ইউআইইউর গবেষণা ইনস্টিটিউট

আধুনিক উদ্ভাবনকে বাণিজ্যিকীকরণে পথ দেখাচ্ছে ইউআইইউর ‘‌আইরিক’

শফিকুল ইসলাম

ছবি: ইউআইইউ

উদ্ভাবনী কোনো আইডিয়া বা ধারণাকে বিভিন্ন ধাপে ডেভেলপ, পণ্যের ডিজাইন করে বাজারজাতকরণ, বিনিয়োগকারীকে যুক্ত করে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা— পুরো প্রক্রিয়ার জন্য ল্যাব সুবিধা, প্রযুক্তিগত সহায়তা, প্রাথমিক ফান্ডিং, ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনসহ সব ধরনের সহযোগিতা করছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) একটি ইনস্টিটিউট। ‘‌আ জার্নি ফ্রম আইডিয়া টু কমার্শিয়ালাইজেশ’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এ কাজটি করছে ইউআইইউর ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ, ইনোভেশন, ইনকিউবেশন অ্যান্ড কমার্শিয়ালাইজেশন। সংক্ষেপে আইআরআইআইসি বা আইরিক। এটি বাংলাদেশের প্রথম কোনো গবেষণা ইনস্টিটিউট যেটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার বাণিজ্যিকীকরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ ইনস্টিটিউটের অধীনে রয়েছে অ্যাডভান্স ইন্টেলিজেন্ট মাল্টিডিসিপ্লিনারি ল্যাব (এআইএমএস), ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস রিসার্চ ল্যাব, সেন্টার ফর ডিজিটাল হেলথ ইনোভেশন অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ, ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড একাডেমিয়া কোলাবরেশন সেন্টার ফর ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন এবং সম্প্রতি চালু হওয়া ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব বা ‘স্মার্ট ইউনিবেটর’। 

স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশ ও তরুণদের উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করতে দেশের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব বা ‘স্মার্ট ইউনিবেটর’ চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে গত বুধবার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি ইনোভেশন হাব উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়েছে ইউআইইউর স্মার্ট ইউনিবেটর। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং সেগুলো বাণিজ্যিকীকরণের তরুণ উদ্যোক্তাদের সহায়তা করবে এ ইনোভেশন হাব। শুধু এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই নয়, যেকোনো ব্যক্তি চাইলেই এখানকার সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে নিজেদের আইডিয়া ডেভেলপ করে দ্রুত প্রোটোটাইপ তৈরি করতে পারবেন। তহবিল প্রদানের পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সমন্বয় করে বাণিজ্যিকীকরণের সব সহায়তাই পাওয়া যাবে এখানে। 

আইরিকের অধীনে পরিচালিত একটি গবেষণাগার হলো অ্যাডভান্সড ইন্টেলিজেন্ট মাল্টিডিসিপ্লিনারি ল্যাব (এআইএমএস)। এ গবেষণাগারের সিএমইডি হেলথ নামে একটি প্রকল্প এরই মধ্যে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। যেটি প্রতি মাসে ২০ লাখ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে। এর স্বীকৃতিস্বরূপ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ অবদান রাখায় জাতীয় পর্যায়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার ২০২২’ পেয়েছেন ইনস্টিটিউটটের পরিচালক ড. খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন। 

সিএমইডি হেলথ হলো ক্লাউড বেজড মেডিকেল সিস্টেম ফর হেলথ মনিটরিং, রিস্ক প্রেডিকশন ও রেফারেল। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার সমস্যাগুলো কী, মানুষ কেন এত দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, রেফারেল ও অন্য দিকগুলোর উন্নয়নে প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করতে পারে, এদিকগুলো খতিয়ে দেখা। এটি ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ডিজিটাল স্বাস্থ্য অ্যাকাউন্ট (স্বাস্থ্য কার্ড) তৈরি এবং স্মার্ট মেডিকেল ডিভাইস যেমন আইওটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্লাউড প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের দোরগোড়ায় দক্ষ স্বাস্থ্য কর্মীদের মাধ্যমে প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা, অসংক্রামক ব্যাধি, মা, শিশু ও কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্যসেবা, অভিজ্ঞ ডাক্তারের মাধ্যমে ২৪/৭ টেলিমেডিসিন, হেলথ রেকর্ড ও কার্যকর রেফারেল সিস্টেম নিশ্চিত করে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে।

দুটি ল্যাবরেটরি ও দুটি সেন্টার নিয়ে আইআরআইআইসি বা আইরিকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। তবে এর অনানুষ্ঠানিক ভিত রচিত হয় ২০১৪ সালে। ইউআইইউর সিএসই বিভাগে কম্পিউটার বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য অ্যাডভান্স ইন্টেলিজেন্ট মাল্টিডিসিপ্লিনারি ল্যাব (এআইএমএস) নামে একটি গবেষণাগার স্থাপনের মধ্য দিয়ে। আইরিকের লক্ষ্য একাডেমি, ইন্ডাস্ট্রি এবং সরকারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং সামাজিক ও ইন্ডাস্ট্রির সমস্যাগুলোকে উদ্ভাবনী সমাধান তৈরি করার জন্য যৌথভাবে কাজ করা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যুগে নেতৃত্ব দেয়ার উপযুক্ত উদ্যোক্তা গড়ে তোলা। একাডেমিক গবেষণা ও ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সমন্বয় করে একটি স্টার্টআপ ইকসিস্টেম গড়ে তুলতে চায় ইনস্টিটিউটটির স্বপ্নদ্রস্টা খন্দকার আবদুল্লাহ আল মামুন। 

২০২১ সালে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, আইসিটি বিভাগের সহায়তায় ইউআইইউর এ ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশের প্রথম ব্রেন কম্পিউটার ইন্টারফেস রিসার্চ ল্যাব চালু হয়। এই ল্যাবে ব্রেন, নিউরোসায়েন্স, নিউরাল এবং রিহ্যাবিলিটেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বাংলাদেশে এর প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা চলছে। 

এছাড়া অ্যাডভান্সড ইন্টেলিজেন্ট মাল্টিডিসিপ্লিনারি সিস্টেম গবেষণাগারে মেশিন লার্নিং এবং ডাটা মাইনিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেম, কম্পিউটেশনাল ইন্টেলিজেন্স, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োইনফরমেটিক্স এবং এমবেডেড সিস্টেমের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক দিকগুলো কীভাবে নানা আঙ্গিকে প্রয়োগ করা যায় সেসব নিয়ে কাজ করেন ইউআইইউর গবেষকরা। এই গবেষণাগারে ২০টিরও অধিক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন গবেষকরা। 

যার মধ্যে সিএমইডি হেলথ অন্যতম। অন্যদিকে এ গবেষণাগারের দুটি প্রকল্প অটিজম শিশুদের জন্য উদ্ভাবিত ‘বলতে চাই’ এবং ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা অ্যাপ’ দুটি এনডিডি ট্রাস্ট, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে।  ক্লিনিক্যালি বৈধতা পেয়েছে স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং টুল-বিএসস্ক্যান অ্যাপ। 

বাণিজ্যিকীকরণের অপেক্ষায় রয়েছে আরো চারটি প্রকল্প। যার মধ্যে রয়েছে ডিপ-ডিপ্রেশন: মানব মস্তিষ্কে প্রাথমিক পর্যায়ে হতাশা শনাক্তকরণের স্মার্ট ডায়াগনস্টিক যন্ত্র; ফোকাসমাইন্ড: কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করতে মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারীদের একাগ্রতা বাড়ানোর জন্য একটি ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেম; কনসেনট্রেট টুডে: মনোযোগ বাড়ানোর রিয়েল-টাইম ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসভিত্তিক নিউরোফিডব্যাক সিস্টেম এবং মার্কেটব্রেইন: উন্নত বিপণন গবেষণার জন্য একটি নিউরোমার্কেটিং সিস্টেম। এসব গবেষণা প্রকল্প সামাজিক ও ইন্ডাস্ট্রির নানা সমস্যার সমাধান তৈরি করেছে, যা দেশে প্রযুক্তি আমদানি কমাবে, বাড়াবে রফতানি। নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে অবদান রাখবে জিডিপিতে।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন