তরুণদের স্থূলতা

তরুণদের স্থূলতা: অনেক অসুখের মূল

অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী

ছবি: ন্যাশনাল রিভিউ

তরুণদের স্থূলতা প্রধান অসুখ অথবা অনেক অসুখের মূল হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। স্থূলতাকে স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে ধরা হয়। বিষয়টি উদ্বেগের পর্যায়ে চলে গেছে। তরুণদের মধ্যে স্থূলতা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। উচ্চতা অনুযায়ী ওজনের একটা স্কেল রয়েছে, যা বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) দিয়ে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ বা ভারত অঞ্চলের মানুষের জন্য বিএমআই পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় ভিন্ন হতে পারে।

অতিরিক্ত ওজন বা অতিরিক্ত মেদ যা- বলা হোক না কেন চর্বিটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। যেটা সেন্ট্রাল ওবেসিটি, যা শরীরের সব জায়গায় ছড়িয়ে যায়। আর কতগুলো রয়েছে যেখানে মেদটা প্রথমে বেশি করে জমা হয়। সবগুলো মিলিয়ে স্থূলতা মূলত শরীরের ইনসুলিনের সমস্যা তৈরি করে। কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন, শর্করা সবকিছুর বিপাক প্রক্রিয়ায় ইনসুলিনের অভাবে অনেক অসুখ তৈরি হয়। উঠতি বয়সেই যখন ধরনের ওজন আধিক্য শুরু হয়, ওজন আধিক্যের কারণে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ওজন আধিক্য পরিণত বয়সে বা তরুণ বয়সে এক ধরনের সমস্যা তৈরি করে। ইনসুলিন যদি কাজ করতে না পারে, জীবকোষে সেটাকে বলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থেকে তখন ব্লাড গ্লুকোজ বাড়তে শুরু করে।

তরুণ বয়সে অন্য কোনো বিশেষ সমস্যা না থাকলেও যে জন্মগত ইনসুলিনটা পায় সেই ইনসুলিন পেয়ে রক্তের ইনসুলিনের পরিমাণ বেড়ে যায়, এটাকে আসলে হাইপার ইনসুলিন বলে। সেটা আবার ইনসুলিনের ডিস্ট্যান্স থেকে যতক্ষণ লিপিড প্রোফাইলের পরিবর্তন হতে থাকে, গ্লুকোজও পরিবর্তিত হয়। অনেকেই তখন হয়তো ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন। এসব রোগের বীজ স্থূলতার কারণে হয়ে যায়। পরিণত বয়সে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, লিভার কিডনি রোগ হয়ে থাকে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থূলতা ক্যান্সারের ঝুঁকিও তৈরি করে। সব ক্ষেত্রে সময় বীজগুলো বপন শুরু হয়। সেজন্যই কিন্তু তরুণ বয়সে বিষয়গুলো ঘটে যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাই, পরিণত বয়সে (৩০-৪০ বছর) এমন রোগ হচ্ছে যেটা বৃদ্ধ বয়সে হওয়ার কথা। ৩০-৪০-এর কোটায় আমাদের নানা অসুখ হতে শুরু করেছে, সেটার প্রধান কারণ অনেক আগেই ঘটছে। বিশেষ করে যেসব তরুণী মা হচ্ছে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারীদের বিয়ে হচ্ছে, স্থূলত নারীদের গর্ভের সন্তানের জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস (গর্ভাবস্থায় রক্তে শর্করার হার বেড়ে যায় ) হয়ে থাকে। সি সেকশন বা সিজারিয়ান ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফলে গর্ভের সন্তান অনেক বড় হয়ে যায়। প্রসবের সময় বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ওই শিশু জন্মকাল থেকেই বা গর্ভে থেকেই অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। আমাদের তরুণদের জীবনাচার দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বিষয়টি ঘটছে আমাদের সম্মিলিত সমস্যা অবহেলার কারণে। আমাদের খাদ্যাভ্যাস ঠিক নেই। খাদ্যের তালিকায় চাল, ডাল শস্যদানা নেই। আমরা প্রক্রিয়াজাত, কোমলপানীয় পরিশোধিত খাদ্য গ্রহণ করছি। কোমলপানীয় বা এনার্জেটিক ড্রিংক যেখানে রিফাইন সুগার যেমন মনোস্যাকারাইড, সোডিয়াম ক্লোরাইড চিনিজাতীয় পদার্থগুলো ক্ষতিকর। কারণ সেগুলো এনার্জি ড্রিংস বা বার্গারে লবণ (টেস্টিং সল্ট) খাবারকে মুখরোচক করলেও এসব শরীরে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি করে। কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে। এছাড়া ক্ষতিকর লিপিডের পরিমাণ সেগুলো বৃদ্ধি করে। আদর্শ খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে, শারীরিক পরিশ্রম নেই, আমরা এসবের জন্য দায়ী। এমন নগর পরিকল্পনা করা হয় যাতে হাঁটাচলার জায়গা নেই। এমনকি শিশুদের খেলার সময় তাদের খেলার মাঠেও এখন আর দেখা যায় না। জেলায় স্কুলগুলোর খেলার মাঠেও সাধারণত খেলতে দেয়া যায় না। স্মার্টফোন বা কম্পিউটার স্ক্রিনে আমাদের সন্তানদের চোখ আটকে গেছে। ফোনের প্রতি আসক্তি তাদের শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার স্পৃহা নষ্ট করে ফেলেছে। হাঁটাচলা বা ব্যায়াম না হলে তরুণদের শরীরেও ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করে না। তখন ওজন আধিক্য হয়ে যায়।

নতুন প্রজন্মকে আধুনিকতার নামে ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আমরা তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করাচ্ছি, যেটা মোটেও কোনো স্বাস্থ্যকর খাবার না। মৌলিক খাবার বাদ দিয়ে আমরা প্রক্রিয়াজাত খাবারকে আধুনিকতা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখছি। সন্তানদের চলাফেরার ব্যবস্থা যতটুকুইবা আছে তা- বাসায় আটকে রাখার কারণে নষ্ট হচ্ছে। যদি কোনো গবেষণা খোঁজা হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে স্থূলতার হার স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ৩০-৩৫ শতাংশ রয়েছে, এমনকি ৪০ শতাংশও পাওয়া যাচ্ছে। হার মেয়েদের মধ্যে বেশি রয়েছে বলে আগামীতে মেয়েদের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো তৈরি হবে। এতে তাদের শিশুদেরও ঝুঁকি তৈরি হবে। সব মিলিয়ে আমরা মহা এক সমস্যার মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। আমাদের মানসিক বৈকল্য থেকে শুরু করে অনেক কিছুর মধ্যে ওজন আধিক্যের বড় একটি সম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।

স্থূলতা অনেক রোগকে প্রভাবিত করে। স্থূলতা ডায়াবেটিস তৈরি না করলেও হৃদরোগ, রক্তনালির রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। স্থূলতা থাকলে এসব রোগের ঝুঁকি চার গুণ বেড়ে যায়। উচ্চরক্তচাপের কারণে এসব রোগ প্রভাবিত হয়, আবার স্থূলতার কারণে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি থাকে। উচ্চরক্তচাপ বা গ্লুকোজি একসঙ্গে থাকলে কিডনির সমস্যা হয়। স্নায়বিক রোগের ঝুঁকি তৈরি হয়। ফ্যাটি লিভারের অসুখ হতে পারে। এমনকি অটিজমের পরিমাণও বাড়বে। মানসিক বৈকল্য তৈরি হয়। বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা রাখে স্থূলতা। স্থূলতা বহু রোগ সৃষ্টি এবং বহু রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।

লেখক: অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী, চিকিৎসাবিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন