আলোকপাত

দুর্নীতি ও পুঁজি পাচার দমন না করলে ডলার সংকট কাটবে না

ড. মইনুল ইসলাম

বর্তমানে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন, ডলারের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বিদেশে পুঁজি পাচার এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে হুন্ডির বেলাগাম আধিপত্যের মতো সমস্যায় জর্জরিত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অর্থনীতিকে আবারো স্বস্তিকর অবস্থায় নিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর দমন নীতি গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অবিলম্বে কঠোরভাবে হুন্ডি ব্যবস্থাকে দমন। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু গত পৌনে পাঁচ বছরে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম একেবারেই ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের স্মরণে আছে যে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরপর পাঁচ বছর দুর্নীতি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিশ্ব র‌্যাংকিং অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা পেয়েছিল। ওই পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম বছর ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ, পরের চার বছর ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। এরপর সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দমননীতি বাস্তবায়নের কারণে বাংলাদেশ ওই ‘ন্যক্কারজনক চ্যাম্পিয়নশিপ’ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন বর্তমানে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত হয়েছে। ফলে ২০১৪ সাল থেকে নয় বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করে চলেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ সালের বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১২ নম্বরে অবস্থান বাংলাদেশের। 

১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। (অর্থাৎ, সিআইডির দাবি ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই আসছে না। অথচ এ পরিমাণ টাকা হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে জমা হয়ে যাচ্ছে)। এর সঙ্গে আমদানির ওভার-ইনভয়েসিং, রফতানির আন্ডার-ইনভয়েসিং এবং রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রত্যেক বছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হচ্ছে, যার বড় অংশটাই পাচার হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি মোতবেক ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারেরও কম। প্রতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। এ পতনের ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভ শূন্যেও নেমে যেতে পারে।

বাংলাদেশে কার্ব মার্কেটের ডলারের দামের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক স্বীকৃত হারের ব্যবধান এখনো ৫-৬ টাকা রয়ে গেছে। এ দুই দামের এত বড় পার্থক্য শুধু হুন্ডি ব্যবস্থাকেই চাঙ্গা করছে। অর্থমন্ত্রীর মতে, প্রায় অর্ধেক রেমিট্যান্স হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশে আসে। আমার মতে, অধিকাংশ রেমিট্যান্স হুন্ডি ব্যবস্থায় দেশে আসছে। এর মানে, আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রতি বছর ২১-২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও আরো ২১-২২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বা আরো বেশি অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে! এর বেশির ভাগই হুন্ডিওয়ালাদের কাছে বিক্রীত ব্যাংকের ঋণ, যার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচারকারীর বিদেশী অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সেটার জন্য দায়ী চারটি প্রধান পুঁজি পাচার প্রক্রিয়া: ১) আমদানিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধির আড়ালে ওভার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার ২) রফতানিতে ব্যাপক আন্ডার-ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার ৩) রফতানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে রেখে দিয়ে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক এবং ৪) দেশের ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠীগুলো কর্তৃক হুন্ডিওয়ালাদের ব্যাংক ঋণের টাকা প্রদানের মাধ্যমে এর সমপরিমাণ ডলার হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার। তাই পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতেই হবে। সরকারকে মেনে নিতেই হবে যে পুঁজি পাচার বর্তমান পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। গত এক বছরে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান প্রায় ২৭ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। এশিয়ার বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় এ অবচয়ন সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামাতে না পারলে ডলারের কার্ব মার্কেটের দামের উল্লম্ফন এবং টাকার বৈদেশিক মানের এ দ্রুত অবচয়নকে থামানো যাবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে ‘বাত্ কা বাত্’ বানিয়ে রেখে পুঁজি পাচার সমস্যার সমাধান পাওয়া অসম্ভব মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদিও দাবি করে থাকেন যে তাকে কেনা যায় না তবুও সাধারণ জনগণের মনে যে বিশ্বাসটা গেড়ে বসেছে সেটা হলো দুর্নীতির ব্যাপকতা বর্তমান সরকারের আমলে অনেক বেশি।

বাংলাদেশের অনেকগুলো বড় গ্রুপের বিরুদ্ধে পুঁজি পাচারের অভিযোগ আছে। কিন্তু সেগুলোর কখনোই যথাযথ তদন্ত হয়নি। হাজার হাজার ব্যাংক ঋণ লুটেরা, দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্ট মালিক ও রাজনীতিবিদ এখন দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার করছে। এসব পুঁজি পাচারকারী জাতির ‘এক নম্বর দুশমন’। তারা যদি ব্যাপক হারে বিদেশে পুঁজি পাচার না করত তাহলে অর্থনীতি বর্তমান সংকটে পড়ত না। তাদের আমি লুটেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাঞ্জাবি-পাকিস্তানিদের ‘ভাবাদর্শিক দোসর’ মনে করি। এ ‘জাতীয় দুশমনরা’ ব্যাপকভাবে পুঁজি পাচার না করলে বাংলাদেশ উন্নয়নে হয়তো এরই মধ্যে শ্রীলংকাকে ছাড়িয়ে যেত।

এ সত্ত্বেও একটা সুখবর দিতে চাই। দুই বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার একদা সমৃদ্ধ অর্থনীতি শ্রীলংকার ‘মেল্টডাউন’। যদিও সাম্প্রতিককালে শ্রীলংকার অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে তবুও এই ‘মেল্টডাউন’ থেকে দেশটি পুরোপুরি নিষ্কৃতি পেতে কত বছর লাগে সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ২০১৯ সালে শ্রীলংকার জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৪ হাজার ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে ২০২০ সাল থেকে চার-পাঁচ বছর শ্রীলংকার মাথাপিছু জিডিপি হয়তো আর তেমন বাড়বে না। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে টাকার অবচয়নের মতো চলমান সংকটের মোকাবেলা করতে হলেও বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপি ও জিএনআইয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে। বর্তমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে বলে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাক্কলন করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় প্রায় ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৮২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, যার প্রধান কারণ ছিল এলএনজি ও তেলসহ পেট্রোলিয়াম প্রডাক্টস, ভোজ্যতেল, চিনি, গম ও সারের নাটকীয় আন্তর্জাতিক দাম বৃদ্ধি। একই সঙ্গে, আমদানি এলসি ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পুঁজি পাচারও এর জন্য দায়ী ছিল। সরকার ২০২২ সালের আগস্ট থেকে কঠোর আমদানি নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন শুরু করায় গত এক বছরে আমদানি ব্যয় প্রায় ১৬ শতাংশ কমে এসেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ‘এলসি ওভার ইনভয়েসিং মনিটরিং’ ব্যবস্থা জোরদার করায় ওভার ইনভয়েসিংও খানিকটা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সরকার যদি এ পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন ও পুঁজি পাচারের অন্যান্য পদ্ধতির বিরুদ্ধে কঠোর দমন কার্যক্রম শুরু করে তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যালান্স অব পেমেন্টসের সংকট নিরসনের পথে এগিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু ২০২৩ সালের নভেম্বরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামানো যায়নি। এর প্রধান কারণ হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৃহদংশের রেমিট্যান্স প্রেরণের ধারা চাঙ্গা থেকে যাওয়া। গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফরমাল চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্স বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের আগস্টে আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ২১ শতাংশ কম রেমিট্যান্স এসেছে ফরমাল চ্যানেলে, সেপ্টেম্বরে এসেছে মাত্র ১৩৪ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার যা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ দশমিক ৭৫ কোটি ডলার, যা কিছুটা স্বস্তিদায়ক। এরই মধ্যে আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার বাংলাদেশ পেয়ে গেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনকে শ্লথ করলেও থামাতে পারেনি। আমি মনে করি, এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ করার মতো কঠোর দমন ব্যবস্থা নিলে আগামী মাসগুলোয় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়তে শুরু করবে। পাশাপাশি দেশের শহরগুলোয় কিংবা গ্রামে যেখানেই প্রবাসীদের পরিবার পাকা বাড়ি নির্মাণ করবে তাদের বাড়ির নির্মাণ ব্যয়ের প্রয়োজনীয় অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশে আনার ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্যাংক-স্টেটমেন্ট’ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে গৃহনির্মাণের পূর্বানুমতির জন্য জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা চালু করতে হবে। তাহলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়ে যাবে এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাও থেমে যাবে। 

ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, 

একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন