ায় ভারতের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের চেয়ে উঁচু। প্রথমেই ‘পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি’ বা ‘ক্রয়ক্ষমতার সমতা’ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করছি। বিশ্বের দেশে দেশে যেহেতু বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম কমবেশি হয় সেজন্য বিভিন্ন দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানকে তুলনীয় করার জন্য পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নমিনাল জিডিপিকে ‘পিপিপি ডলারে জিডিপি’তে রূপান্তর করা হয়। এটা একটা যুগান্তকারী গবেষণার ফসল, কিন্তু পদ্ধতিটি বেশ টেকনিক্যাল হওয়ায় সাধারণ পাঠকদের কাছে বিষয়টি জটিল মনে হবে। (কম্পিউটার প্রযুক্তি বিপ্লবের কারণেই পদ্ধতিটির প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে)। এ পদ্ধতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকশ পণ্য ও সেবার দামকে তুলনার একক হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশে একই পণ্য ও সেবাগুলোর দাম কতখানি বেশি বা কম তার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের মুদ্রার অভ্যন্তরীণ ক্রয়ক্ষমতাকে মার্কিন ডলারের ক্রয়ক্ষমতার তুলনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ফলে যেসব দেশে পণ্য ও সেবার দাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি সে দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপি কমিয়ে আনা হয় এবং যেসব দেশে পণ্য ও সেবার দাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম সে দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেয়া হয়। সাধারণভাবে যেসব দেশের মাথাপিছু জিডিপি কম সেসব দেশে অধিকাংশ পণ্য ও সেবার দামও তুলনামূলকভাবে কম হয়, এক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের ব্যাপারটা অনেকখানি ব্যতিক্রম। বেশির ভাগ পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে বেশি। খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা—যেগুলোকে ‘মৌল চাহিদা’ বলা হয় সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে বেশি।

উল্লিখিত তুলনামূলক চিত্রের আলোকে বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে উপস্থাপন করাই বক্ষ্যমাণ কলামের লক্ষ্য। সম্প্রতি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে ভারত হেরে যাওয়ায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে কিছু বাংলাদেশী মিষ্টি বিতরণ করে, পটকা ফুটিয়ে ও মিছিল করে আনন্দ প্রকাশ করেছে, যা নিয়ে ভারতে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট টিমকে অপছন্দ করি, তাই ভারতের পরাজয়ে আমিও দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া আমাকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে চলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপনকারী ভারতীয়রা বাংলাদেশের উল্লাসকারীদের আচরণকে ‘অগ্রহণযোগ্য বিশ্বাসঘাতকতা ও অকৃতজ্ঞতা’ অভিহিত করে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে যে ভারতই বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়েছে। তাদের এমনো দাবি ছিল যে ৫২ বছর ধরে ভারতই বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে, ভারতের করুণা না পেলে এখনো নাকি বাংলাদেশের অর্থনীতি ধসে যাবে। এসব মূর্খতাপ্রসূত একপক্ষীয় আক্রমণ যে ধরনের মানসিকতার প্রতিফলন সেটাই সমস্যার মূল কারণ। দুঃখজনকভাবে এ মানসিকতায় আক্রান্ত ভারতের সিংহভাগ মানুষ। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে ভারতের সব প্রতিবেশী দেশের জনগণের মধ্যেই ভারতের ‘আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী দাদাগিরি’ ক্রমবর্ধমান ‘ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট’ সৃষ্টি করে চলেছে। ভারতের জন্মশত্রু পাকিস্তান ও ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী গণচীনের কথা বাদ দিলেও নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ৯৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও নেপালের মানুষ ভারতকে প্রচণ্ডভাবে অপছন্দ করছে, এমনকি ঘৃণা করছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পরই নেপালের জ্বালানিসহ পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ওই দেশের অর্থনীতিকে প্রায় ধসিয়ে দেয়ার বিষয়টি নেপালিরা ভোলেনি, ভবিষ্যতেও সহজে ভুলবে না। সম্প্রতি ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতি অবলম্বন করে মালদ্বীপে চীনপন্থী মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে। সাম্প্রতিক এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে আঞ্চলিক দাদাগিরির বিষয়টি ভারতীয়দের পরিত্যাগ করতে হবে।

কোনো বিবেকবান বাংলাদেশী কখনো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণের ‘ঐতিহাসিক ধাত্রীর’ ভূমিকাকে অস্বীকার করবে না। কিন্তু ‘শুধু ভারত’ বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে বললে বাংলাদেশীদের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে অবমূল্যায়ন ও অস্বীকার করা হয় না? ত্রিশ লাখ শহীদের শাহাদত এবং দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ দেশটা স্বাধীন হয়েছে—এ কথাটা ভারতীয়রা ভুলে যায় কেন? ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্যের আত্মাহুতিকে আমি কোনোমতেই খাটো করব না, শুধু প্রশ্ন করব, ওই বছরের ১ মার্চ থেকে শুরু হওয়া আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের কথা ভারতীয়রা ভুলে গেল কেন? মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের যে ঐতিহাসিক সামরিক সহযোগিতা দিয়েছে এবং প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে সেজন্য বাঙালি জাতি ভারতের সরকার ও জনগণকে আজীবন কৃতজ্ঞতা জানিয়েই যাবে। কিন্তু গত ৫২ বছরে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে সেটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া বড় ধরনের ‘মূর্খতা’ নয় কি? নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করুন:

বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করে এখনো ভারতের গলগ্রহ ও করুণা ভিক্ষুক দেশ হিসেবে যেভাবে কিছু ভারতীয় গালমন্দ করে চলেছে সেটাকে একদল অশিক্ষিত ও মূর্খ লোকের ঘৃণ্য আস্ফালন অভিহিত করা উচিত। একটা বাস্তবতা এখনো ভারতীয়দের মনোজগতে হয়তো দৃঢ়মূল হয়নি যে আজকের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই ভারতের করুণার ওপর নির্ভরশীল নয়। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ। ওই সময় ভারত বাংলাদেশকে প্রভূত অর্থনৈতিক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, সেজন্য আমরা ভারতের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। স্বাধীনতার পর ৩ বছর ৮ মাসের আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারত যেভাবে সাহায্য-সহায়তা দিয়েছে সেটাকেও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুসুলভ ছিল না। বিশেষত সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক চরম বৈরিতায় পর্যবসিত হয়েছিল। স্বৈরাচারী এরশাদের দীর্ঘ নয় বছরের শাসনামলে এবং খালেদা জিয়ার ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের শাসনামলেও এ দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল বলা যাবে না। ওই ২১ বছর ভারতের সাহায্য-সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশ কি টিকে থাকেনি? ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে এ দেশের দীর্ঘ ২১ বছরের বৈরী সম্পর্কের পরিবর্তে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আবারো ভারত বৈরিতা বাংলাদেশ সরকারের মূলনীতিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত ও বাংলাদেশের সরকারের সম্পর্ক ক্রমেই বন্ধুসুলভ হয়ে উঠেছে এবং এখনো সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো রয়েছে। তার পরও বলব, বিএনপি-জামায়াত ও ধর্ম ব্যবসায়ী দক্ষিণপন্থী দলগুলোর নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং চীনপন্থী বামপন্থীরা এখনো ভারতকে বন্ধু মনে করে না। এমনকি অনেক সাধারণ বাংলাদেশীও মনে করে, শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে অকৃপণভাবে ভারতের দাবিগুলো মেনে নিয়ে চলেছে তার বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে ন্যায্য হিস্যা এখনো দিচ্ছে না। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বিজেপির মুসলিমবিদ্বেষ এবং তিস্তা চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ এক যুগের অচলাবস্থা এই সেন্টিমেন্টকে দিন দিন উসকে দিচ্ছে। কিছুদিন পরপর এখনো বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। দীর্ঘ তিন দশকের কূটনৈতিক আলোচনার পথ ধরে যখন ২০১১ সালে দুই দেশ তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং চুক্তি স্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। আমার আশঙ্কা, যতদিন মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন ততদিন ন্যায্য শর্তে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা নেই। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের মহাসমাবেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার আশ্বাস দিয়েছিলেন, সাম্প্রতিক নির্বাচনী বক্তৃতায় ওই আশ্বাসের পুনরাবৃত্তিও করেছেন। কিন্তু এ-সত্ত্বেও আমার সন্দেহ হচ্ছে যে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও ভারতের ভেটোকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সরকার চীনের অর্থায়নে এ মহাপরিকল্পনা শুরু করতে পারবে না। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের জনমনে তীব্র সেন্টিমেন্ট সৃষ্টি হয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের অর্থনীতি গত ৫২ বছরে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য অর্জন করেছে। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা ভারতের চেয়েও ভালো করছি। আমাদের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে এখন আর উল্লেখযোগ্য ঘাটতি হচ্ছে না। যেটুকু বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি রয়েছে সেটুকু আমরা প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স এবং ‘সাপ্লায়ারস’ ক্রেডিট’ থেকে প্রায় বছর মেটাতে পারছি। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সত্ত্বেও ভারত এখন বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ/অনুদান দেয় না। উপরন্তু ভারত বাংলাদেশকে যে বৈদেশিক ঋণ দিয়েছে ওগুলো সবই এমন সব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে যে প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের চেয়েও ভারতের প্রয়োজনই বেশি মেটাবে। ‘ক্রস-বর্ডার কানেক্টিভিটি’ বাংলাদেশের যতখানি প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্সের’ জন্য। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের উপকার যতখানি বাংলাদেশ পাবে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পাবে ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’। ভারত বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম সূত্র হলেও ওই সূত্র বিঘ্নিত বা বন্ধ হলে বিকল্প সূত্র পেতে বাংলাদেশের বেশি অসুবিধা হবে না। ভারত থেকে বাংলাদেশ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, কিন্তু রফতানি করে ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম। একটা কথা ভারতীয়দের মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে পারস্পরিক বাণিজ্য সম্পর্ক ‘উইন উইন প্রোপজিশন’ না হলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় না। যেহেতু বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যপ্রবাহ ভারতকেই অনেক বেশি সুবিধা এনে দিচ্ছে—এটাকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দয়া-দাক্ষিণ্য মনে করা চরম মূর্খতা।

ভারতবিদ্বেষের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও সংঘাতের বিষয়টি। বিশেষত নরেন্দ্র মোদির বিজেপি শাসনামলে কট্টর হিন্দুত্ববাদের জোয়ার ভারতকে মধ্যযুগের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলেছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ২০১৪ সালের পর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ভারতের ২০ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠী এখন আক্ষরিকভাবেই বৈষম্যের শিকার দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে গেছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এখনো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রাণঘাতী সমস্যা হিসেবে বহাল রয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনগণের একাংশও এমন ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ ধারণ করে রয়েছে, কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কঠোরভাবে এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দমনে তৎপর থাকায় তারা এ দেশে মাথা তুলে সমাজকে দংশন করতে পারছে না। এসব সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সমর্থকদের প্রায় সবাই কট্টর ভারতবিরোধী। জনগণের এ অংশ এখনো পাকিস্তান প্রেমে বুঁদ হয়ে রয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের মতো পাকিপ্রেমী রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে এ প্রেমকে চাগিয়ে তোলায় তৎপর রয়েছে। নরেন্দ্র মোদি ভারতে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে তার মুসলিম নিধনকারী রাজনীতি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধিতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আমার আশঙ্কা, এখন বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ ভারতবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তবু বলব, ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই চাই আমরা। কিন্তু বন্ধুত্ব হয় দুই সমমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিবেশীর মধ্যে, পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার ভিত্তিতে। বিজেপির আমলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯১ শতাংশ মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, তাচ্ছিল্য ও বিদ্বেষ যদি ভারতীয়দের মনের মধ্যে গেঁথে থাকে তাহলে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের জনগণের বন্ধুত্ব দৃঢ়মূল হবে না। 

ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন