৩৫টি বাদে সব শেয়ারের ওপর থেকে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার বিএসইসির

নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ারবাজারে কর্মচাঞ্চল্য ফেরাতে ৩৫টি কোম্পানি বাদে বাকি সব শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে গতকাল এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শেয়ার ও সূচকের পতন ঠেকাতেই মূলত শেয়ারদরের সর্বনিম্ন সীমা আরোপ করেছিল বিএসইসি। তবে এর প্রভাবে বহুজাতিকসহ ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারদর এক প্রকার স্থির অবস্থায় ছিল। পুঁজিবাজার থেকে গত বছর রিটার্ন এসেছে যৎসামান্য। 

এ অবস্থায় বাজারসংশ্লিষ্টদের মধ্য থেকেও ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের দাবি জোরালো হয়ে উঠতে থাকে। বিএসইসির পক্ষ থেকেও আশ্বাস দেয়া হয়েছিল জাতীয় নির্বাচনের পর এটি প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শেয়ারের ওপর থেকে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের আদেশ জারি করা হয়েছে। আগামী রোববার থেকে এটি কার্যকর হবে। 

তৃতীয় দফায় পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপের ১০ মাসেরও বেশি সময় পর তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ২৮ জুলাই কমিশনের জারি করা আদেশ অনুসারে ফ্লোর প্রাইস ও অন্যান্য শর্ত শুধু ৩৫ কোম্পানির শেয়ারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এছাড়া শেয়ারদরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমাসংক্রান্ত ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর জারি করা কমিশনের আদেশ ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখা ৩৫ কোম্পানি বাদে বাকি সব কোম্পানির শেয়ারের জন্য প্রযোজ্য হবে।

যে ৩৫টি কোম্পানির ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, বারাকা পাওয়ার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি), বেক্সিমকো লিমিটেড, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি (বিএসসিসিএল), বিএসআরএম লিমিটেড, বিএসআরএম স্টিলস, কনফিডেন্স সিমেন্ট, ডিবিএইচ ফাইন্যান্স, ডরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিস্টেমস, এনভয় টেক্সটাইলস, গ্রামীণফোন, এইচআর টেক্সটাইল, আইডিএলসি ফাইন্যান্স, ইনডেক্স এগ্রো, ইসলামী ব্যাংক, কেডিএস অ্যাকসেসরিজ, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি, , কাট্টলি টেক্সটাইল, মালেক স্পিনিং মিলস, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ন্যাশনাল পলিমার, ওরিয়ন ফার্মা, পদ্মা অয়েল, রেনাটা, রবি আজিয়াটা, সায়হাম কটন মিলস, শাশা ডেনিম, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, শাইনপুকুর সিরামিকস, শাহজিবাজার পাওয়ার, সামিট পাওয়ার ও ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।

বিএসইসির আদেশে বলা হয়েছে, ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর জারি করা আদেশ অনুসারে শেয়ারদরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা হিসাব করা হবে। এক্ষেত্রে শেয়ারদরের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার থাকবে। এর মধ্যে শেয়ারদর ২০০ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে সার্কিট ব্রেকার প্রযোজ্য হবে। শেয়ারদর ২০০ টাকার ওপর হলে এবং ৫০০ টাকা পর্যন্ত ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্কিট ব্রেকার থাকবে। ৫০০ টাকার বেশি এবং ১ হাজার টাকা পর্যন্ত শেয়ারদর থাকলে সেক্ষেত্রে সার্কিট ব্রেকার হবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। শেয়ারদর ১ হাজার টাকার বেশি এবং ২ হাজার টাকা পর্যন্ত ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হবে। শেয়ারদর ২ টাকার ওপরে থাকলে এবং ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সার্কিট ব্রেকার হবে ৫ শতাংশ। আর শেয়ারদর ৫ হাজার টাকার বেশি হলে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সার্কিট ব্রেকার আরোপ করা হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির লেনদেনের প্রথম ও দ্বিতীয় দিন ৫০ শতাংশ ও তৃতীয় দিন থেকে স্ল্যাবভিত্তিক সার্কিট প্রযোজ্য হবে। 

কমিশন বলছে, বেশকিছু বিষয় বিবেচনা করে ৩৫টি কোম্পানির ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখা হয়েছে। তিনটি বাদে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের সব কোম্পানির ওপর ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফ্রি ফ্লোট শেয়ারের ভিত্তিতে যেসব কোম্পানি সূচকের ওঠানামায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেগুলোর ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখা হয়েছে। যে কোম্পানিগুলোর ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখা হয়েছে তার মধ্যে আটটি হচ্ছে ফ্রি ফ্লোট বাজার মূলধনের ভিত্তিতে শীর্ষে থাকা ২০ কোম্পানির অন্যতম। মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে এমন শেয়ারের ক্ষেত্রে যেগুলো সাম্প্রতিক শেয়ার বিক্রির আদেশ বেশি ছিল সেগুলোর ওপর ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখা হয়েছে, যাতে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের পর ফোর্সড সেল না আসে। এছাড়া ডিএসইএক্স সূচকে অন্তর্ভুক্ত থাকা মার্জিনেবল সিকিউরিটিজকেও এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেশকিছু নির্দেশক বিবেচনায় নিয়ে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফ্রি ফ্লোট শেয়ার, একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে শেয়ারের বেচাকেনার আদেশের মতো পাঁচ-ছয়টি বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে। আমরা অনেকদিন ধরে বিশ্লেষণ করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাজার যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে কিছুদিন পর আমরা ৩৫ কোম্পানির ওপর থেকেও ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করে নেব।’

ফ্লোর প্রাইসের কারণে গত বছর দেশের পুঁজিবাজার এক প্রকার স্থির হয়ে ছিল। এ সময় সূচকের ওঠানামা সীমাবদ্ধ ছিল ২০০ পয়েন্টে এবং আগের বছরের তুলনায় দৈনিক গড় লেনদেন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ফ্লোর প্রাইস আরোপের কারণে বাজারে থাকা শেয়ারের বড় একটি অংশই লেনদেন হয়নি এবং এতে বাজারের তারল্যপ্রবাহ কমে গেছে। ইবিএল সিকিউরিটিজের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গত বছর ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন ছিল মোট বাজার মূলধনের (ডেবট সিকিউরিটিজ বাদে) প্রায় ৬০ শতাংশ। দেশের পুঁজিবাজারে গত বছর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। ১৩টি বহুজাতিক কোম্পানির বেশির ভাগের শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসে আটকে ছিল। সার্বিকভাবে এ কোম্পানিগুলোর শেয়ারে মাত্র দশমিক ২ শতাংশ রিটার্ন এসেছে। 

এ অবস্থায় পুঁজিবাজারের অংশীজনরাও ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার হতে থাকেন। বিশেষ করে ফ্লোর প্রাইসের প্রভাবে পুঁজিবাজারে লেনদেন কমে যাওয়ার কারণে ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে। লেনদেন কমে যাওয়ার কারণে ৮০ শতাংশ ব্রোকারেজ হাউজকে পরিচালন লোকসান গুনতে হয়েছে।

প্রসঙ্গত, দেশের পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস যুগের শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চে। কভিড সংক্রমণের প্রভাবে পুঁজিবাজারে দরপতন তীব্র হয়ে উঠলে তা ঠেকাতে সে বছরের ১৯ মার্চ ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে বিএসইসি। এক বছরেরও বেশি সময় পর ২০২১ সালের ১৭ জুন ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হয়। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের অর্থনীতে অস্থিরতা শুরু হলে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে বিএসইসি। এর পাঁচ মাসের মাথায় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ১৬৯টি কোম্পানির ক্ষেত্রে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হয়। যদিও এ কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর কমতে শুরু করলে দুই মাস পরই গত বছরের ১ মার্চ আবারো ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়, যা গতকাল পর্যন্ত বহাল ছিল। ফ্লোর প্রাইসের মাধ্যমে শেয়ারদর ওঠানামা নিয়ন্ত্রণের কারণে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের রেটিংয়ে অবনমন করেছে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ গ্রুপের সাবসিডিয়ারি এফটিএসই রাসেল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন