অভিমত

বাংলাদেশে মরণোত্তর অঙ্গদানের প্রাসঙ্গিকতা

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

স্ট্রোক, মস্তিষ্কে আঘাত, মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার বা অন্য কোনো কারণে যদি আমাদের ব্রেন স্টেমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাকে বলা হবে ব্রেন ডেথ। মানুষের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে ব্রেন স্টেম মস্তিষ্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর (হৃদযন্ত্র, ফুসফুসসহ অন্যান্য) নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হলো ব্রেন স্টেম। ব্রেন স্টেম অকার্যকর হয়ে গেলেও আমাদের হৃদযন্ত্রের মাংসপেশির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে লাইফ সাপোর্ট যন্ত্রের সাহায্যে আরো কিছুদিন সেই মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। যদিও তার বাকি অঙ্গগুলো অকার্যকর হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। একমাত্র নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) বিশেষ মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর (লাইফ সাপোর্ট) যন্ত্রের মাধ্যমে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস পরিচালনা করা হয় এবং অন্য অঙ্গগুলো সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, ব্রেন ডেথ নিশ্চিত হয়ে গেলে সেই মানুষটি আর ফিরে আসবে না।

ক্যাডাভেরিক হলো যাদের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায় এবং যাদের বাঁচার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় তাদেরকে ক্যাডাভেরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যদি তারা ক্যান্সার, হেপাটাইটিস, এইচআইভিসহ অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত না হয় তারা ক্যাডাভেরিক হিসেবে অঙ্গদান করতে পারে। মরণোত্তর অঙ্গদান আর ক্যাডাভেরিক অঙ্গদান এক বিষয় নয়। মানুষ মারা যাওয়ার পর শুধু তার কর্নিয়া (যা ৬ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করে) প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আইসিইউতে ব্রেন ডেথ রোগীর হার্টসহ অন্যান্য অঙ্গ সচল থাকে। ব্রেন ডেথ রোগীর ব্রেন ছাড়া সব সচল থাকে। এমন রোগী থেকে আটটি অঙ্গ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্য মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। আর ব্রেন ডেথ রোগী শুধু আইসিইউতেই পাওয়া যায়। কোনো ব্যক্তি ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত হওয়ার পর কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ বা লিভার, অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস) ও খাদ্যনালির মতো অঙ্গগুলো দান করলে অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। তবে হৃৎপিণ্ড থেমে গেলেও কর্নিয়া, অস্থি, অস্থিমজ্জা ও চর্ম প্রতিস্থাপন করা যায়। এগুলোকে ক্যাডাভেরিক প্রতিস্থাপন বলা হয়। একজন ব্রেন ডেথ মানুষের দেয়া অঙ্গগুলোর মাধ্যমে মোট আটজন মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। দুটি কিডনি, দুটি ফুসফুস, একটি হৃদযন্ত্র, একটি অগ্ন্যাশয়, পূর্ণাঙ্গ অন্ত্রনালি এবং যকৃৎ। উন্নত দেশগুলোয় ব্রেন ডেথ রোগীর শরীর থেকে অঙ্গগুলো সংগ্রহ করে অন্যের জীবন রক্ষায় ব্যবহার অনেক আগেই চালু হয়েছে। 

মৃত্যু এক অবধারিত সত্য। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এ মৃত্যুর ধরনে রয়েছে নানা মত। ঐতিহাসিকভাবে একজন মানুষকে তখনই শুধু মৃত বলা হতো, যখন তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তবে ৫০-৬০ বছর ধরে মৃত্যুর আরেকটি রূপ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেটি হলো ব্রেন ডেথ বা ব্রেন স্টেম ডেথ। এ ধারণাটি ব্যবহৃত হয় ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। আবার যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মৃত্যুকে বলা হয় হোল ব্রেন ডেথ সংযোজন করা হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনের মাধ্যমে দুই ধরনের মৃত্যুকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। একটি হলো সারকুলেটরি ডেথ (হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধজনিত মৃত্যু)। অন্যটি হোল ব্রেন ডেথ (মস্তিষ্কের পুরো কর্মকাণ্ড বন্ধ কিন্তু হৃদযন্ত্র সচল থাকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত)। সারকুলেটরি ডেথ ইংল্যান্ডেও প্রচলিত। তবে হোল ব্রেন ডেথ ইংল্যান্ডে ব্রেন ডেথ বা ব্রেন স্টেম ডেথ নামে সংজ্ঞায়িত।

আমাদের দেশের আইসিইউতেও অনেক সময় ব্রেন ডেথ রোগী ভর্তি হয়ে থাকে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের সময়মতো ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা যায় না। একটি কারণ হলো এ ধরনের মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব। তারা এই রোগীকে মৃত বলে মেনে নিতে চান না। কারণ তখনো রোগীর হৃদযন্ত্র সচল থাকে। আবার কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরাও অনাহূত বিপদের আশঙ্কায় ব্রেন ডেথ ঘোষণা এড়িয়ে যেতে চান। অনেক হাসপাতালে হয়তো ব্রেন ডেথ ঘোষণাদানকারী কমিটি থাকে না। একজন সারাহ ইসলামের মাধ্যমে আলোকিত হয়ে উঠেছে ব্রেন ডেথের ধারণা। সারাহ ইসলাম ২০ বছরের এক তরুণী। তার মা শবনম সুলতানা একজন শিক্ষক। জন্মের মাত্র ১০ মাস পরই ধরা পড়ে যে সারাহ ইসলাম টিউবেরাস স্কেলরোসিস রোগে (বিরল জন্মগত রোগ, যেখানে দেহের বিভিন্ন স্থানে টিউমার হয় যা ক্যান্সার না) আক্রান্ত। মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক বেশি, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তখন থেকে সারাহ ও তার পরিবারের যুদ্ধ শুরু হয় এই রোগটির বিরুদ্ধে। দীর্ঘ ১৯ বছর সারাহ এই রোগটির সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। সারাহ ইসলাম মেধাবী একজন ছাত্রী ছিলেন। জটিল এই রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে চারুকলায় স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি সুদক্ষ চিত্রশল্পী ছিলেন। মানবতাবাদী ছিলেন। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। তাই তার মা শবনম সুলতানা তার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে এই অঙ্গদানে সম্মতি দিয়েছেন। সম্মতি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করা হয় সঠিক অঙ্গগ্রহীতার খোঁজ। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে ছয়জন সম্ভাব্য রোগীকে পরীক্ষা করে সেখান থেকে দুজনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়। গত ১৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা থেকে জটিল এই অস্ত্রোপচার শুরু হয় এবং শেষ হয় পরদিন ভোর প্রায় ৫টার দিকে। আইন অনুযায়ী গঠিত প্রতিটি টিম এখানে সুদক্ষভাবে কাজ করেছে। প্রতিস্থাপন দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন ইউরোলজিস্ট ও ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। ইউরোলজিস্ট, নেফ্রোলজিস্ট, আইসিইউবিশেষজ্ঞ, কিডনি ফাউন্ডেশন, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান কমিটির সবাই সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে এই কাজে যুক্ত ছিলেন। 

ইসলাম ধর্মে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে কোনো বাধা নেই। ১৯৯৫ সালে মুসলিম শরিয়া কাউন্সিল অঙ্গ প্রতিস্থাপন বৈধ বলে ফতোয়া দিয়েছে। পবিত্র কোরআনুল কারিমে বলা আছে, যদি কোনো মানুষ অন্য কোনো মানুষের জীবন রক্ষা করে, তাহলে সে যেন সমগ্র জাতির জীবন রক্ষা করল। হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের স্কলারদের মতেও অঙ্গ প্রতিস্থাপন ধর্মীয় মতে গ্রহণযোগ্য এবং মানুষের জন্য একজন মানুষের সর্বোচ্চ উপহারস্বরূপ, যা মানব জাতিকে নতুনভাবে আলোকিত করবে।

মরণোত্তর অঙ্গদানে সচেতনতা বাড়াতে কিছু করণীয় অত্যাবশ্যক—

১. সমাজের সব শ্রেণীর মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে; ২. রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে তাদের সভা-সমাবেশে প্রয়োজনীয়তা বলতে হবে; ৩. সমাজের বিশিষ্টজনদের তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে হবে; ৪. বিভিন্ন গণমাধ্যমে এর প্রয়োজনীয়তা বলতে হবে; ৫. বেশি বেশি করে ক্যাডাভেরিক সভা-সেমিনার করতে হবে; ৬. ধর্মগুরুদের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মীয় সভায় বলতে হবে; ৭. সব যোগাযোগমাধ্যম যেমন—সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করতে হবে; ৮. বিভিন্ন ডকুমেন্টরি-নাটিকা তৈরি করে মানুষকে বোঝাতে হবে; ৯. ডোনার কার্ড করতে হবে। যেমন—কোনো পরিবারের কেউ অঙ্গ প্রদান করলে, কখনো তাদের প্রয়োজন হলে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন