কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে খাদ্যপণ্য রফতানিতে বাংলাদেশে নেতৃত্বের ভূমিকায় আছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? আপনাদের এ প্রেরণাদায়ী যাত্রা সম্পর্কে জানতে চাই।
১৯৯৭ সালে ফ্রান্সে কৌটায় আনারস রফতানির মাধ্যমে আমাদের রফতানির পথচলা শুরু হয়। প্রথম চালান থেকে আমাদের রফতানি আয় ছিল মাত্র ১ হাজার ১০০ ডলার। আমার প্রয়াত পিতা আমজাদ খান চৌধুরী আমাকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য বিপণনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বিশ্বের অনেক জায়গায় ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা থেকেই তিনি আমাকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন। সে সময় আমাকে ভারতের ত্রিপুরা পাঠিয়েছিলেন যেন সেখানে আমরা ব্যবসা করতে পারি। আমরা কিন্তু ভারতের মাটিতে ব্যবসা শুরু করি ত্রিপুরা থেকেই। চানাচুর রফতানি দিয়ে শুরু হয়েছিল ভারতযাত্রা। এখন ভারতের প্রায় সব রাজ্যে প্রাণ পণ্য পৌঁছে গেছে। শুধু তাই নয়, প্রাণের পটাটা ও লিচি ড্রিংকসহ কয়েকটি পণ্য এখন ভারতীয় ভোক্তাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়।
রফতানির শুরুর দিকে আমি প্রচুর সময় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যয় করেছি এবং সেটি এখনো ধারাবাহিকভাবে করে যাচ্ছি। আমরা বিশ্বাস করতাম প্রবাসী বাংলাদেশীরা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হবে এবং তাদের মাধ্যমে সেসব বাজারে আমরা সহজে প্রবেশ করতে সক্ষম হব। লক্ষ্য ঠিক রেখে পণ্য পাঠাতে শুরু করলাম এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেলাম। আমরা দেখলাম, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের স্থানীয় লোকজনও প্রাণের পণ্য কিনছে। আমরা তাদের চাহিদা বুঝতে চেষ্টা করলাম এবং সেভাবে পণ্য পাঠাতে শুরু করলাম। এখন মধ্যপ্রাচ্য প্রাণের পণ্য রফতানির দ্বিতীয় গন্তব্য। আমরা এখন ইউরোপে প্রচুর পরিমাণ ফ্রোজেন ফুডস, কালিনারি আইটেম, কনফেকশনারি পণ্য রফতানি করছি।
আপনাদের পণ্যের বাজার কোন কোন দেশে বিস্তৃত হয়েছে? কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা বেশি?
ভারত আমাদের জন্য প্রধান বাজার। শুরুতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যে আমাদের পণ্য পাওয়া গেলেও এখন পুরো ভারতে আমাদের পণ্য ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যবসার প্রসারের জন্য আমি বেশির ভাগ সময় মধ্যপ্রাচ্যে থাকি। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের সম্ভাবনা বিপুল। আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশে প্রাণ পণ্যের এখন ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। আফ্রিকা নিয়েও আমি প্রচণ্ড আশাবাদী। সেখানেও আমি প্রচুর সময় কাটাই। আফ্রিকায়ও মানুষের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের ডিমান্ড বাড়ছে। সেখানে আমরা পণ্য রফতানি করছি।
আমাদের উল্লেখযোগ্য পণ্য হলো ফ্রুট ড্রিংক, স্ন্যাকস, বিস্কুট, ক্যাচআপ, সস, নুডলস, জেলি, মসলা, সুগন্ধি চাল, কনফেকশনারি ও ফ্রোজেন ফুড।
বলা হয় বাংলাদেশের রফতানি খাতে বৈচিত্র্য কম। এক্ষেত্রে কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্য রফতানিতে আপনাদের সাফল্যকে অনেকে দেশের অর্থনীতির জন্য সুসংবাদ হিসেবে দেখেছেন। রফতানি পণ্যের ঝুড়িতে বৈচিত্র্য বাড়াতে কৃষিজাত পণ্য সামনের দিনে কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?
সারা পৃথিবীতে এখন তাজা কৃষিপণ্যের চাহিদা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং ভোক্তারা প্রক্রিয়াজাত পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। কেননা কৃষিতে সঠিক প্রক্রিয়াকরণ পণ্যকে এখন মানুষ নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছে। তাই বাংলাদেশ কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। ভিয়েতনাম কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রফতানি করে ৪ হাজার কোটি ডলার আয় করে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে রফতানি ১ বিলিয়ন। সুতরাং এ খাতে আমাদের ভালো করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
শুল্কমুক্ত বাধা না থাকায় আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোয় ভারতের কোম্পানিগুলো অনেক ভালো করছে। আমাদের কোম্পানিগুলো যদি সেই সুযোগ পায়, তবে এ অঞ্চলে রফতানি বৃদ্ধির বিশাল সুযোগ আসবে।
ইউরোপে বাংলাদেশী মসলা ও খাদ্যপণ্যের ভালো চাহিদা রয়েছে। কৃষকরা মানসম্মত মরিচ, হলুদসহ মসলাজাতীয় ফসল যত উৎপাদন বেশি করবেন, তাতে পণ্যের গুণগত মান বাড়বে, রফতানিও বৃদ্ধি পাবে। ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় ফ্রোজেন ফুডসের ভালো বাজার রয়েছে।
আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের খাদ্যপণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আগামী দিনগুলোতে ফ্রুট ড্রিংকস, কনফেকশনারি, বিস্কুটসহ বিভিন্ন ড্রাই ফুডসের ব্যাপক ভালো করার সুযোগ রয়েছে।
বৈশ্বিক ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রফতানি বৃদ্ধিকে জরুরি কাজ বিবেচনা করা হচ্ছে। রফতানি খাতে আপনারা বড় অংশীদার। রফতানি আরো বাড়াতে আপনাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
দেশে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এখন ১০০ কোটি ডলার সমমূল্যের পণ্য রফতানি করছে। আমাদের পরিকল্পনা, শিগগিরই শুধু কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রফতানি করে প্রাণ একাই তার অধিক পরিমাণ পণ্য রফতানি করতে সক্ষম হবে। নেসলে অথবা ইউনিলিভার সারা বিশ্বে ব্যবসা করে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার। আমরা সেখানে অনেক ক্ষুদ্র, তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী।
আমরা এখন কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের পাশাপাশি নন-ফুড আইটেমের রফতানি বাড়াচ্ছি। রফতানি বহুমুখীকরণের যে কথা বারবার বলা হচ্ছে আমরা সেটিই করছি। আমাদের লক্ষ্য দেশে আমাদের যত ধরনের পণ্য উৎপাদন হয় তার সবই বিদেশে রফতানি করা। সম্প্রতি আমরা প্রথমবারের মতো আফ্রিকায় গ্যাসের চুলা পাঠালাম, ফ্যান পাঠালাম ফিজিতে, আফ্রিকার অন্য একটি দেশে রাইস কুকার পাঠিয়েছি। ইউরোপে আমরা কনটেইনার, পাইপসহ বিভিন্ন পণ্য পাঠাচ্ছি। এ প্রক্রিয়া চলমান। প্রাণ এরই মধ্যে ১৪৫টিরও বেশি দেশে পৌঁছে গেছে। আরএফএল পৌঁছে গেছে ৩৫টিরও বেশি দেশে। বাংলাদেশ থেকে আমরা বৈচিত্র্যময় পণ্য নিয়ে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজির হচ্ছি। এছাড়া আমরা আমাদের মেধার সমন্বয় করে সম্মুখপানে এগিয়ে যাচ্ছি। ওই সময় আসতে খুব বেশি দেরি নেই, একদিন দেখা যাবে পৃথিবীর সর্বত্রই প্রাণ-আরএফএলের পণ্য পৌঁছে গেছে।
রফতানি করতে গিয়ে আপনাদের এ মুহূর্তে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে কি? হলে তা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আমাদের বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থা থেকে বাণিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থায় যেতে হবে, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার ও উচ্চফলনশীল বীজের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ফসল ফলানোর চেষ্টা করতে হবে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমে আসবে। বিশ্ব বাজারে আমাদের প্রধান প্রতিযোগী ভারত ও পাকিস্তান কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারছে। পণ্যের উৎপাদন খরচ কমে এলে আমরা আমাদের প্রতিযোগীদের চেয়ে কম মূল্যে বিশ্ববাজারে পণ্য সরবরাহ করতে পারব। একই সঙ্গে আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসের আওতায় আনতে হবে। দেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রফতানি ত্বরান্বিত করতে বিশ্বমানের ল্যাব স্থাপন অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির পর পরই আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির মাইলফলক স্পর্শ করেছি। এ অগ্রযাত্রা আপনার দৃষ্টিতে কেমন ছিল? এমন অর্জনে আপনার অনুভূতি কী? উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কিছু আছে কি এর মধ্যে?
অবশ্যই উচ্ছ্বসিত হওয়ার ব্যাপার আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির পর পরই আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির মাইলফলক স্পর্শ করতে পেরেছি, এটা বাঙালি জাতি হিসেবে অবশ্যই গৌরব ও প্রশংসার দাবিদার। দেশ ভালো করছে, দেশের রফতানিকারকরা ভালো করছেন। এক কথায় দেশের ব্যবসায়ীরা ভালো করছেন। এটা অবশ্যই আনন্দের খবর। আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর লেগেছে ৫০ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করতে। কিন্তু আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, আরো ৫০ বিলিয়ন অর্জন করতে কিন্তু ৫০ বছর লাগবে না। আমি মনে করি আমাদের যে ব্যবসায়িক অবকাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, সরকারের অবকাঠামো প্রয়োজন ছিল, তার সবকিছুই ব্যাপকভাবে স্থাপিত হয়েছে। অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার জন্য বাঙালি জাতি এখন প্রস্তুত এবং আগামী দিনে আমরা আরো অনেক ভালো করব।
কোন বিষয়টি ৫০ বিলিয়ন ডলারের এ পথচলাকে ত্বরান্বিত করতে সহযোগিতা করেছে? এমন কোনো টার্নিং পয়েন্ট কি আছে?
আমার মনে হয় এখানে অনেকগুলো টার্নিং পয়েন্ট ছিল। যেমন স্বাধীনতা, যমুনা ব্রিজের চিন্তাভাবনা ও উদ্বোধন, যারা গার্মেন্টস শিল্পকে বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছিলেন, যারা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির জন্ম দিয়েছিলেন, ফুটওয়্যার সেক্টরের জন্ম দিয়েছিলেন, যারা কৃষি নিয়ে কাজ করছেন, আমি মনে করি প্রতিটি জায়গা থেকে প্রতিটি সেক্টর একেকটি মাইলফলক। বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা এ মাইলফলকগুলো পার হয়েছি। আমাদের পোর্টের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বন্ডের সুবিধা, গ্যাসের আবিষ্কার, গ্যাসকে স্বল্পমূল্যে ইন্ডাস্ট্রিতে দেয়া সবগুলোই শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার টার্নিং পয়েন্ট। সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট হচ্ছে আমাদের মানুষের চিন্তাভাবনা। আমাদের যে কর্মী বাহিনী আছে, ১৭ কোটি মানুষ আছে, আমরা যারা মালিক-শ্রমিক একত্রে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করি অর্থাৎ এই যে বৃহৎ জনগোষ্ঠী তা আমাদের জন্য বড় পাওয়া। আমরা যারা শিল্প উদ্যোক্তা আছি, আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে আমাদের শ্রমিক ও মিডল ম্যানেজমেন্ট। সুতরাং আমরা যদি এটা না পেতাম তাহলে ৫০ বিলিয়ন ডলার কেন ৫ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্নও আমরা দেখতে পারতাম না। আমি একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ওই দিন দেখলাম, শ্রমিকরা কাজ শেষ করে দ্রুতগতিতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। শ্রমিকদের কাজের এই যে জোয়ার, আন্তরিকতা, আনুগত্য এবং কাজের প্রতি যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ এটাই নিঃসন্দেহে আগামী দিনে এগিয়ে নেবে। বাংলাদেশ এমন এক জায়গায় এসেছে যে একজন মানুষও এক মুহূর্তের জন্য বসে থাকে না। সবাই চেষ্টা করে কোনো না কোনো কাজের সন্ধানে থাকার জন্য। কেউই সমাজে বোঝা আকারে থাকতে চায় না। সুতরাং আমি মনে করি এটাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার সবচেয়ে বড় ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। আরো ৪০ বছর আগে নারীরা গার্মেন্টসে কর্মী বাহিনী হিসেবে ছিলেন না। এখন কিন্তু ফ্যাক্টরিগুলোতে নারীর সংখ্যা বেশি। কোনো অংশেই তারা পুরুষের তুলনায় কম ভূমিকা রাখছেন না। জাতিগতভাবে এটা আমাদের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার, বড় টার্নিং পয়েন্ট। আমাদের যে তরুণ প্রজন্ম বর্তমানে লেখাপড়া করছে ও কিশোর প্রজন্মের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাওয়ার যে আগ্রহ আমি মনে করছি এটা বাঙালি জাতিকে নিঃসন্দেহে এগিয়ে নিচ্ছে।
গত ৫০ বছরে ব্যক্তি খাতের পথচলার ক্ষেত্রেও এমন কোনো অংশ কি মনে পড়ে যে ওই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
কয়েকটি জায়গা অবশ্যই আছে। যেমন আমাদের কৃষিক্ষেত্র। আমরা বারবার সরকারের কাছে যেতাম যেন কৃষিতে বাড়তি সুযোগ দেয়া হয়। সেই নগদ ভর্তুকির ব্যবস্থা দেয়া হয়েছিল। আমি মনে করি, এ ভর্তুকির কারণে আমরা এগ্রো বিজনেস সেক্টরে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছি। আমরা সরকারের কাছে এজন্য কৃতজ্ঞ যে যখন যে সরকার এসেছেন সবাই ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছেন। আমরা উত্তরোত্তর আরো এগিয়েছি। বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি আবিষ্কার ছিল ইইএফ ফান্ড। যে ফান্ডের মাধ্যমে সরকার আমাদের পুঁজি দিয়েছিল ব্যবসা করার জন্য। এজন্য আমি সরকারকে সাধুবাদ জানাই। আমরা যারা ব্যবসায়ী আছি আমাদের উচিত সরকারের সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে নিজেদের শিল্পগুলোকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা। প্রত্যেক সরকারই আসে তাদের ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করার জন্য। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। এটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আমরা হবিগঞ্জে ফ্যাক্টরি চালু করি। আমার কাছে মনে হয় আমাদের হবিগঞ্জের ফ্যাক্টরিটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যাক্টরিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ সেখানে কাজ করছে। আমরা নিজেদের বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি প্রায় ৬০ মেগাওয়াটেরও বেশি। আমরা নাম দিয়েছি হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক আর ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ আমরা সেখানে একসঙ্গে কাজ করি। এ কর্মযজ্ঞ যে চলছে আমি মনে করি হবিগঞ্জ আমাদের একটা বিরাট আবিষ্কার ছিল। ঘোড়াশাল ও নাটোর আমাদের জন্য আবিষ্কার ছিল। এছাড়া আমরা যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছি প্রতিটি বিষয় কিন্তু আমাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট ছিল।
৫০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে একটি খাত খুব দ্রুত ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। সেটা হলো কৃষিজাত পণ্য রফতানি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এখানে সম্ভাবনার শেষ নেই। প্রসেসড ফুডের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হচ্ছে। এ পণ্যের সম্ভাবনা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
আমি মনে করি আমাদের কৃষিজাত পণ্য রফতানির সম্ভাবনা ব্যাপক, প্রক্রিয়াজাত কৃষি যেটা আছে। বাংলাদেশ হয়তো কমোডিটি সেক্টরে ভালো করবে না, যেহেতু আমাদের দেশটি ছোট। কিন্তু প্রসেসড ফুড এগ্রিকালচারের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন কনফেকশনারি প্রডাক্টস যেমন ললিপপ, ক্যান্ডি, চকোলেটসহ বিভিন্ন পণ্য পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমরা রফতানি করি। এখন বলতে পারেন যে ললিপপ ও ক্যান্ডির সঙ্গে কৃষির কী সম্পর্ক থাকতে পারে? জেনে খুশি হবেন যে আমাদের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় যে পতিত জায়গাগুলো রয়েছে সেখানে আমরা কাসাবা উৎপাদন করি। এ কাসাবাকে আমরা গ্লুকোজে রূপান্তরিত করি। পৃথিবীর বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরা আমাদের কনফেকশনারি পণ্যগুলো রফতানি করে সাফল্য পেতে সচেষ্ট হয়েছি। পাশাপাশি ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন জায়গায় ফ্রোজেন ফুডস রফতানিতে ভালো করছি। আগামী দিনে সেখানকার মানুষের ব্যস্ততা বাড়বে এবং খাদ্যসামগ্রীর জন্য আমাদের মতো যাদের লেবার ফোর্স রয়েছে এসব দেশের ওপর তারা ব্যাপকভাবে নির্ভর করবে। এভাবেই আমরা প্রসেসড ফুড সেক্টরে অনেক বেশি ভালো করব। আমরা নুডলস রফতানি করব। আমরা অনেক বেশি স্ন্যাকস, বিস্কুট, ফ্রোজেন ফুডস, ম্যাংগো পাল্প, ফলের রস রফতানি করব। এর মাধ্যমে রফতানি বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে উন্নতি লাভ করব। যদি অভিজ্ঞতার কথা বলেন, আমরা ভারতে অনেক বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমাদের উত্তর-পূর্ব ভারতের যে প্রতিবেশী রাজ্যগুলো রয়েছে সেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আমাদের টার্গেট ছিল যদি ভারতের প্রতি মানুষের কাছে ৫০ ডলার করে খাদ্য রফতানি করতে পারি তাহলে আগামী দিনে ভারত বাংলাদেশের জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানির একটি বড় রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত হবে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমাদের যারা পূর্বপুরুষ ছিলেন তারা হয়তো ভাবতেও পারেননি যে বাংলাদেশ ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক পার হবে। পৃথিবীর যে দেশগুলোতেই প্রবেশ করেছি আমরা সেখানেই ভালো করছি। প্রসেসড ফুড সেক্টরে আমরা দাপটের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি এবং আগামী দিনে আরো এগিয়ে যাব। মোট ১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাঙালিরা হয়তো আমাদের পণ্য সর্বোচ্চ ১০০ মিলিয়ন ডলারে নিচ্ছে। বাকি ৯০০ মিলিয়ন ডলার কিন্তু বিভিন্ন দেশের মানুষ গ্রহণ করছে। আগে হয়তো প্রসেসড ফুড সেক্টরে আমাদের খুব একটা সুনাম ছিল না। কিন্তু এখন খুব ভালো করছে। আশা করছি, আগামী দিনে আরো সুনামের সঙ্গে এ সেক্টর এগিয়ে যাবে এবং সমৃদ্ধি লাভ করবে।
রফতানি হয়তো ৫০ থেকে ১০০ বা ২০০ বিলিয়ন ডলার হবে। কিন্তু আমরা দেখছি রফতানির প্রায় ৮০ ভাগই হচ্ছে পোশাক খাত থেকে। আর কৃষিজাত খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলার। তাহলে আগামী দিনের যে লক্ষ্যমাত্রা তার জন্য কি এই একটি বা দুটি খাতের ওপরই নির্ভর করা হবে? নাকি আরো কিছু খাতের ওপর নির্ভরতা তৈরি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আমি মনে করি, রফতানির আরো অনেক খাত আছে। আমি আমার জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করি পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাণ এবং আরএফএলের পণ্য পৌঁছে দিতে। এটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি এটা আন্তরিকতার সঙ্গে করার চেষ্টা করি। আমরা পরিকল্পনা করছিলাম পৃথিবীর কোন কোন স্থানে কী কী পণ্য আমরা বিক্রি করব। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৭০০ কোটি। আমরা নতুন একটি প্রডাক্ট টুথব্রাশ উৎপাদন করেছি। আমরা স্বপ্ন দেখছি যে আগামী দিনে সাত বিলিয়ন মানুষ আমাদের থেকে টুথব্রাশ কিনবে। আমরা দেখলাম সাউথ আমেরিকা টুথব্রাশের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। এখন আমরা সেটা বাংলাদেশে উৎপন্ন করেছি। এটা বিভিন্ন দেশে রফতানি করব। আমাদের আরেকটি প্রডাক্ট শাইন উৎপাদন করেছি। বিভিন্ন ধরনের বাথরুমসামগ্রী। সিলিং ফ্যানও আমরা রফতানি করি। এখানে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম এক-দুই বছর আগে। এই দুই বছরের মাথায় ৩০টিরও বেশি দেশ আমাদের থেকে সিলিং ফ্যান নিচ্ছে। কোরিয়া যদি মোবাইল ফোনের ব্যবসায় ভালো করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ কেন সিলিং ফ্যানের ব্যবসা কিংবা টেবিল ফ্যানের ব্যবসায় ভালো করতে পারবে না? গার্মেন্ট শিল্পের অবকাঠামো বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে। গার্মেন্ট শিল্পের প্রতিটি পণ্য, প্রতিটি সামগ্রী, প্রতিটি উপকরণ আজ বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। আমরা সিলিং ফ্যান, টুথব্রাশ, স্টেশনারি সামগ্রী, আমাদের গৃহস্থালির পণ্য এবং আরএফএলের উৎপাদিত প্রতিটি পণ্য বিভিন্ন দেশে নিয়ে হাজির হব এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেব ও ব্যাপকভাবে এগিয়ে যাব। আমাদের দেশের গৃহস্থালি পণ্য, ইলেকট্রিক সামগ্রী যেমন ফ্রিজ, টেলিভিশন, লাইট বাল্ব, এক্সটেনশন কেবল এসব পণ্য আমরা বাংলাদেশে উৎপাদন করছি। পৃথিবীর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যদি আমাদের দেশে এসে মোবাইল ফোন রফতানি করে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে আমরাও প্রয়োজনীয় পণ্য চিহ্নিত করে ছড়িয়ে দিতে পারলে অবশ্যই ভালো করব। আমাদের দরকার বিশ্বাস এবং লেগে থাকা। ব্যাপক আত্মবিশ্বাস দরকার। আজকে সকালে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও মেক্সিকোয় আমাদের বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগ করেছি। সে দেশের নাগরিককে নিয়োগ করেছি আমাদের আরএফএলের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি করার জন্য। শুধু গার্মেন্টস দিয়ে বাংলাদেশকে বিবেচনা করলে হবে না। গার্মেন্ট সেক্টর অবশ্যই ভালো করবে। আমি ভীষণভাবে গার্মেন্টসের ব্যাপারে উৎসাহিত। কিন্তু পাশাপাশি রফতানি বাজারে যতগুলো সেক্টর আছে প্রতিটি সেক্টর কিন্তু ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করবে। এজন্য আমাদের মধ্যে যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন, আমাদের আত্মবিশ্বাস, আমাদের লেগে থাকা এবং আমাদের স্বপ্ন দেখতে শুরু করা সবচেয়ে বেশি দরকার। যদি জার্মানি, ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে বেশি রফতানি করতে পারে—আমাদের পিছপা হয়ে থাকলে হবে না। আমাদের সরকার যেসব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, ৫০ বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধন করায় আমরা অত্যন্ত অনুপ্রাণিত। এ পদ্মা সেতুর মাধ্যমে আমাদের দক্ষিণবঙ্গের যে ইন্ডাস্ট্রিগুলো আছে সেগুলোর কাজ ব্যাপকভাবে বাড়বে। আমাদের দক্ষিণবঙ্গের পণ্যগুলো আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারব বলে আমি ব্যাপকভাবে আশাবাদী।
বর্তমানে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট চিন্তা করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অন্যান্য যে প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো মোকাবেলা করে আমরা কীভাবে রফতানি খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাব?
আমরা যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা করি আমাদের প্রতিনিয়ত অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। চ্যালেঞ্জ আসবে বলেই এটা ব্যবসা। যত চ্যালেঞ্জ হোক না কেন আমরা যদি প্রতিটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি তাহলে কিন্তু কোনো চ্যালেঞ্জই চ্যালেঞ্জ থাকবে না। উত্তরোত্তর সফলতা আসবে। উদাহরণস্বরূপ হয়তোবা আগামীতে আমাদের জ্বালানি ব্যয় বাড়তে পারে। যদি জ্বালানি ব্যয় বাড়ে তাহলে ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য আজকে থেকে কাজ শুরু করে দিতে হবে। আমাদের ধরে নিতে হবে ডিজেলের ব্যয় আগামীতে ব্যাপক হারে বাড়বে। মাসে যদি বর্তমানে চারবার আমরা ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে পারি তাহলে আগামী দিনে মাসে একবার পৌঁছে দিতে হবে। আজকে যদি ছোট ট্রাক নিয়ে পৌঁছাই, আগামীতে বড় ট্রাক নিয়ে পৌঁছাব। সুতরাং যত প্রতিবন্ধকতাই আসুক সেগুলো ওভারকাম করতে হবে। সাম্প্রতিক প্রতিবন্ধকতার কথাই আমরা বলি, সুনামগঞ্জে বন্যা হয়েছে। যখনই বন্যা হয় তখনই আমরা নৌকা বা লঞ্চ নিয়ে আমাদের ডিস্ট্রিবিউশনে আমরা নেমে পড়ি। বাঙালি জাতি হিসেবে যে প্রতিবন্ধকতাই আসুক সেগুলো ডিঙ্গিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। আমরা নতুন নতুন মার্কেট অন্বেষণের চেষ্টা করছি। ইনফ্লেশন হচ্ছে, এটাকে ওভারকাম করার জন্য আমরা বাজারে কম ওজনের পণ্য দিতে সচেষ্ট হয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের মেধা কাজে লাগিয়ে আমাদের উৎপাদন যদি বাড়াতে পারি তাহলে উত্তরোত্তর সফল হতে পারব। আমরা লেগে আছি এবং আমরা মনে করছি আমাদের সামনে যাই চ্যালেঞ্জ আসুক না কেন আমরা সেটা ওভারকাম করব এবং বাংলাদেশকে জার্মানির লেভেলে পৌঁছে দিতে সচেষ্ট থাকব।