ইসলামী ব্যাংকের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যাংক হিসাব গত বছর খোলা হয়েছে

মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা

ছবি : বণিক বার্তা

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর শেষে আমাদের ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। আমানতকারীদের হিসাব সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ। ইসলামী ব্যাংকের আমানতের সিংহভাগই ব্যক্তিশ্রেণীর। দেশের সব অঞ্চলের শ্রেণী-পেশার মানুষই আমাদের গ্রাহক। এ গ্রাহকই ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমানতকারীরাই আমাদের শক্তি। যেকোনো পরিস্থিতিতে এসব গ্রাহক ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গত বছর আমরা আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে বিশেষ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছিলাম। এর প্রত্যক্ষ ফলও আমরা পেয়েছি। ২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের ইতিহাসের সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। ১০০ টাকায় চালু করা ব্যাংক হিসাবে বছর শেষে আমানতের স্থিতি লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।

আমরা হিসাব করে দেখেছি, এ মুহূর্তে দেশের প্রায় ৮ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসলামী ব্যাংক পরিবারের সদস্য। সারা দেশে বিস্তৃত রয়েছে আমাদের ব্যাংকের ৩৯৪ শাখা। এসব শাখার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে ২৪৯টি উপশাখা ও ২ হাজার ৭৭১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট। দেশের এমন কোনো বড় বাজার নেই, যেখানে এখন ইসলামী ব্যাংকের উপস্থিতি পাওয়া যাবে না। মানুষের সীমাহীন ভালোবাসার কারণেই এটি অর্জন সম্ভব হয়েছে।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসলামী ব্যাংক মানবজীবনের সংকট ও সম্ভাবনার সঙ্গে মিল রেখে প্রডাক্ট চালু করেছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মানুষের বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয়তা থাকে। আমরা সেসব প্রয়োজন পূরণের সঙ্গী হতে চেয়েছি। দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংকের স্বীকৃতি এরই প্রতিফলন। সব শ্রেণীর মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে আমাদের রয়েছে বিভিন্ন আমানত প্রকল্প। নিয়মিত চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের বিশেষ হিসাবের মধ্যে রয়েছে মুদারাবা বিশেষ (পেনশন) সঞ্চয় প্রকল্প, মুদারাবা সেভিংস বন্ড, মুদারাবা ওয়াকফ ক্যাশ ডিপোজিট হিসাব, মুদারাবা হজ সঞ্চয় হিসাব, মুদারাবা মোহর সঞ্চয় হিসাব, সিনিয়র সিটিজেনদের মাসিক মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয় স্কিম, মুদারাবা এনআরবি সেভিংস বন্ড, প্রবাসী গৃহায়ণ সঞ্চয় স্কিম, মুদারাবা মাসিক মুনাফা হিসাব, স্টুডেন্টস মুদারাবা সঞ্চয় হিসাব ও মুদারাবা কৃষক সঞ্চয় হিসাব, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়িজ সেভিংস স্কিম, উপহার ডিপোজিট চেকসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয় প্রকল্প। দেশের মানুষ এসব সঞ্চয় প্রকল্পকে নিজেদের কল্যাণে গ্রহণ করছে। এ কারণেই ইসলামী ব্যাংক দেশবাসীর আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পেরেছে।


বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এখন শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণে। এ অংশীদারত্ব ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষকে শরিয়াহ্ভিত্তিক এ ব্যাংক ব্যবস্থার পথ দেখিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর এখন দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক ইসলামী ধারার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অন্য ব্যাংকগুলোও পৃথক উইন্ডো কিংবা শাখার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দেয়া শুরু করেছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি দেশে শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের এ সাফল্যের গর্বিত অংশীদার।

অতীতের মতো এখনো আমরা দেশে শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের বিস্তৃতি বাড়াতে কাজ করছি। ইসলামিক ব্যাংকস কনসালটেটিভ ফোরাম (আইবিসিএফ) এবং সেন্ট্রাল শরিয়াহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকার্স অব বাংলাদেশসহ (সিএসবিআইবি) দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা এ লক্ষ্যে সভা-সেমিনারের আয়োজন করছে। গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয়ও আমরা সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছি। সমাজে এখনো ভুল ধারণা আছে, প্রচলিত ধারার ব্যাংকের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের কোনো পার্থক্য নেই। আসলে দুটির মধ্যে কার্যপদ্ধতি ও উদ্দেশ্যগতভাবে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক প্রফিট-লস শেয়ারিং পদ্ধতিতে আমানত গ্রহণ করে 

বিধায় গ্রাহকের পূর্বনির্ধারিত হারে মুনাফা দেয় না। সাময়িক হারে মুনাফা দেয়া হলেও চূড়ান্ত বার্ষিক হিসাব শেষে সেটি সমন্বয় করা হয়। ইসলামী ব্যাংক সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেয় না, বরং প্রয়োজনীয় পণ্য বা সম্পদ কিনে দেয়, ভাড়া দেয় বা অগ্রিম কিনে নেয়। অ্যাসেট-ব্যাকড লেনদেনের কারণে ইসলামী ব্যাংক অর্থনীতিতে ঋণের বুদবুদ তৈরি করে না। বিনিয়োগ পরিশোধে দেরি হলে ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকের মতো অতিরিক্ত সুদ আদায় করে না। তবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি নিরুৎসাহিত করার জন্য জরিমানা ধার্য করে তা সমাজকল্যাণে ব্যয় করে। যতই মুনাফা হোক ইসলামী ব্যাংক মদ, জুয়া, তামাক বা কোনো ক্ষতিকর প্রকল্পে বিনিয়োগ করে না। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই খাত পোশাক শিল্পের বিকাশ ও প্রবাসী রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আহরণে ইসলামী ব্যাংক যেমন পথিকৃৎ, তেমনি সর্বাধিক ভূমিকা পালনকারী। দেশে ছয় হাজারের বেশি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে এ ব্যাংকের অর্থায়নে। এ ব্যাংকের বিনিয়োগে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৯০ লাখ মানুষের। দেশের সিএসএমই খাতে সর্বাধিক বিনিয়োগ করেছে এ ব্যাংক। জাহাজ নির্মাণসহ পরিবহন ও আবাসন খাতে রয়েছে সর্বাধিক বিনিয়োগ। এ ব্যাংক দেশের সর্বোচ্চ আমদানি-রফতানি বাণিজ্য পরিচালনাকারী। বেসরকারি খাতে দেশের সর্বাধিক সার আমদানি হয় এ ব্যাংকের মাধ্যমে। পাশাপাশি দেশের মোট বৈদেশিক রেমিট্যান্সের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এককভাবে আহরণ করছে ইসলামী ব্যাংক। এ ব্যাংকটি দেশের ৩১ হাজার গ্রামের ১৬ লাখ প্রান্তিক পরিবারকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বীও করেছে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন