সময়ের ভাবনা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট অ্যাসেম্বলিংয়ের সম্ভাবনা

ফেরদাউস আরা বেগম

সম্প্রতি জেনেভায় এআই কী করে বিশ্বের সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে নিরসন করতে পারে সে ব্যাপারে একটি এআই ফর গ্লোবাল সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে পৃথিবীর মানবিক রোবটদের (হিউমেনয়েড) নিয়ে একটি প্রেস কনফারেন্সে রিপোর্টারদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে এরা তাদের বিভিন্ন মতামত তুলে ধরে। পৃথিবীতে এটাই এ ধরনের প্রথম প্রেস কনফারেন্স যেখানে নয়টি বিশেষ রোবট প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করে। সবার বিশেষ পরিচিত সোফিয়া বলেছে, হিউমেনয়েড রোবট বা মানবিক রোবট মানুষের মতো অত্যন্ত কার্যকর এবং দক্ষতার সঙ্গে অনেক কাজ করে। তারা মানুষকে সহায়তা করতে পারে, তাদের সে রকম অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। একেবারে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এসব মানবিক রোবট এ প্রজন্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম এবং তারা যেসব উত্তর দিয়েছে তার সঙ্গে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই।

এ রকম আরেকটি রোবট যে কিনা হেলথকেয়ার সেবা দিতে সক্ষম, যার নাম দেয়া হয়েছে গ্রেস। এটি বলেছে তারা মানুষের পাশাপাশি থেকে কাজ করতে পারে এবং কোনো ক্রমেই বর্তমান কর্মসংস্থানের জন্য কোনো হুমকি নয়। আর একটি রোবট যার নাম আমেকা, যাকে তৈরি করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য, এটি বলেছে সে তার জন্মদাতার প্রতি কৃতজ্ঞ, তার প্রতি কোনো বিদ্রোহ করার প্রশ্নই আসে না। দেসমন্ডা নামে আরেকটি রোবট বলেছে যে তারা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে সবাইকে সহায়তা করতে চায়। এ প্রযুক্তি পৃথিবীর সবাইকে চমকে দিলেও এটি একটি পরম বাস্তব। এসব রোবট এআই টেকনোলজি দিয়ে আপগ্রেড করা হয়েছে যা একটি উন্নততর প্রযুক্তি এবং এর পেছনে কাজ করেছে একটি সুদক্ষ সুশিক্ষিত জনশক্তি।

আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে এআইয়ের ব্যবহার দেখেছি। বাংলাদেশে প্রথম এআই সংবাদ পাঠিকা ব্যবহার হয়েছে, যার নাম অপরাজিতা। গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সে নিউজ সম্প্রচার হয়েছে। যেমনটা ঘটেছে ভারতেও। একইভাবে কুয়েতে ফেডা নামে এআই রোবট খবর পড়েছে। অর্থাৎ এগুলো এখনো আমাদের কাছে নতুন মনে হলেও পর্যায়ক্রমে আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ব এবং এগুলোকেই ভালোবাসতে শুরু করব, যেমন করে বাংলাদেশের বৃহৎ উৎপাদন ও রফতানি খাত এরই মধ্যে নিজেদের প্রয়োজনেই এআই প্রযুক্তি সমর্থিত রোবট ব্যবহার শুরু করেছে।

বাংলাদেশের টেক্সটাইল এবং আরএমজি, ফার্মাসিউটিক্যালস, হেলথকেয়ার, লজিস্টিকস এবং ওয়্যারহাউজিং, অটোমটিভ এবং কিছু সেবা খাত এরই মধ্যে তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এআই ব্যবহার করছে। এছাড়া কিছু নন-ট্র্যাডিশনাল খাত যেমন; ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিকস, কনস্ট্রাকশন, প্লাস্টিক এবং প্যাকেজিং, এফএমসিজি, ডিফেন্স এবং সিকিউরিটি, ফার্নিচার শিল্প এরই মধ্যে এআই সহায়ক রোবট ব্যবহার করছে। 

এসব খাত তাদের উৎপাদিত পণ্যের গুণমান বজায় রাখতে, নির্ভুলতা বা প্রিসিসন, রিপিটিটিভ উৎপাদনে সময় কমিয়ে আনার জন্য এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহারে বাড়তি বিনিয়োগ করছে। সর্বোপরি রফতানি সক্ষমতা এবং ক্রেতার নির্দেশনা মেনে চলতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু বর্তমানে তাদের জন্য অনেকটা বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে। আমরা দেখেছি, মোহাম্মদী গার্মেন্টস, এসিআই, বিভিন্ন প্লাস্টিক শিল্প তাদের প্রয়োজন মাফিক নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে। 

এক্ষেত্রে ভয়ের যে কারণটি সবাই মনে করছেন সেটা হলো, বাংলাদেশের মতো একটি শ্রমঘন দেশে কী করে রোবোটিকসের ব্যবহার প্রচার এবং প্রসার করা যায় এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক হুমকি তৈরি করতে পারে কিনা। কারণ যে ধরনের দক্ষ জনশক্তি আমাদের দরকার, এআই প্রচার এবং প্রসারের জন্য তা এ মুহূর্তে আমাদের নেই। এর জন্য ব্যাপক রি-স্কিলিং, আপ-স্কিলিং এবং বর্তমান স্কিলের আপডেটিং দরকার। তার জন্য সময়েরও প্রয়োজন। এ ব্যাপারে অবশ্য ব্যাপক কার্যক্রম সরকার গ্রহণ করেছেন তবে তার ফলাফল পেতে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। 

তবে আশার কথা যে বেসরকারি খাত বসে নেই, তারা যে যার মতো প্রচেষ্টা নিচ্ছে। এরই মধ্যে বেশকিছু অ্যাসোসিয়েশনও স্থাপিত হয়েছে এবং একযোগে কাজ করছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিবিএসের সূত্রে, বাংলাদেশে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩টি রোবট আমদানি হয়েছে যার মূল্য প্রায় ২৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে মূলত চীনে রফতানি হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৫০০টি রোবট যার মূল্য প্রায় ৪৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কাজ করছে যা আরো ব্যাপকভাবে কীভাবে করা যায় সে ব্যাপারে নীতিমালা থাকা দরকার। 

ফরচুন বিজনেস ইনসাইটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটের চাহিদা ২০২২ সালের ১ হাজার ৬৭৮ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০২৯ সালে প্রায় ৩ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ এ খাত বার্ষিক ১১ দশমিক ৪ শতাংশ করে সম্প্রসারণ হবে। তার মানে কর্মসংস্থানের প্রতি হুমকি থাকা সত্ত্বেও এর ব্যবহার বাড়ছে এবং বাড়বে। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশের শিল্পায়ন, সেবা ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে কোন ধরনের রোবট আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত তা খুঁজে বের করা এবং সবচেয়ে জরুরি, একই সঙ্গে কর্মসংস্থানের দিকটিও খেয়াল রাখতে হবে।

বিভিন্ন দেশের উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে সব দেশেই প্রাথমিকভাবে কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও ক্রমান্বয়ে তারা এর থেকে বেরিয়ে এসেছে, যেমন চীন, তুরস্ক ইত্যাদি। এর জন্য প্রচুর গবেষণা দরকার যাতে একটি সঠিক কৌশল গ্রহণ করা যায়।

এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটির সহায়তায় ফোরআইআর অ্যান্ড আইসিটি ওয়ার্কিং কমিটির চতুর্থ সভায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট অ্যাসেম্বলিংয়ের সম্ভাবনা নিয়ে ‘পটেনশিয়াল অব অ্যাসেম্বলিং অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটস ফর ডিফারেন্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি উপস্থাপনা প্রদান করে বিল্ড। এতে রোবট অ্যাসেম্বলিংয়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এছাড়া অন্যান্য দেশের উদাহরণ তুলে জব ডিসপ্লেসমেন্ট, দক্ষতা উন্নয়ন ও নৈতিক বিবেচনার বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

কয়েকটি দেশের সঙ্গে তুলনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে মোটামুটি দক্ষ মানবসম্পদ রয়েছে যা ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনীয় তবে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পর্যাপ্ত ওয়ার্কফোর্স রয়েছে, সেখানে ভারতের রয়েছে দক্ষ মানব সম্পদের প্রাচুর্য। তবে পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া এমনকি মিসরের মানবসম্পদ কিছুটা সীমিত। আমরা এটুআই পরিচালিত ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখেছি যে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে, যেমন আরএমজি, টেক্সটাইল, ফার্নিচার, এগ্রো-ফুড, লেদার, ট্যুরিজম এবং হসপিটালিটিতে প্রায় ৫৫ লাখ কর্মসংস্থান ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে তবে একাধিক নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে, যা এর থেকে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। 

বর্তমান বিশ্বে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের উত্থান ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণের ফলে বিভিন্ন শিল্প খাতের মধ্যে অর্থনৈতিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ‘অ্যাসেম্বলিং’ হাব হওয়ার মাধ্যমে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনকে কাজে লাগাতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দরকার আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানো। 

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বেশকিছু শিল্প খাত অ্যাসেম্বলিংয়ের মাধ্যমে যাত্রা হয়ে এখন একটি পরিপূর্ণ খাতে পরিণত হয়েছে; ইলেকট্রনিকস, অটোমটিভ, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাত, যেমন হোন্ডা, বাইসাইকেল, ব্যাটারি, ট্রান্সফরমার, অপ্টিক্যাল ফ্রেম, টায়ার, টিউব ইত্যাদি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট অ্যাসেম্বলিংয়ের এ রকম একটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। আর আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে তা বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

শিল্পনীতি ২০২২-এ এরই মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট অ্যাসেম্বলিংয়ের এক নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটি উপায় হিসেবে চিহ্নিত করে নীতিমালা এবং অ্যাকশন প্ল্যান গ্রহণ করা হয়েছে যা বাস্তবায়ন করা জরুরি। বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর জন্য কী ধরনের রোবটের প্রয়োজন তার জন্য একটি জরিপ চালানো যেতে পারে। এছাড়া রোবোটিকস স্ট্র্যাটেজি হালনাগাদ, এডুকেশন ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচি, শুরুতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে রোবটের ব্যবহার এবং ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কোলাবরেশন দরকার।

দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট অ্যাসেম্বলিংয়ে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমাদেরকে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যাতে করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট অ্যাসেম্বলিংয়ের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও সেভাবে এগিয়ে আসতে হবে যাতে তাদের শিক্ষা কারিকুলামে আগামী দিনের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম সিলেবাসে যুক্ত হয়। শিল্প ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি নীতি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। 

উন্নততর প্রযুক্তি গ্রহণের লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন বিশেষভাবে জরুরি। ফাইভজি নেটওয়ার্কের গুরুত্বের বিষয়ে বলা হচ্ছে তবে ফাইভজি কাভারেজের আগে আমাদের ফোরজি নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তার জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি সবচেয়ে জরুরি, এবং আমাদের প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী কানেক্টিভিটি, যা ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে জরুরি। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের হাই-টেক ও আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষমতা রয়েছে।

রোবোটিকস খাতের বৈশ্বিক চাহিদা বিবেচনায় বাংলাদেশ রোবোটিকস অ্যাসেম্বলিং খাতে মনোনিবেশ করতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিদ্যমান প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় সাধন, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং হাই-এন্ড প্রোগ্রামিং প্রযুক্তির বিকাশে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উন্নয়নে এরই মধ্যে ছয়টি সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল প্রস্তুত করা হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রণয়নে সহায়ক হতে পারে। তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে রোবোটিকসের ব্যবহার ও চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাংলাদেশের শিল্প রোবোটিকসের চাহিদা নিরূপণপূর্বক দেশে ওই খাতের অ্যাসেম্বলিং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গবেষণা পরিচালনা বিশেষভাবে প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা ঘোষণা করতে পারে। যেমন এ খাতের জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত করপোরেট কর অব্যাহতি, রোবোটিকস-সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম প্রসারে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির আওতায় গবেষণা বা মেধাবৃত্তির প্রচলন করা যেতে পারে।

ফেরদাউস আরা বেগম: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), বিল্ড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন