সময়ের ভাবনা

সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও পর্যটন প্রসারে ঈদ ট্যুরিজম

ড. সন্তোষ কুমার দেব

বাঙালি বরাবরই ভ্রমণপিপাসু। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নানাবিধ প্রয়োজনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে। বাঙালি জাতি এরই মধ্যে ভ্রমণের প্রেমে পড়েছে। নান্দনিক বাংলাদেশ এখন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ভ্রমণ গন্তব্য। আনন্দঘন পরিবেশে সময় কাটানোর জন্য দেশে এখন অনেক পর্যটন স্পট রয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহিত করে।

করোনা-পরবর্তী বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় একশ কোটির বেশি। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিপুলসংখ্যক বিশ্ব পর্যটকদের মধ্যে প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঈদ হচ্ছে পরিবার-পরিজন নিয়ে অবকাশ যাপনের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময়। ঈদের ছুটিতে গ্রাম হয়ে ওঠে প্রাণচঞ্চল আর শহর থাকে জনশূন্য। বন্ধুবান্ধব একসঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করার জন্য শহরের কৃত্রিম ব্যস্ততা ঘেরা পরিবেশ ছেড়ে মানুষ নাড়ির টানে ছুটে চলে বাড়ি।

ঈদকে কেন্দ্র করে ট্যুর অপারেটররা দেশে ও বিদেশ ভ্রমণের আকর্ষণীয় ট্যুর প্যাকেজ অফার করে। তার মধ্যে মধ্যবিত্ত ও তরুণ পর্যটকদের কাছে প্রথম পছন্দ বাংলাদেশের কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা ছাড়াও ভারত (কলকাতা, শিমলা, মানালি), নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকা।

মূলত পর্যটকদের কাছে নান্দনিক বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্রগুলোর নৈসর্গিক সৌন্দর্য অধিক প্রিয়। এ অঞ্চলে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মালনীছড়া চা-বাগান ছাড়াও জাফলং, লালাখাল, বিছনাকান্দি, পাংথুমাই ঝরনা, সোয়াফ ফরেস্ট, রাতারগুল, হাকালুকি, কানাইঘাট পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।

ঈদকে কেন্দ্র করে প্রত্নতাত্তিক পর্যটন আকৰ্ষণগুলোর চাহিদা সম্প্রসারিত হয়। উল্লেখ্য, হাজার বছরের পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বগুড়ার মহাস্থানগড়, বৌদ্ধবিহার, ষাটগম্বুজ মসজিদ, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, পানামনগর, সোনারগাঁও, বড় কাটরা, ছোট কাটরা উল্লেখযোগ্য পর্যটন গন্তব্য।

ঈদের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে পর্যটনের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ঘেরা সবুজ প্রকৃতি, যা ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দেয় পর্যটকদের কাছে। শীতে পাহাড় কুয়াশা ও মেঘের চাদরে ঢাকা থাকে, সেই সঙ্গে সোনালি রোদের আভা, আবার বর্ষায় চারদিকে সবুজের সমারোহ, প্রকৃতি ফিরে পায় তার আপন রূপ। তাই অ্যাডভেঞ্চার পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলো।

ঈদের সময় বিনোদনের জন্য উচ্চবিত্তদের পছন্দ থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, মিসর, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশ। ঈদের ছুটিতে যেহেতু পর্যটক সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাই বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ‘পর্যটন ব্যবস্থাপনা’ খুবই প্রয়োজন। পর্যটক আস্থা অর্জনের জন্য ঈদের সময় অভ্যন্তরীণ পর্যটন সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন সমৃদ্ধ হবে। পর্যটকরা যেন নিরাপদে তাদের অবকাশ যাপন করতে পারেন, সে জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

দেশীয় পর্যটনকে প্রসারের লক্ষ্যে দেশের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর তথ্য, ভিডিও, স্থিরচিত্র, ডকুমেন্টারি ও ট্রাভেল শো প্রচারের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি ভ্রমণেও উৎসাহিত করা সম্ভব।

ঈদকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের জন্য আবাসন কক্ষগুলোর মূল্য, খাবারের দাম, পর্যটন পণ্যের মূল্য যেন অহেতুক বৃদ্ধি না পায় সেই লক্ষ্যে পর্যটন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার একটি তদারকি কমিটি থাকা প্রয়োজন।

ঈদকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য সুনীল পর্যটন হতে পারে এক অনন্য ধাপ।| মূলত দেশে সুনীল পর্যটন উন্নয়নের জন্য সমুদ্রবন্দরগুলো আধুনিকায়ন, সমুদ্রবন্দর কর্মীদের পর্যটনবান্ধব করা, স্টেকহোল্ডারদের প্রশিক্ষণ, ভিসা নীতিমালায় সমুদ্রবন্দর অন্তর্ভুক্ত করা, অনবোর্ড ইমিগ্রেশন, পর্যটকবাহী জাহাজে অনবোর্ড কাস্টমস সুবিধা, সমুদ্রভ্রমণ প্রমোদতরি আগমনের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়ে বেসরকারি ট্যুর অপারেটরদের উৎসাহিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে দ্রুত ও সহজে অনুমতি প্রাপ্তি, যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পর্যটকদের প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য পর্যটন শিল্পে কর্মরত সব কর্মীর মধ্যে নিয়মিত ও খণ্ডকালীন সবাইকে প্রশিক্ষণের আওতাভুক্ত করা দরকার, যাতে পর্যটন কর্মীরা উন্নত বিশ্বের মতো সেবা প্রদানে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে।

দেশীয় পর্যটন উন্নয়নে জেলাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। দেশীয় পর্যটকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও পর্যটন আকর্ষণগুলোর ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি দেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন আকর্ষণগুলো চিহ্নিতকরণ, পর্যটন আকর্ষণগুলোয় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্তকরণ, লোকাল হ্যারিটেজ ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ করার প্রক্রিয়াটি সহজতর হবে।

পর্যটন উন্নয়নে জেলাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পর্যটনের নতুন ধারণা পিপিসিপির (প্রাইভেট-পাবলিক কমিউনিটি পার্টনারশিপ) ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

ড. সন্তোষ কুমার দেব: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন