সরকারি ঋণের ৩৮% প্রবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা কি

হাছান আদনান

বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ সামলাতে আমদানি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও এক অংকের ঘরে নেমে এসেছে। যদিও সরকারি ঋণের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই-পরবর্তী এক বছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৩৮ শতাংশের বেশি। এ সময়ে সরকারের নেয়া ১ লাখ ৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা নিট ঋণের সিংহভাগের জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্পদ সৃষ্টি না হলেও নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়ার এ নীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরে দেশে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, যা এক যুগে সর্বোচ্চ। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) মূল্যস্ফীতির হার আরো বেড়েছে। জুলাইয়ে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশের পর আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। বাংলাদেশে ঊর্ধ্বমুখী হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন নিম্নমুখী। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামও নেমে এসেছে এক বছর আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানি কমানোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতিতে পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নের বিরূপ প্রভাবও বাজারে পড়েছে। আবার সরকারের আয়ের উৎসগুলোও সংকুচিত হয়ে এসেছে। কমেছে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণপ্রাপ্তিও। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে যে ঋণ দিয়েছে, সেটি মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়ায় বড় ভূমিকা রাখছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সরকারের ঋণ গ্রহণ ও ব্যয় কমাতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা এখন খুবই খারাপ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌অর্থের সংকট সত্ত্বেও সরকার একের পর এক মেগা প্রকল্প নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণের জোগান দিচ্ছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। আবার কোনো দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে যেসব উদ্যোগের মাধ্যমে সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, বাংলাদেশে সে ধরনের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি।’ 

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে তার কোনো প্রভাব নেই। যেসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে, সেগুলো আর কমবে বলে মনে হয় না। কারণ দেশের বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে পারেনি। কার্ব মার্কেটের সঙ্গে ব্যাংকে ডলারের দরে ১০ টাকার ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এটি চলতে থাকলে অর্থনীতি আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

দুই বছর আগে আর্থিক সংকটে পড়ে ক্রমাগত রুপি ছাপিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছিল শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্পদ সৃষ্টি না করেই নতুন মুদ্রা ছাপানোর প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে দেশটির সাবেক রাজাপাকসে সরকারকে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি ঠেকেছিল প্রায় ৬০ শতাংশে। বিপর্যয়কর সে পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী নীতি গ্রহণ করে গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিংহের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদের হার এক ধাক্কায় ১০ শতাংশ বাড়িয়ে মুদ্রা সরবরাহের লাগাম টেনে ধরা হয়। আর্থিক খাতের সংস্কারে নেয়া হয় নানামুখী উদ্যোগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া উদ্যোগের সুফল এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে শ্রীলংকার জনগণ। গত মাসে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটির সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার নেমে আসে মাত্র ৪ শতাংশে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ নেয়ার নীতি চালু রয়েছে এখনো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার ১২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৭৮ হাজার ১৪০ কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। অন্যান্য উৎস থেকে সরকারের আরো ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা রয়েছে। তবে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বলছে, সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দেয়ার সক্ষমতা এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংক খাতের নেই। আবার সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ দেশের অভ্যন্তরীণ অন্যান্য উৎস থেকেও পরিকল্পনা অনুযায়ী ঋণ নেয়া সম্ভব হবে না। বিদেশী উৎস থেকেও সরকারের ঋণপ্রাপ্তি কমে গেছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের প্রথম সপ্তাহে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্নমুখী ব্যয় আরো বাড়বে। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় নির্বাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো বেশি হারে নতুন টাকা ছাপাতে হবে। সেটি হলে দেশে মূল্যস্ফীতির হার আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই শেষে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে এ ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সরকারের ব্যাংকঋণ স্থিতি ১ লাখ ৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা বেড়েছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিতে উল্লম্ফন হলেও দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১ অংকের ঘরে নেমে গেছে। জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। যদিও দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সিংহভাগই বেসরকারি খাতনির্ভর।

কভিড-১৯ সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগ আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের শুরুতে ব্যাপক মাত্রায় ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে বৈশ্বিক পণ্যবাজার। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। দ্রুতগতিতে দাম বেড়ে যায় কয়লা-গ্যাসসহ অন্যান্য জ্বালানি পণ্যের। একই সঙ্গে বাড়ে ভোজ্যতেল, গমসহ ভোগ্যপণ্যের দামও। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন ব্যয়। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়ে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু গত ছয় মাসে বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই মূল্যস্ফীতির চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও কমতে কমতে ব্যারেলপ্রতি মাত্র ৭০ ডলারে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে কডিভ-পূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরেছে ভোগ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার। কিন্তু বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যসহ সব পণ্যের দাম এখনো অস্থিতিশীল। ফলে নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির হার।

যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতিও এখন দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। গত জুনে ভারতের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি কমেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয়ও। কিন্তু এক্ষেত্রে একেবারেই বিপরীত অবস্থান বাংলাদেশের। গত বছরের জুলাইয়ে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার সীমাবদ্ধ ছিল ৬ শতাংশে।

বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে চাপে আছে বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। এক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। রেকর্ড আমদানির দায় ও বিদেশী ঋণের দায় পরিশোধ করতে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হতে শুরু করে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। ক্রমাগত ক্ষয় হওয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) রিজার্ভ এখন ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত বছরের শুরুতেও দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা। বর্তমানে আন্তঃব্যাংক লেনদেনেই প্রতি ডলারের বিনিময় হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকায়। সে হিসাবে এ সময়ে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। টাকার এ বড় অবমূল্যায়নকেও মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়ার জন্য অন্যতম দায়ী হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় গত বছরের শুরুর দিকে। এলসি খোলায় বিধিনিষেধের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তদারকি বাড়ানো হয়। আবার ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোও এলসি খোলা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। এ কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে আমদানি ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে দেশে আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো ৬৩৫ কোটি ডলারের এলসি খুলেছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে ব্যাংকগুলো মাত্র ৪৩৭ কোটি ডলারের এলসি খুলতে পেরেছে। একই সময় এলসি নিষ্পত্তির হারও ২০ শতাংশের বেশি কমেছে। 

ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেয়া ঋণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্তরায় হয়ে উঠল কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ সরকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের মতো সরাসরি কোনো খাতে ব্যয় করলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু সরকার সেটি করছে না। ব্যাংক খাত থেকে নেয়া ঋণ সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করছে। তবে এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে হলেও অর্থ বাজারে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার এটি একটি ছোট কারণ হতে পারে।’

দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘‌অর্থনীতিতে চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ নেই। এ কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আবার ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষাও বেড়ে গিয়েছে। এ কারণে মানুষ আগের চেয়ে বেশি ভোগ করছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন