ওয়ালটনের সফলতার মূল সূত্র পণ্যের ইনোভেশন ও কোয়ালিটি

ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাংলাদেশী ব্র্যান্ড হিসেবে ওয়ালটনের বিশ্ববাজারে প্রবেশের গল্পটা শুনতে চাই। কেমন ছিল শুরুটা?

এক যুগ আগেও ইলেকট্রনিকস পণ্যের স্থানীয় বাজার ছিল আমদানিনির্ভর। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানিতে ব্যয় হতো। এতে দেশের টাকা বাইরে চলে যেত। কিন্তু এক যুগের ব্যবধানে আমরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখতে পাচ্ছি। এখন বিশ্বমানের ইলেকট্রনিকস পণ্য বাংলাদেশেই তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইলেকট্রনিকস পণ্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে এ পরিবর্তন মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু ওয়ালটনের স্বপ্নদ্রষ্টা উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নিরলস প্রচেষ্টা, সরকারি নীতিসহায়তা এবং দেশের অগণিত মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসায় আজ ওয়ালটন বিশ্ববাজারে দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

শুরুতে বাংলাদেশী ব্র্যান্ড হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে কিছুটা সময় লেগেছে। কিন্তু কোয়ালিটি পণ্য দিয়ে আমরা স্থানীয় বাজারে গ্রাহকপ্রিয়তার শীর্ষে যেতে সক্ষম হয়েছি। দেশের মানুষের আস্থা অর্জন এবং সেই আত্মবিশ্বাসে আমরা ২০১০ সালে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করেছি। বিগত বছরগুলোতে যেসব দেশে আমরা পণ্য রফতানি করে আসছি, সেখান থেকে খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। কভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রফতানিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও ইলেকট্রনিকস পণ্যে বাংলাদেশের ওপর বিশ্বের আস্থা বাড়ছে। আমরা রিপিটেড অর্ডার পাচ্ছি। এর অর্থ বাংলাদেশে তৈরি ওয়ালটন পণ্যের প্রতি বিশ্ববাজারে ক্রেতাদের আস্থা রয়েছে।

বর্তমানে আপনাদের ইলেকট্রনিকস পণ্যের রফতানির পরিমাণ কেমন?

বিগত বছরগুলোতে আমরা ২৫-৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করে আসছি। কভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমানে রফতানি খাতসহ বৈশ্বিক অর্থনীতি এক সংকটময় সময় অতিবাহিত করছে। আমাদের টার্গেট ছিল গত অর্থবছরে ১০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করা। কিন্তু পর পর তিনটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সেই পরিমাণ রফতানি সম্ভব হয়নি। এ ক্রাইসিসটা কাটিয়ে উঠলে আগামী বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করতে সক্ষম হব বলে আশা করছি। আমরা বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। নতুন করে যে সাড়া পাচ্ছি, তাতে দেখা যাচ্ছে ইলেকট্রনিকস পণ্যে বাংলাদেশের প্রতি অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বের নির্ভরতা ও আস্থা বাড়ছে। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শুল্ক প্রতিবন্ধকতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য বাংলাদেশ থেকে ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানি বেশি সুবিধাজনক হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা আশাবাদী যে শিগগিরই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানিতে যেতে পারব।

আপনাদের পণ্যের শীর্ষ গন্তব্য কোন দেশগুলো? 

এখন পর্যন্ত আমরা ৪৮টি দেশে পণ্য রফতানি করেছি। এরই মধ্যে আমরা ইউরোপের মার্কেটে গিয়েছি। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ওয়ালটন পণ্য রফতানি হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমাদের পণ্য রফতানি হচ্ছে। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, কেনিয়া, তিউনিসিয়াসহ অন্য দেশগুলোয় আমাদের পণ্যের বড় বাজার রয়েছে। এখন আমাদের টার্গেট আমেরিকার বাজার। এ বাজারে ওয়ালটন পণ্য রফতানিতে কাজ চলছে। বাংলাদেশী ব্র্যান্ড হিসেবে সেটা আমাদের জন্য অনেক বড় সাফল্যের হবে।

আপনারা বর্তমানে কী কী পণ্য রফতানি করছেন?

আমাদের সব পণ্যই কম-বেশি রফতানি হচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, ফ্যান ইত্যাদি পণ্য। ইউরোপের বাজারে আমাদের টেলিভিশন বেশি রফতানি হচ্ছে। ভারতে রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, ফ্যান ইত্যাদি পণ্যের চাহিদা বেশি। এর পাশাপাশি রাইস কুকার, ব্লেন্ডার ইত্যাদি কিচেন অ্যাপ্লায়েন্সও রফতানি হচ্ছে।

আপনারা দেশে কম্প্রেসর উৎপাদন কারখানা করেছেন, যা বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশেই আছে? আপনাদের কম্প্রেসর কারখানা ও রফতানি নিয়ে জানতে চাই।

বাংলাদেশে একমাত্র ওয়ালটনেরই কম্প্রেসরের প্রডাকশন প্লান্ট রয়েছে। বিশ্বের হাতে গোনা মাত্র ১৫টি দেশে কম্প্রেসর উৎপাদন কারখানা আছে। তার মধ্যে অন্যতম ওয়ালটন। শুরু থেকেই আমরা বাংলাদেশে তৈরি কম্প্রেসর এবং যন্ত্রাংশ রফতানি করছি। এ বছরের শেষ নাগাদ আমরা ইউরোপিয়ান প্রযুক্তির কম্প্রেসর উৎপাদনে যাব। বিশ্বের যেসব প্রতিষ্ঠান এসিসির কম্প্রেসর কিনত তারা আমাদের কাছ থেকেই কম্প্রেসর নেবেন বলে জানিয়েছেন। আশা করছি, আগামী বছর থেকে এসিসির ক্রেতাদের আমরা বাংলাদেশে তৈরি কম্প্রেসর দিতে পারব।

আপনারা গত বছর তিনটি ইউরোপীয় ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ড কিনে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে নিশ্চয়ই ওয়ালটনের বড় উল্লম্ফন ঘটেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন। 

ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয় ব্র্যান্ড হিসেবে এসিসি, জানুসি ইলেকট্রোমেকানিকা (জেম) এবং ভার্ডিকটার—এই তিনটি ব্র্যান্ডেরই বিশ্বজুড়ে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ইউরোপীয় প্রযুক্তি ও মেশিনারিজ বাংলাদেশের প্রডাকশন প্লান্টে স্থাপন করে পণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে আমরা কাজ করছি। ইউরোপীয় এ ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য যেসব জায়গায় বিক্রি হতো, সেই ক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে পণ্য নেয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন। এখন পর্যন্ত টেস্টিং রিপোর্টসহ সবকিছু ইতিবাচক আছে। আশা করছি, আগামী বছরের মধ্যে আমরা এসিসিসহ অন্য ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য রফতানি করতে সক্ষম হব, যা বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস পণ্য রফতানি খাতের জন্য অনন্য মাইলফলক সৃষ্টি করবে।

রফতানির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন কি? হলে তা সমাধানের উপায় কী?

চ্যালেঞ্জ তো অবশ্যই আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্ব একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সাপ্লাই চেইন, পরিবহন, দেশের মূল্যস্ফীতি সবকিছু মিলিয়ে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় আমরা অতিবাহিত করছি। ব্যবসায় এ রকম হাজারো চ্যালেঞ্জ থাকবে। সেসব মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ ইন্ডাস্ট্রিতে বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু হচ্ছে এবং আমরা আশাবাদী ভবিষ্যতে আরো ভালো হবে।

ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ড হিসেবে ওয়ালটনের সফলতার মূল সূত্র কী?

এক কথায় বলতে গেলে ওয়ালটনের সফলতার মূল সূত্র ইনোভেশন ও কোয়ালিটি। পণ্যের কোয়ালিটির ক্ষেত্রে ওয়ালটন ব্র্যান্ড কোনো ছাড় দেয় না। প্রতিটি পণ্যের যেসব কোয়ালিটি প্যারামিটার আমরা নির্ধারণ করেছি, সেগুলোর কঠোরভাবে অনুসরণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কোয়ালিটি পণ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে আমরা স্থান করে নিয়েছি। বিশ্ববাজারেও কোয়ালিটি পণ্য দিয়ে আমরা দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। এর পাশাপাশি আমরা ইনোভেশনে খুব জোর দিয়েছি। আমাদের সহস্রাধিক প্রকৌশলী ইনোভেশন নিয়ে কাজ করছেন, যাতে ক্রেতাদের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী আমরা যুগোপযোগী পণ্য দিতে পারি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিকস খাতে ওয়ালটন সারা বিশ্বে অসাধারণ কাজ করছে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন