আলোকপাত

বিনিয়োগের বিপরীতে আশানুরূপ কর্মসংস্থান কতদূর

ড. আর এম দেবনাথ

কত টাকা বিনিয়োগে কত লোকের কর্মসংস্থান হয়? এ প্রশ্নের কোনো আলোচনা সচরাচর চোখে পড়ে না। যেখানেই যাই, কী সেমিনারে, কর্মশালায়, আলোচনা সভায়, কী নীতিনির্ধারণী সভায়—সর্বত্র আলোচনা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে। আর আলোচনা হয় বিনিয়োগ নিয়ে, মাথাপিছু আয় নিয়ে, তৈরি পোশাক রফতানি নিয়ে এবং রাজস্ব আয় নিয়ে। বিশেষ করে আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যাংক ঋণ। এছাড়া আলোচনা আছে আরো অনেক বিষয়ে। কিন্তু যে বিষয়টি জানতে চাই তা হচ্ছে, শিল্পে, বড় শিল্পে কত বিনিয়োগ করে কতজনের কর্মসংস্থান হয়। এ পরিসংখ্যান পাই না। যেমন পাই না মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মানুষের দৈনিক/সাম্প্রতিক আয় কতটুকু বাড়ল এ পরিসংখ্যান। উন্নয়ন-অগ্রগতি, উন্নয়ন মডেল, ইকোনমিক জোন, বড় বড় মেগা প্রকল্পের খবর হয় প্রতিদিন প্রচুর। ভর্তুকি, বিদ্যুতে ভর্তুকি, গ্যাস কোম্পানিতে ভর্তুকি ইত্যাদির ওপর আলোচনা পাই অহরহ। এসবের যে গুরুত্ব নেই তা বলা হচ্ছে না। কিন্তু পাশাপাশি দরকার ছিল ওই তথ্যের, যা বলবে কত টাকা বিনিয়োগে কতজনের কর্মসংস্থান হয়, চাকরি হয়। এতে বিশেষ আগ্রহ আমার। কারণ দেশের লোক সংখ্যা ১৭-১৮ কোটি। ঘনবসতির দেশ। কী শহর, কী গ্রাম, কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। লোকসংখ্যা বাড়ছে তো বাড়ছেই। কিন্তু পাশাপাশি মানুষ কেমন আছে, কীভাবে মানুষ চলে, কেমন তাদের জীবনধারণের মান (স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং) তা জানতেও ইচ্ছে করে। বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, অর্ধ-বেকারের সংখ্যা কি বাড়ছে, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কি বাড়ছে, লোকের চাকরি যাচ্ছে কিনা ইত্যাদি দরকার, অথচ তা পাই না।

বেকারের যে পরিসংখ্যান তাতে তাকালে দেখা যায় তা সম্পূর্ণই ভুল ইঙ্গিতবাহী। কারণ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম মেনে তার হিসাব হয়। অথচ আমাদের জন্য এটি প্রযোজ্য হতে পারে না। কারণ তারা বলে, সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করলেই সেই ব্যক্তি বেকার নন। কী মারাত্মক কথা। সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ—কী অবাস্তব একটা ধারণা! অথচ এর ভিত্তিতেই বলা হয়, দেশে বেকারের সংখ্যা কত, কত লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সেসবের হিসাব দিতে গিয়ে আবার তিনটি ভাগ করা হয়। কত লোক কৃষি খাতে নিয়োজিত, কত লোক শিল্পে নিয়োজিত, কত লোক সেবা খাতে (সার্ভিসেস) নিয়োজিত। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, দেশ যত উন্নত হবে, দেশের যত শিল্পায়ন হবে, ততই শিল্পে লোক নিয়োজিত থাকবে বেশি। কৃষিতে লোক নিয়োজিত হবে কম। কৃষির অবদান জিডিপিতে কমবে। শিল্পের অবদান জিডিপিতে বাড়বে। বাড়বে সেবা খাতের পরিধি ও অবদান। কথা হচ্ছে, তা কী হচ্ছে? যে শিল্পের জন্য এত কথা, যে শিল্পায়নের জন্য সরকারের এত আকুতি, সেই খাতে কি বিনিয়োগের তুলনায় কর্মসংস্থান বাড়ছে? কম সুদে ঋণ, সহজভাবে ঋণ সমস্যা দেখা, কর মওকুফ, আয়কর হ্রাস, কর অবকাশ, রফতানিতে ভর্তুকি, গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকির ব্যবস্থা, বন্ডেডহাউজ সুবিধা, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে সহজে ডলারে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা, খেলাপি ঋণে পুনর্গঠন (রিস্ট্রাকচারিং) সুবিধা প্রচলন ইত্যাদি সুবিধা হরেদরে দেয়া হচ্ছে। 

আমাদের অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসা/ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেট দিচ্ছেন। ব্যবসায়ী/শিল্পপতিরা জিনিসপত্র বাজারজাতে নিয়ন্ত্রণহীন সুবিধা ভোগ করছেন। ১ টাকার জিনিস ৩ টাকায় বিক্রি করছেন। নব্য উদারতাবাদী অর্থনীতির মডেলে যা যা তাদের প্রাপ্য তার চেয়ে অনেক বেশি তারা পাচ্ছেন। তাহলেই সংগত প্রশ্ন, তারা কি আমাদের ছেলেমেয়েদের চাকরির ব্যবস্থা যথেষ্ট পরিমাণে করছেন? তারা কি আশানুরূপভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন। না, প্রতিযোগিতার কথা বলে, সস্তা শ্রমের যুক্তি তুলে যথেচ্ছভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন কর্মসংস্থান তো দূরের কথা, যারা চাকরিতে আছেন তাদেরই কর্মচ্যুত করছেন? বিনিয়োগের ‘‌প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্টের’ সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা কি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের যথাযোগ্য বেতন-ভাতা দিচ্ছেন? পোশাক কর্মীরা আন্তর্জাতিক মানে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন? অনেক প্রশ্ন। এর কোনো জবাব পাই না। বরং যতটুকু পাই, তাতে হতাশা বাড়ে বৈ কমে না। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে যদি স্বল্প বিনিয়োগে বেশি লোকের কর্মসংস্থান না হয় তাহলে আমাদের শেষ পরিণতি কী হবে? প্রযুক্তির বলি হয়ে কি দেশের কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা ‘মেডিটেশনে’ বসবে? কী করবে, কাজ নেই। সপ্তাহে দু-একটা কাজ করার ভিত্তিতেও বহুলোক বেকার। একটু কমে তো আবার একটু বাড়ে। বিপদ-আপদে বাড়ে, যুদ্ধে বাড়ে, কভিড-১৯-এ বাড়ে—এসব আর কী? কথাগুলো কেন উঠছে?

কথাগুলো উঠছে সরকারি নানা পরিসংখ্যান দেখে। কতগুলো ২০২৩ সালের এপ্রিল-জুনের, আর কতগুলো পরিসংখ্যান ২০২২ সালের শ্রম জরিপের। ২০২৩ সালের তথ্য সাম্প্রতিক তথ্য, তাও মাত্র তিন মাসের। এর উল্লেখযোগ্য। এতে দেখা যাচ্ছে, তিন মাসে বেকারত্ব কিছুটা কমেছে (আইএলওর সংজ্ঞানুসারে)। কমেছে ৬০ হাজার। এই সময়ে কর্মসংস্থানে ছিল ৭ কোটি ৭ লাখ লোক। মজা হচ্ছে, এ কমার কারণ যতটুকু না শিল্প খাত, তার চেয়ে বেশি কৃষি খাত। কৃষি খাতে তিন লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। শিল্পেও কর্মসংস্থান কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু কমেছে সেবা খাতে। দৃশ্যত এ পরিসংখ্যান কিছুটা হলেও আশাপ্রদ। কিন্তু আমরা যদি ১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২২ পর্যন্ত সময়ের তথ্য দেখি তাহলে দেখব, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে কর্মসংস্থান অনেক কমেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ১০০ জনের মধ্যে ৩৯ জন নিয়োজিত ছিল। অথচ এ সংখ্যা ২০২২ সালে নেমে আসে ৩৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে। বিপরীতে কৃষিতে এ সময়ে কর্মসংস্থানের হার ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৫ দশমিক ৩৩ শতাংশে উন্নীত হয়। অন্যদিকে সেবা খাতেও কর্মসংস্থানের হার ২০ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ১৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে নেমে আসে। মোট নিয়োজিত লোকের সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নিয়োজিত ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ লোক। এ সংখ্যা ২০২২ সালে কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ২১ লাখে। কী বোঝা যাচ্ছে? ঘটনা ঘটছে উল্টো। যেখানে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নিয়োজিত লোকের সংখ্যা/কর্মসংস্থান বাড়ার কথা সেখানে কমেছে। বেড়েছে কৃষিতে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতি (হাই গ্রোথ ইকোনমি)। 

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ, অথচ ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান হ্রাসমান। এখানে কথা আছে। এটা আইএলওর তথ্যমতে। শিক্ষিত বেকার, ছদ্ম বেকার হিসাব এখানে থাকার কথা নয়। এ সত্ত্বেও প্রশ্ন এ অবস্থা কেন হবে? কৃষিতে বিনিয়োগ, বিশেষ করে ‘‌প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট’ নেই বললেই চলে। যা কিছু বিনিয়োগ আছে তা গরিব কৃষকদের বিনিয়োগ। অথচ সেখানে কর্মসংস্থান বাড়ছে। যেখানে বিনিয়োগ আছে, সুযোগ-সুবিধা আছে, সেখানে কর্মসংস্থান কমছে। তাহলে কোথায় গণ্ডগোল? আমরা কি ‘‌ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ’ ইনভেস্টমেন্টের দিকে ঝুঁকছি। আমরা কি দ্রুত প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে, যেখানে শ্রমিকের কোনো দরকার নেই, দরকার যন্ত্রপাতি। কী কৃষি, কী শিল্প সর্বত্রই মেশিনের ব্যবহার। মজা হচ্ছে, কৃষিতেও যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে অনেক বেশি হারে। কিন্তু তবু সেখানে কর্মসংস্থান বাড়ছে। আর শিল্পে প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কমছে কর্মসংস্থান। যেমন আমাদের পোশাক শিল্প। এখানে দ্রুত ‘রোবট’ বসছে। প্রতিযোগিতার কথা বলা হচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থান তো দূরের কথা, পুরনোরাই চাকরিচ্যুত হচ্ছেন। বস্ত্রশিল্প, আইটি, সিমেন্ট, ওষুধ, ইস্পাত থেকে শুরু করে সর্বত্রই প্রযুক্তি, আধুনিক প্রযুক্তি গৃহীত হচ্ছে। মালিকদের বার্তা একটি। 

শ্রমিকের দাম বেশি, অথচ বাংলাদেশের শ্রম হচ্ছে সবচেয়ে সস্তা। পোশাক শিল্পে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশের শ্রম সবচেয়ে সস্তা। তবু কথা হচ্ছে শ্রমিকের মূল্য বেশি। আবার বলা হচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদ বেশি। কিন্তু এখানে কথা আছে। শিল্প উৎপাদনে শ্রম ব্যয় এবং সুদ ব্যয়ই একমাত্র ব্যয় নয়। মোট ব্যয়ে রয়েছে অনেক উপাদানের হিস্যা। সেসবের দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা কী? এ নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, যেখানে শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়ার কথা, কৃষিতে নির্ভরতা কমার কথা, সেখানে কেন উল্টো ঘটছে। দেখা যাচ্ছে, শহরে আগের মতো লোক গ্রাম থেকে আসছে না। ঢাকার রাস্তা খননে, রাস্তা কাটায় দেখতাম দিনাজপুরের শ্রমিক, সেখানে মেয়েরাও থাকত। এখন রাস্তা কাটা হয় মেশিনে, শ্রমিকের প্রয়োজন নেই। নির্মাণ শিল্পে শ্রমিকের দরকার হতো, এখন সেখানেও কম। তাহলে করণীয় কী? যতটুকু জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে ভাবিত। ঘনবসতিপূর্ণ দেশের শিল্পায়ন নীতির কী হবে? শিল্পে কী ধরনের বিনিয়োগ দরকার? মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ বেশি, কর্মসংস্থান কম। ছোট ছোট শিল্পে কুটির ও অতি ক্ষুদ্রশিল্পে বিনিয়োগ কম কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি। এ জায়গায় আমাদের অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। ‘‌সিএসএমই’ ক্যাটাগরিতে পড়ছে সব তথাকথিত ছোট-মাঝারি শিল্প। 

আমি মনে করি, অতিক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পের আলাদা ‘‌ক্যাটাগরি’ দরকার। এর জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ, ঋণ বরাদ্দ দরকার। এখানে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা আছে। আমি বুঝতে পারি না, আমাদের দেশে প্রচুর চামড়া আছে। তার পরও সামান্য একটা ঘড়ির ‘‌বেল্ট’ কেন চীন থেকে আসবে? কেন প্লাস্টিকের টব বাজারে বিক্রি হবে? ছোট ছোট উদ্যোগ দরকার। ছোট ছোট চিন্তা দরকার। মেগা প্রকল্পের কাজ অনেক হয়েছে। এবার এদিকে একটু নজর দিন। মানুষ কিছু একটা করে খাক। সবাই তো আর সরকারি চাকরি পাবে না।

ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন