পর্যালোচনা

বায়ান্ন বছরে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বাংলাদেশের অর্জন-বিসর্জন

মামুন রশীদ

স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে আমাদের অর্থনৈতিক যাত্রাটা অনেকটা অম্লমধুর বিষয়। আমাদের অর্থনীতির আকার অনেক বেড়েছে, আবার অনেক সংকট দীর্ঘদিন ধরেই সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছি। কোনো দেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ততক্ষণ পর্যন্ত টেকসই করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আর্থিক খাতে গভীরতা আনে এবং রফতানিমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলে। যেসব দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ক্রমাগত ৬ বা ৭ শতাংশ করে বাড়িয়েছে তারা এ পথেই এগিয়েছে। বেসরকারি খাতকে চালকের আসনে বসিয়েছে। আমরা যদি দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের মতো অর্থনীতির উত্থান পাঠ করি তাহলে দেখব প্রত্যেকেই দুটো জিনিসের ওপর জোর দিয়েছে। ভারত অবশ্য স্থানীয় বর্ধিষ্ণু বাজারের ওপরও এখন জোর দিচ্ছে। বিশাল জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় তাদের স্থানীয় বাজারও অনেক সম্ভাবনাময়। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ হিসেবে আমাদেরও স্থানীয় বাজারে সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তৈরি পোশাক খাতের মতো অনেকগুলো রফতানিমুখী খাত লাগবে আমাদের। আর্থিক খাতের গভীরতা ও প্রডাক্ট বা পরিষেবা বিবেচনায় এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। যেমন খেলাপি ঋণে আমরা পাকিস্তানের কাছাকাছি হলেও ভারত-শ্রীলংকা থেকে বেশি। এ বিষয়টির সঙ্গে সুশাসন বা গুড গভর্ন্যান্স জড়িত আছে বিধায় ভারত বাকি দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে আছে। কারা ব্যাংকের মালিক, কারা বেশি বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাচ্ছেন, মন্দ ঋণ আদায়ে কারা অভিনবত্ব ও দক্ষতা দেখাচ্ছেন, প্রডাক্ট স্বল্পতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহনশীলতা, আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনায় কতটুকু মেধা লালন করতে পারছি, আর্থিক খাতের পরিচালকদের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় অর্থনীতির প্রজেকশনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সুশাসনের ব্যাপারে যদি নজর দিই তাহলে দেখব এখানে পরিচালকরাই ব্যাংকের মালিক এবং তারা ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের কাজে হস্তক্ষেপ করেন। আমরা মাঝে একবার তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর আল্লাহ মালিক কাজেমী, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, জাপানি দূতাবাস ও আইএফসিকে নিয়ে বেটার বিজনেস ফোরাম করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন করেছিলাম। তখন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, অপারেশন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, মার্কেট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, কান্ট্রি রিস্ক ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কাজ করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন তৈরিতেও আমরা কাজ করেছিলাম। রফতানি খাত এগিয়েছে, ব্যক্তি খাতে আর্থিক যোগদান বেড়েছে, বিদেশ থেকে পড়ে এসে দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ করছে, বাবা-মার তথা পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিচ্ছে, ব্যক্তি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। রফতানি ও বেসরকারি খাতভিত্তিক অর্থনীতি হলেও আমাদের নিয়ম-কানুন সব মান্ধাতার আমলের। ফলে প্রচলিত নিয়মের খানিক পরিবর্তন আনতে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। আবার ১৯৪৭ সালের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে চলার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন যুগের সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে। আবার সবকিছুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অসীম ক্ষমতার কারণে সেখানকার শীর্ষ কর্তাদের মধ্যেও ব্যুরোক্রেটিক মেগালোম্যানিয়াক চিন্তাধারার জন্ম নিয়েছে। ধরেন, আপনি চিকিৎসার জন্য বাইরে যাচ্ছেন, আপনার ডলার লাগবে? যেতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বিদেশে সামান্য অর্থ বিনিয়োগ করবেন অনুমোদন লাগবে বাংলাদেশ ব্যাংকের। ক্রেডিট কার্ডের লিমিটের বাইরে যাবেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যেতে হবে। এ রকম বিভিন্ন কাজে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে নানা কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। ফলে সেখানে নতুন চিন্তার প্রকাশ ও বিকাশ হচ্ছে না। অথচ অন্যান্য দেশ অনেক ওপেন হয়ে গেছে। এমনকি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অনেক পরিবর্তন এনেছে। বেসরকারি খাত কিংবা বিদেশী ব্যাংক থেকে এনেও অনেককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বানানো হয়েছে। ভারত, শ্রীলংকা এমনকি পাকিস্তানের গভর্নররাও বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর বিতর্কে জড়িয়েছেন। সুদহার ও বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের সঙ্গে বিরোধ হয়েছে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের। অন্যদিকে রঘুরাম রাজন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) দায়িত্ব নিয়েই দুটো থট পেপার প্রেজেন্ট করেছিলেন। প্রথমটি ছিল ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের ওপর এবং অন্যটি হয়তো অনেকেই জানে না ইসলামিক ফাইন্যান্সের ওপর। পেমেন্ট গেটওয়ের ক্ষেত্রে উদারীকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন রঘুরাম রাজন। বর্তমান গভর্নর শক্তিকান্ত দাসও অনেকগুলো বড় কাজ করেছেন। কভিড মহামারীর সময় তার সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সম্প্রসারণে। তিনি গ্রামে-গঞ্জে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে অর্থনীতি সচল রাখতে ভূমিকা রেখেছেন। 

আমাদের এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব রয়েছে, প্রডাক্টের বৈচিত্র্য নেই এবং রয়েছে সুশাসনের অভাব। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ম্যানেজমেন্টের ওপর অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায় পরিচালকমণ্ডলীর। শ্রীলংকার মানি মার্কেটে যে প্রডাক্ট রয়েছে, এমনকি পাকিস্তানের মানি মার্কেটেও যে প্রডাক্ট রয়েছে বাংলাদেশে তা নেহাতই নগণ্য। 

আমরা যখন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণ নিই তখন দেখা যায় ওই প্রকল্প লাভজনক হতে তার পে-ব্যাক পিরিয়ড থাকে ১০-১৫ বছরের। অথচ বাংলাদেশে তিন বছরের বেশি মেয়াদি কোনো ফিক্সড ডিপোজিট নেই। বেশির ভাগ ফিক্সড ডিপোজিটের মেয়াদ হচ্ছে এক বছরের। আমরা কীভাবে ১২-১৫ বছরের পে-ব্যাক পিরিয়ডের কোম্পানিগুলোয় বিনিয়োগ করব যেখানে আমাদের আমানতই হলো সর্বোচ্চ তিন-চার বছরের? অন্যান্য দেশ কী করে? বাজারে বন্ড ছাড়ে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের উৎসাহ থাকার পরও আমরা দীর্ঘমেয়াদি বন্ড ছাড়তে পারিনি। এ কারণে আমাদের মুদ্রাবাজারে তেমন গভীরতা নেই। শ্রীলংকার মুদ্রাবাজারে গভীরতা থাকায় গত বছর সংকটে পড়লেও বেশ শক্তিশালীভাবে ফিরে এসেছে। সংকটকালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের সঙ্গে বৈঠককালে নন-রেসিডেন্ট শ্রীলংকানদের কাজে লাগিয়েছে। আমাদের ব্যাংক খাতে আরেকটি সংকটের জায়গা হলো ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর নিয়োগে ভালো চর্চা নেই, যেমনটা আছে ভারত ও শ্রীলংকার। মূলত ব্যাংক খাতে প্রচুর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট যারা চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত, দেশে-বিদেশে কাজ করা ব্যাংকার কিংবা আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কাজ করা গভর্ন্যান্স বিশেষজ্ঞদের স্বাধীন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় তারা।

আমাদের এখানে স্বাধীন পরিচালকদের বোর্ড ফি কত? মাত্র ৮ হাজার টাকা! এত অল্প টাকায় কেন আসবে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি যে পরামর্শক হিসেবে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করতে পারে? শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ম করে দিয়েছে। ব্যাংকে মিনিমাম চারটি কমিটি মিটিংয়ে উপস্থিত থাকা স্বতন্ত্র পরিচালকের সম্মানী হবে দেড় লাখ রুপি। ভারতে আরবিআই ঠিক করেছে এক লাখ রুপি। সম্মানজনক সম্মানী হলে স্বতন্ত্র পরিচালক তখন ব্যাংকের মঙ্গলের জন্য ভাবতে পারবেন, কাজ করতে পারবেন। এ দেশে স্বতন্ত্র পরিচালকদের বোর্ড ফি একদম নগণ্য। অডিট করার সময় আমরা একটা বিষয় শিখেছিলাম, আশপাশে যখন অনেক নগদ টাকা থাকে তখন কারো বেতন অপেক্ষাকৃত কম হলে তার দুর্নীতিতে জড়ানোর আশঙ্কা থাকে। এজন্য বলা হয় ক্যাশ ডিপেনডেন্ট সোসাইটিতে দুর্নীতি দমনের প্রধান অস্ত্র হলো ক্যাশলেস সোসাইটি, ক্যাশলেস ব্যাংকিং। আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলংকার মতো প্রতিযোগী দেশ আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। কেন পাকিস্তানি ও ভারতীয় ব্যাংকাররা দুবাইয়ে চাকরি পাচ্ছেন? সিঙ্গাপুর-হংকংয়ে শ্রীলংকান ব্যাংকাররা চাকরি পেলেও আমাদের ব্যাংকাররা কেন পাচ্ছেন না, তারা কেন পিছিয়ে আছেন? আমাদের পরিচালনা পর্ষদ কেন ব্যাংককে ঠিকভাবে চালাতে পারছে না, কেন এমডি-ডিএমডিদের কাজ করতে দেয়া হয় না? সময় এসেছে এসব প্রশ্ন তোলার।  

মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন