বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইলস পণ্য রফতানি

ডক্টর ইঞ্জি. মোহাম্মদ রুবাইয়াৎ চৌধুরী

বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮২ শতাংশ বস্ত্র খাত থেকে অর্জিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ বস্ত্র রফতানিতে চীনের পরে দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের ২০২২-২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক শিল্পে রফতানি আয় ছিল ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের রফতানির ৮২ শতাংশই দখল করে আছে পোশাক শিল্প খাত, যার অন্যতম একটি শিল্পপণ্য হলো হোম টেক্সটাইল। বাংলাদেশে ৩১৭টি ডায়িং ও প্রিন্টিং ফ্যাক্টরি, ৫১০টি ইয়ার্ন ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি এবং ৩৫৮টি ফ্যাব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি আছে, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হোম টেক্সটাইলস তৈরি করে। (তথ্যসূত্র—বিটিএমএ)

একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশে হোম টেক্সটাইল বলতে বিছানার চাদর আর লেপ-তোশকের জন্য ব্যবহৃত কাপড়কেই বোঝাত। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে হোম টেক্সটাইল এখন টেকনিক্যাল টেক্সটাইল। গৃহ ও কর্মক্ষেত্রের সৌন্দর্য পরিবর্ধনে যেসব কাপড় বা বস্ত্র ব্যবহার হয়, তাই হোম টেক্সটাইল শিল্প হিসেবে পরিচিত। অলংকরণগত ব্যবহার ছাড়াও হোম টেক্সটাইল মানুষকে মানসিক স্বস্তি দেয়ার উপকরণ।

উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত ফাইবার, রঙ, টেক্সচার, ফিনিশ, রুচি, ক্রেতার ডিজাইন, চাহিদা ইত্যাদি অনুসারে হোম টেক্সটাইলকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন বিছানার চাদর, কুশন কভার, বালিশ, বালিশের কভার, কম্বল, ডুভেট কভার, অগ্নি প্রতিরোধক কম্বল ইত্যাদি; টেবিল কভার, টেবিল ম্যাট, ন্যাপকিন, রানার, টেবিল ক্লথ, রান্নাঘরের অ্যাপ্রোন, গ্লাভস, পট হোল্ডার, লাঞ্চ বক্স কভার, ডিশ কাপড় ইত্যাদি; বাথরুমে ব্যবহৃত তোয়ালে, স্নানের পাটি বা ম্যাট, স্নানের কার্পেট, বাথরুমের পর্দা ইত্যাদি এবং অন্যান্য যথা ফ্লোর ম্যাট, ফ্লোর কার্পেট, পর্দা, ওয়াল ম্যাট, সোফা কভার, কুশন কভার ইত্যাদি। হোম টেক্সটাইলের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য অ্যাপ্লিকেশন হলো গৃহসজ্জার সামগ্রী, বসার আসনের টেক্সটাইল, দেয়ালের আচ্ছাদনের কাপড় বা ঝোলানোর বস্ত্র ইত্যাদি। ২০১৯ সালে হোম টেক্সটাইল খাতে বেড অ্যান্ড বাথ লিনেন পণ্যের বাজার শেয়ার ছিল প্রায় ৬৫ শতাংশ এবং রান্নাঘরের লিনেনগুলোর শেয়ার ছিল ১৫-২০ শতাংশ। (তথ্যসূত্র—টেক্সটাইল ব্লগ, ৭ আগস্ট, ২০২৩)

হোম টেক্সটাইল ব্যবহার করার উদ্দেশ্য

 হোম টেক্সটাইল বাড়ির সাজসজ্জা বা সুরক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়।

 হোম টেক্সটাইল ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়।

 এটি সূর্যের রশ্মির পাশাপাশি অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ঘর ও আসবাবপত্রকে রক্ষা করে।

 এটি আসবাবপত্রের রঙ বিবর্ণ হতে বাধা দেয়।

 এটি গ্রীষ্মে ঘরকে ঠাণ্ডা করে এবং এয়ারকন্ডিশনারের ওপর চাপ কমায়।

 এক ধরনের হোম টেক্সটাইল শীতকালে উষ্ণতা প্রদান করতে সাহায্য করে। 

 ঘরের আসবাবপত্রকে ধুলাবালি ও ময়লা থেকে রক্ষা করে।

বাংলাদেশ থেকে হোম টেক্সটাইল এশিয়া প্যাসিফিক, ইইউ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় রফতানি হয়। পোশাক প্রস্তুতকারকদের তুলনায় বাংলাদেশে হোম টেক্সটাইল উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। কিন্তু এখন হোম টেক্সটাইল বাংলাদেশের প্রথম সারির রফতানি খাতগুলোর একটি। বাংলাদেশে ছোট-বড় ২৫-৩০টি হোম টেক্সটাইল কারখানা রয়েছে, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ২৩৪টি পণ্য রফতানি করছে। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য হোম টেক্সটাইল কারখানাগুলো হলো ক্লাসিক্যাল হোমটেক্স, জেঅ্যান্ডএম ইন্টারন্যাশনাল, জাবের ও জুবায়ের ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, সাদ মুসা গ্রুপ, জে কে গ্রুপ, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইন্টারকর্প ফ্যাশন, রাইজিং সান ট্রেডিং, তাজ ফ্যাশন, ক্লথ অ্যাপারেলস লি. এবং এসিএস টেক্সটাইল ইত্যাদি। গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ, ইনকরপোরেটেডের একটি নতুন প্রতিবেদন অনুসারে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্ব হোম টেক্সটাইল বাজারের আকার ১৩৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। উপরন্তু, দ্রুত রিয়েল এস্টেট বাজার বৃদ্ধি হোম টেক্সটাইল বাজারের বৃদ্ধির উন্নতি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

রাজস্বের পরিপ্রেক্ষিতে বাথরুম লিনেন ২০১৯-২৫ পর্যন্ত সময়ে ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ সিএজিআর নিবন্ধন করবে এবং তার পরে কার্পেট ও ফ্লোর কভারিং ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ সিএজিআরে নিবন্ধন করবে বলে অনুমান করা হয়। বেডরুম লিনেন ২০১৮ সালে বিশ্ববাজারকে চালিত করেছিল এবং ২০১৯-২৫ পর্যন্ত আরো প্রসারিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ওয়েলস্পুন গ্রুপ, স্প্রিংস গ্লোবাল, নিউ সেগা হোম টেক্সটাইল ও রাল্ফ লরেন করপোরেশনসহ বড় কোম্পানিগুলোর উপস্থিতির সঙ্গে বাজারটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এবং বেশির ভাগ হোম টেক্সটাইল নির্মাতারা বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাহিদার ধরন অনুমান করার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে।

অফলাইন ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল সেগমেন্ট ২০১৮ সালে হোম টেক্সটাইলের বিশ্বব্যাপী বাজারকে চালিত করেছে। (তথ্যসূত্র—গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ ইনকরপোরেটেড ও টেক্সটাইল ব্লগ, ৭ আগস্ট ২০২৩)

এক যুগ আগেও হোম টেক্সটাইল খাতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ নামটি অপরিচিত ছিল। বর্তমানে চীন, ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম যুক্ত হয়েছে। ইউরোপীয় বাজারে হোম টেক্সটাইল পণ্যের উচ্চ চাহিদা বিরাজ করছে। চাহিদার কারণে হোম টেক্সটাইলের রফতানি উত্তরোত্তর বাড়ছে। বাংলাদেশ"টেরি টাওয়েল ও লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন" এবং" রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল রফতানি আয় ছিল মাত্র ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরে এটি বেড়ে প্রায় ৭৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল রফতানি আয় এসেছে ৭৯ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে ৮৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের হোম টেক্সটাইল পণ্য রফতানি হয়েছে। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনার প্রাদুর্ভাবে এ খাতের রফতানি আয় কমে দাঁড়িয়েছিল ৭৫ কোটি ৮৯ লাখ মার্কিন ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে হোম টেক্সটাইল রফতানি হয়েছে ২৫ কোটি ২৩ লাখ মার্কিন ডলার, যা বেড়েছে ৪০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। (তথ্যসূত্র—টেক্সটাইল ব্লগ, ৭ আগস্ট ২০২৩)

চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উত্তেজনা, ভূরাজনৈতিক সংকট, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদ্যুতের সমস্যা নিয়ে অন্যান্য খাতের মতোই হোম টেক্সটাইল খাতেও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আর উৎপাদন অনুকূলে থাকলেও বৈশ্বিক হোম টেক্সটাইল রফতানি বাজারে বাংলাদেশের অংশ এখনো মাত্র ৭ শতাংশ।

তাছাড়া হোম টেক্সটাইলে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা থাকলেও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দেশটি এখনো পিছিয়ে। টেকনাভিরের মতে, ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী হোম টেক্সটাইল বাণিজ্যের মূল্য ছিল ১১৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২০ সালে ১৩১ দশমিক ৫ বিলিয়ন এবং ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ তা ১৭০-১৮০ বিলিয়ন ডলার হবে, যা ২০১৮-২৫-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বা তার বেশি বাড়বে। তাই উৎপাদনকারীরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিশ্ববাজার দখলের সম্ভাবনা রয়েছে। এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন আয় করেছে। এ খাতে রফতানি আয়ের বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৪৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। বাংলাদেশে হোম টেক্সটাইলসের উল্লেখযোগ্য ক্রেতাগুলো হচ্ছে আইকিয়া, গ্যাপ, কারেফোর, নিটরি, ওয়ালমার্ট, এমএনএস, নেক্সট, টেস্কো ও অন্যান্য। (তথ্যসূত্র—অ্যাপারেল রিসোর্সেস বিজনেস নিউজ ডট কম, ৭ আগস্ট ২০২৩; ঢাকা ট্রিবিউন, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২)

বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইলসের সম্ভাবনা অপার।  তদুপরি যদি নিয়মিত গবেষণা করা হয় এবং গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করা হয়, তাহলে নানাবিধ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে। সেক্টরটিকে সবচেয়ে বেশি টেকসই শিল্প হিসেবে গণ্য করা হয়। টেকসই হোম টেক্সটাইলস উৎপাদনের ওপর ক্রেতারা বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে কতিপয় বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে:

 উদ্যোক্তারা মনে করেন তুলা আমদানি হোম টেক্সটাইলসের বিকাশের পথে একটি বড় বাধা;

 রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ একটি বাধা হতে পারে;

 সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে হোম টেক্সটাইলস উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণ আরো নিবিড়ভাবে করা উচিত;

 লুম বা তাঁত মেশিনগুলো পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত;

 হোম টেক্সটাইলস উৎপাদনের সময় কাপড়ের বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি যেমন মিস পিক, ডাবল পিক, কাট পিক, রিড মার্ক, মেশ, এমেরি কাট, টেম্পল কাট, অয়েল স্পট, নট, হ্যাঙ্গিং থ্রেড ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে এবং সব উপকরণকে ত্রুটিমুক্ত করে ব্যবহার করতে হবে;

 প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক শক্তির ওপর উচ্চ নির্ভরতা কমাতে হবে;

 দক্ষ শ্রমিকের অভাব একটি বড় ধরনের বাধা।

সর্বোপরি হোম টেক্সটাইল বাংলাদেশের রফতানি উন্নয়নে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। সমন্বিত একটি জাতীয় গবেষণা ও উন্নয়ন সেল গঠন করা সময়ের দাবি। গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ছাড়া বিশ্ব ক্রেতা বাজারে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া অন্যান্য উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় খাতের মতো এ খাতেও ন্যায্য সহায়তা প্রয়োজন।

লেখক: অধ্যাপক, অ্যাপারেল স্টাডিস বিভাগ

বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউএফটি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন