বিশ্লেষণ

অবাধ নিরপেক্ষ অর্থবহ নির্বাচনের জন্য করণীয়

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

অবাধ, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচনের জন্য দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা বহুদিনের। কয়েকবার দেশ বদল হয়েছে, ডজন ডজনবার সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু দেশে এখনো অবাধ, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচনের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়নি। নির্বাচনের নামে শাসকরা প্রহসন ও তামাশা সংঘটিত করে চলেছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অনিশ্চয়তা, অচলাবস্থা ও নৈরাজ্য। দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বারবার হুমকির মুখে পড়ছে। এ পরিস্থিতির নিরসন আজ একটি জরুরি জাতীয় কর্তব্য হয়ে উঠেছে। সে কারণে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচনের তাৎপর্য ও তার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা-কাঠামো সম্পর্কে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

‘প্রকৃত গণতন্ত্রে’র ভিত্তি হচ্ছে বহুমাত্রিক। এর যেমন রয়েছে নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক মাত্রিকতা, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক নানা উপাদান। উৎপাদন-উপকরণের ওপর সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, শ্রেণীগত শোষণ-বৈষম্যের অবসান, সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে জনগণের সমবেত ইচ্ছাশক্তির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, জাতিগত-ধর্মগত-জেন্ডারগত সমঅধিকারের নিশ্চয়তা—এসব হলো ‘প্রকৃত গণতন্ত্রে’র অপরিহার্য শর্ত।

‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ ও সমাজ-বিপ্লবের লক্ষ্যে গণমানুষের সংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি এবং তা এগিয়ে নেয়ার প্রয়োজনে, বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেও গণতন্ত্রের বহুমুখী উপাদানগুলো যথাসম্ভব প্রসারিত ও গভীরতর করার চেষ্টা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘রাজনৈতিক-গণতন্ত্রে’র মর্মবস্তু ও তার বাহ্যিক উপাদানগুলো দৃঢ়, বিস্তৃত ও গভীরতর করা।

সব নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা, সমান নাগরিক অধিকারের গ্যারান্টি, চিন্তা ও বিবেকের পূর্ণ স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জাতি-ধর্ম-জেন্ডার নির্বিশেষে সব দেশবাসীর ওপর জনগণের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ও তার বাস্তবায়নে জনগণের কার্যকর কর্তৃত্ব—এসব হচ্ছে ‘রাজনৈতিক-গণতন্ত্রে’র মর্মবস্তু। এ মর্মবস্তুর যথাযথ প্রতিফলনের জন্য প্রয়োজন ‘রাজনৈতিক গণতন্ত্রে’র কাঠামোগত ব্যবস্থা ও বিধি-বিধানের সুনির্দিষ্ট বিকাশ। ‘নির্বাচন’ হলো এসব কাঠামোগত ব্যবস্থার একটি অন্যতম প্রধান উপাদান।

‘প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি আবশ্যিক শর্ত হলো ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন। প্রতিনিধি নির্বাচন যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে ‘প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে’র বিশ্বাসযোগ্যতাও যে ক্ষুণ্ন হবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সেজন্য একটি যথোপযুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থা ও তার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা ‘রাজনৈতিক-গণতন্ত্রে’র জন্যই একটি আবশ্যিক শর্ত। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রত্যেক নাগরিকের সমান সুযোগ এবং অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা ও মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচনের প্রাথমিক ও মৌলিক উপাদান।

অবাধ, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচন নিশ্চিতের জন্য কেবল কিছু লোক দেখানো সংস্কারে কাজ হবে না। এজন্য এখন প্রয়োজন গোটা নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। সেই লক্ষ্যে নিম্নলিখিত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তদারকি সরকার ও নির্বাচনের আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া:

দলীয় সরকারকে পদত্যাগ করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তদারকি সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সংকুচিত হয়ে যাবে এবং তা অন্তর্বর্তীকালীন ও তত্ত্বাবধানমূলক কিছু রুটিন কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে—এ বিষয়টি উল্লেখ করে সংবিধানের সংশোধন করতে হবে। অভিজ্ঞতায় এ কথা প্রমাণিত যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা অবাধ-নিরপেক্ষ হয় না। আগামীতেও সে রকমই ঘটবে। তাই নির্বাচন হতে হবে ‘নির্বাচন কমিশনের’ অধীনে, কোনো ধরনের দলীয় ‘সরকারে’র অধীনে নয়।

বস্তুত সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে নির্বাচন পরিচালনার সময়কালে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘নির্বাচনকালীন সরকারে’র কর্তৃত্বের চেয়ে ‘নির্বাচন কমিশনে’র কর্তৃত্ব ঊর্ধ্বে থাকবে। অথচ ‘স্বাভাবিক সময়ের সরকারে’র হাতে নির্বাহী ক্ষমতা নিরঙ্কুশ থাকবে বলে সংবিধানের অন্যত্র বলা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে সংবিধান অনুসারে ‘স্বাভাবিক সময়ের সরকার’ ও ‘নির্বাচনকালীন সরকার’—এ দুটি সরকার তার কর্তৃত্ব-ক্ষমতা-চরিত্রের দিক থেকে পৃথক। এ বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে সুনির্দিষ্ট করতে হবে এবং তা বাস্তবে কার্যকর করতে হবে।

সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনের আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার বিধান কার্যকর করতে হবে।

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন:

জাতীয় সংসদে ‘এলাকাভিত্তিক একক প্রতিনিধিত্বে’র বদলে ‘জাতীয়ভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।

(ক) জাতীয় সংসদকে হতে হবে প্রধানত জাতীয় নীতিনির্ধারণ ও আইন প্রণয়ন করার এবং রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাজকর্ম তদারক করার সংস্থা। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা স্থানীয় উন্নয়নকাজ, প্রশাসনিক কাজ অথবা এ ধরনের স্থানীয় অন্য কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। তারা শুধু জাতীয় নীতিনির্ধারণ, আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাজকর্ম তদারক করা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। স্থানীয় সব উন্নয়নমূলক ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাজকর্ম সেই এলাকার নির্বাচিত স্বশাসিত স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। এ ব্যবস্থার ফলে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ও প্রশাসনের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকারের প্রকৃত ক্ষমতায়ন এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তৃণমূলে জনগণের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ গভীরতর করা সহজতর হবে; (খ) এরূপ ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা অনুযায়ী নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদের নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত কাজকর্ম সম্পর্কে নীতি-কর্মসূচি-প্রস্তাবনা-পরিকল্পনা বর্ণনা করে রাজনৈতিক দলগুলো দেশবাসীর সামনে নিজ নিজ ইশতেহার উপস্থিত করবে। দেশবাসী এসব ইশতেহারের মধ্য থেকে যে দলের ইশতেহারে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাবে এবং তার বাস্তবায়নে সেই দলের আন্তরিকতা-সক্ষমতা আছে বলে মনে করবে, সেই দলের মার্কায় ভোট দেবে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই দল জাতীয় সংসদে তত শতাংশ সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাবে। ঐকমত্যের প্রয়োজনে নতুন ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের পাশাপাশি বর্তমান ‘এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থাও আংশিকভাবে (অর্ধেক আসনে) অব্যাহত রাখা যেতে পারে। [সবার মতামতের ভিত্তিতে এ অনুপাত কমবেশি করা যেতে পারে।]; (গ) ইশতেহার ঘোষণার পাশাপাশি প্রতিটি রাজনৈতিক দল সংসদে আসন নেয়ার জন্য নির্বাচনের আগেই তাদের দলের অগ্রাধিকারক্রম অনুসারে প্রতিনিধিদের তালিকা দেশবাসীকে জানিয়ে দেবে। নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট অনুসারে যে ক’টি আসন সেই দলের প্রাপ্য হবে, তালিকার ক্রমানুসারে সেই ক’জন ব্যক্তি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন। এক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীদের পৃথক দুটি তালিকা করতে হবে। সংসদে নারী ও পুরুষ সদস্যদের সংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অনুপাতের বিধান করা হবে এবং নির্ধারিত সেই অনুপাত মোতাবেক দুটি তালিকা থেকে নাম নিয়ে তাদের নির্বাচিত বলে গণ্য করা হবে; (ঘ) এ ব্যবস্থায় সংসদ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কাজে দলীয় প্রধানের বা নেতৃত্বের কোটারির স্বেচ্ছাচারিতার আশঙ্কা রোধ করার জন্য দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা বিধিবদ্ধভাবে বাধ্যতামূলক করা হবে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হবে।

নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার সাধন:

নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করার জন্য

(ক) রাষ্ট্র কর্তৃক প্রার্থীদের সব নির্বাচনী ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা কমিয়ে ৩ লাখ টাকা নির্ধারণ করতে হবে; (খ) প্রার্থী নিজে বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কেউ, যারা যেভাবেই নির্বাচন কাজে অর্থ ব্যয় করুক, তা প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং কোনোক্রমে নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন করতে দেয়া হবে না। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় নির্ধারিত একজন কর্মকর্তাকে এ ব্যয় মনিটর করতে হবে এবং তাকে নির্বাচন কমিশনের কাছে সে সম্পর্কে নিয়মিতভাবে প্রাত্যহিক রিপোর্ট দিতে হবে। এই রিপোর্টের সঙ্গে প্রার্থীর দেয়া নির্বাচনী ব্যয়ের বিবরণ মিলিয়ে দেখতে হবে; (গ) প্রার্থীর নির্বাচনী আয়-ব্যয়ের বিবরণ সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে উন্মুক্ত দলিল হিসেবে রাখতে হবে এবং প্রচারমাধ্যমকে তা সরবরাহ করতে হবে। এ বিষয়ে যেকোনো ভোটারের আপত্তি জানানোর সুযোগ রাখতে হবে; (ঘ) নির্বাচনী কাজে আয়-ব্যয়ের হিসাব সাতদিনের মধ্যে জমা দিতে হবে এবং তা করতে না পারলে অথবা নিরীক্ষা করে তা ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হলে নির্বাচিত সদস্যের শপথগ্রহণ বন্ধ রাখতে হবে। ওই বিবরণীর যথার্থতা যাচাইয়ের দ্রুত ও উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে; (ঙ) (নির্বাচন কমিশনের কাছে) আয়-ব্যয় ও সম্পদের মিথ্যা তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে; (চ) ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ প্রদান করে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে প্রার্থীদের সব ধরনের নির্বাচনী ব্যয় বহনের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

প্রার্থীদের সম্পদ ও পরিচয় প্রকাশার্থে

(ক) প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই তার নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের সম্পদের বিবরণ, কোনো রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার স্বার্থ জড়িত আছে কিনা ইত্যাদি সম্পর্কে বিবরণ দাখিল করতে হবে; (খ) প্রার্থীদের কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কিনা তা নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে; (গ) নির্বাচন কমিশনকে এসব তথ্যের সত্যতা যথাসম্ভব যাচাই করে তা জনগণকে অবহিত করার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ভোটাররা প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা সম্পর্কে অবগত থাকেন।

নির্বাচনে সবার সমসুযোগ 

(ক) পোস্টার, লিফলেট, বৈদ্যুতিক বিজ্ঞাপন, মাইক, নির্বাচনী ব্যানার, দেয়াল লিখন, গেট নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে যেসব নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা আছে তা ব্যতিক্রমহীনভাবে পালন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকেই ‘সুয়োমটো’ ব্যবস্থা নিতে হবে। তফসিল ঘোষণার আগে এ ধরনের প্রচারণা চালানোর বিষয়েও বিধিবিধান প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে; (খ) নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন থেকে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় নির্বাচনী কর্মকর্তার মাধ্যমে সব প্রার্থী ও দলের সমাবেশ, মহাসমাবেশ, র‌্যালি, জনসভা ও অন্য সব নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আচরণবিধি ও অন্যান্য বিধি-বিধান মেনে চলা হচ্ছে কিনা তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনিটরিং ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; (গ) নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রজেকশন মিটিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; (ঘ) রেডিও-টিভিতে প্রচারের সময়কে সমানভাবে বণ্টন এবং এ বিষয়ে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন খরচের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। 

(ঙ) এসব প্রতিটি বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং লঙ্ঘনকারীদের প্রার্থিতা বাতিল করাসহ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে; (চ) যেকোনো প্রার্থীকে যেকোনো সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে।

প্রার্থী মনোনীত হওয়ার যোগ্যতা 

(ক) স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতাকারী বা যুদ্ধাপরাধী হলে, নিজে অথবা পরিবারের কেউ ঋণখেলাপি কিংবা ঋণখেলাপির জামিনদার হলে, কালো টাকার মালিক বলে বিবেচিত হলে, সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ অথবা চাকরিচ্যুতির পাঁচ বছর অতিক্রম না করলে কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রেও এ বিধি প্রযোজ্য হবে; (খ) রাজনৈতিক দলের মনোনয়নপ্রার্থী হতে হলে তাকে কমপক্ষে তিন বছর দলের সদস্যপদ নিয়ে এবং জনগণকে অবহিত রেখে দলের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে হবে; (গ) দলের মনোনয়নপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তৃণমূল থেকে স্বচ্ছ মনোনয়ন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে ও দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ এবং মনোনয়নপ্রাপ্তির জন্য অর্থ দিয়ে প্রভাবিত করার ঘটনা কার্যকরভাবে রোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে; (ঘ) জামানতের পরিমাণ হ্রাস (৫ হাজার টাকা) অথবা প্রার্থীর আয়ের অনুপাতে (১ শতাংশ) নির্ধারণ করতে হবে; (ঙ) অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। 

সন্ত্রাস, পেশিশক্তির প্রভাব ও দুর্বৃত্তমুক্ত নির্বাচন 

(ক) নির্বাচনে সব ধরনের বল প্রয়োগ, অস্ত্র বহন ও প্রদর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এ ধরনের ঘটনায় কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে; (খ) কোনো প্রার্থী অথবা রাজনৈতিক দলের পক্ষে পেশিশক্তির মহড়া, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন, নির্বাচনী কাজে সন্ত্রাসী-অপরাধী ব্যক্তিকে ব্যবহার ইত্যাদি কঠোরভাবে রোধ করতে হবে।

নির্বাচনে ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতার অপব্যবহার রোধ 

(ক) নির্বাচনে ধর্মের সব ধরনের অপব্যবহার ও সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণার ভিত্তিতে ভোট চাওয়া নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে; (খ) ধর্মীয় উপাসনালয়, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, মঠ, ওয়াজ মাহফিল, ধর্মসভা ইত্যাদি স্থান বা অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচার না চালানো, পোস্টার-হ্যান্ডবিল ইত্যাদি বিলি নিষিদ্ধ করতে হবে; (গ) ‘আঞ্চলিকতা’র ধুয়া তুলে প্রচারণা ও ভোট চাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে।

রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে 

(ক) নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক বিধি-বিধানের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া, দলের কর্মকর্তাদের নিয়মিত নির্বাচন, দলের আর্থিক বিবৃতি ইত্যাদি বাধ্যতামূলক করতে হবে; (খ) নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের টেকনিক্যাল বিষয়াদি সম্পর্কে রাজনৈতিক কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী কর্তৃক আচরণবিধি অনুসরণ 

(ক) নির্বাচনী আচরণ বিধিতে যা রয়েছে তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে আচরণবিধি অনুসরণের অঙ্গীকার করতে হবে ও সেক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য কেন্দ্র ও জেলা পর্যায়ে সর্বদলীয় পরামর্শ কমিটি গঠন করতে হবে; (খ) অভিযোগ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে নির্বাচন কমিশনকে নিজ দায়িত্বে মনিটরিং ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে আচরণবিধি অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।

নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন 

সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরাসরি ভোটে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

প্রতিনিধি প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা প্রবর্তন 

নির্বাচিত প্রতিনিধি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে ভোটাররা যাতে ওই প্রতিনিধি প্রত্যাহার করতে পারেন তার বিধান প্রবর্তন করতে হবে।

‘না’ ভোট 

প্রার্থী বা দলের মধ্যে কেউই সমর্থনযোগ্য নয় বলে কারো কাছে বিবেচিত হলে সেক্ষেত্রে ‘না’ ভোট প্রদানের বিধান ও ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে 

(ক) ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রচারমাধ্যমে লাগাতার প্রচার করতে হবে এবং ক্রস চেকিং ব্যবস্থাসহ ভোটার তালিকা প্রতিনিয়ত নবায়ন করার স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। কম্পিউটারাইজড ভোটার তালিকা বিনা মূল্যে সরবরাহ ও ভোটারদের জন্য আইডি কার্ডের ব্যবস্থা ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; (খ) ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’ অনুযায়ী যথাযথ নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; (গ) প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ ও তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে; (ঘ) প্রবাসী, কারারুদ্ধ ও নিজ ভোট কেন্দ্র থেকে দূরে কর্তব্যরত ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালট প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

নির্বাচনী এলাকা ও নির্বাচন পরিচালনা 

(ক) যতদিন ও যেসব ক্ষেত্রে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা’ প্রবর্তন না হচ্ছে ততদিন সাধারণভাবে ভোটারের সমসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের জন্য প্রকাশ্য শুনানির ব্যবস্থা আরো স্বচ্ছ, উন্মুক্ত ও কার্যকর করতে হবে; (খ) প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের তালিকা এবং ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের তালিকা নির্বাচনের কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগেই দল অথবা প্রার্থীদের সরবরাহ করতে হবে, যাতে এ বিষয়ে কোনো আপত্তি উঠলে তা নির্বাচনের আগেই নিষ্পত্তি করা যায়।

নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা ও সে সম্পর্কিত বিরোধ 

(ক) ভোট কেন্দ্রে সবার উপস্থিতিতে নির্বাচনের ভোট গণনা ও তার ফলাফল ঘোষণা এবং ওই ফলাফলের স্বাক্ষরিত কপি দল অথবা প্রার্থীর মনোনীত ব্যক্তিকে প্রদান করতে হবে; (খ) নির্বাচনের ফলাফল কেবল নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করবে; (গ) নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের কার্যরত বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত পর্যাপ্তসংখ্যক নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সে বিষয়ের নির্বাচনী মামলা দুই মাসের মধ্যে মীমাংসার ব্যবস্থা এবং এ সংক্রান্ত কোনো আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বেঞ্চ কর্তৃক তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।

নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইন ও বিধির সংস্কার 

(ক) সংবিধানের নির্দেশনা মেনে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য উপযুক্ত আইন ও বিধি প্রণয়ন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মক্ষম সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে; (খ) নির্বাচন কমিশনকে আর্থিকভাবে পরিপূর্ণ স্বাধীন করতে হবে এবং এজন্য বাজেটে এমনভাবে সরাসরি বরাদ্দ প্রদান করতে হবে যাতে ওই অর্থ ছাড় করার ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তৃত্ব না থাকে; (গ) নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের সচিবালয়ের কাজ নিশ্চিত করতে হবে এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে স্বতন্ত্র টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক, কম্পিউটারাইজড ভোটার তালিকা ব্যবস্থাসহ আধুনিক ব্যবস্থায় সজ্জিত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনই তার কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে। নির্বাচন কমিশনকে সব সময়, বিশেষ করে নির্বাচনের সময় যথেষ্টসংখ্যক জনবল ও পর্যাপ্ত সম্পদ সরবরাহ করতে হবে; (ঘ) নির্বাচন কমিশনকে রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার এবং নির্বাচনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। নির্বাচনকালে নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশনে ন্যস্ত হবেন এবং এ সময়কালে তারা কোনো অপরাধ ও কর্তব্যে অবহেলা করলে সেজন্য নির্বাচন কমিশন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে এবং সরকার প্রশাসন তা মানতে বাধ্য থাকবে; (ঙ) নির্বাচনী বিধি প্রণয়নের অধিকার নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত করতে হবে; (চ) নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের জন্য নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বাতিল করার এবং আইন লঙ্ঘনকারীদের আটক ও কারাদণ্ড প্রদান করার অধিকার দিতে হবে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: রাজনীতিক ও কলামিস্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন