সময়ের ভাবনা

প্রযুক্তির নয়া সমীকরণে বাজেটবীক্ষণ

আহমেদ দীন রুমি

পলাশী যুদ্ধেই নির্ধারিত হয় নিয়তি। বেনিয়া সংস্থা থেকে শাসনদণ্ড হাতে আবির্ভূত হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বদলে যেতে থাকে অর্থনৈতিক সমীকরণ। বিলেতে রফতানি করা ভারতীয় পণ্যে আরোপ করা হয় শুল্ক। অথচ এখানকার বাজারে বিনা শুল্কেই প্রবেশ করতে থাকে বিলেতি পণ্য। ফলে বলতে গেলে ১৮১৩ সালের মধ্যেই ভারতীয় পণ্য বিদেশী বাজার হারিয়ে ফেলে। দরিদ্র ভারতবাসীও চড়া দামে দেশী পণ্য কিনতে আগ্রহ দেখায়নি। বেছে নিয়েছে সস্তায় বিদেশী পণ্যকেই। পরিণামে ভারত ক্রমে পরিণত হয়েছে বিলেতি পণ্যের একচেটিয়া বাজারে। ধসে পড়েছে ক্ষুদ্র ও কৃষিভিত্তিক শিল্প। গাছের মতো গল্পের পেছনেও শেকড় থাকে। এ গল্পের শেকড় প্রোথিত বাষ্পীয় ইঞ্জিনের বাণিজ্যিকীকরণের মধ্যে। ম্যাথিউ বোলটন ও জেমস ওয়াট নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে শুধু নিজেরাই বিখ্যাত হননি, ব্রিটেনকে পরিণত করেছেন দুনিয়ার প্রথম শিল্পোন্নত দেশে। সমুদ্রপথে তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একক আধিপত্য। ঠিক যে সময়টায় ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় দেশ এগিয়ে যেতে থাকল, তখনই সমান্তরালে পিছিয়ে পড়তে থাকল দুনিয়ার অন্য প্রান্তের কুটির ও হস্তশিল্প। নয়া প্রযুক্তির সঙ্গে না সময়ের মাপকাঠিতে টেকা সম্ভব, না কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে। ফলে ব্রিটেনের কারখানার দাপটে প্রতিদিন পরাজিত হয়েছে বাংলার তাঁতি সমাজ। ভারত ও চীন ছিল কুটির ও হস্তশিল্পের সমৃদ্ধ অঞ্চল। ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লবের সবচেয়ে বড় মাশুলটা দিতে হয় তাদেরই। বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় ক্রমে ফিকে হতে থাকে ঐতিহ্যবাহী পেশাগুলো। কমে যেতে থাকে মাথাপিছু আয়। কোনো কোনো শিল্প রীতিমতো বিলুপ্ত হয়ে যায়। 

ইতিহাসজুড়ে প্রতিটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন একটা নতুন সমীকরণ হাজির করেছে। তৈরি হয়েছে নতুন বিজেতা ও পরাজিত শ্রেণী। কামান নিয়ে অটোম্যানরা যে ইউরোপের ওপর বিজয়ী হয়েছিল, সে ইউরোপই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দিয়ে অটোম্যান সাম্রাজ্যকে টুকরো টুকরো করেছে। পার্থক্য ছিল কেবল সময় ও অগ্রগতি। হাল দুনিয়ায় একক কর্তৃত্ব করে চলছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। প্রযুক্তির বলেই বলিয়ান হয়ে আটলান্টিক পাড়ের দেশগুলোর মোড়লে পরিণত হয়েছে আমেরিকা। আবার প্রযুক্তিও একটি নিয়ত গতিশীল প্রক্রিয়া। ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত করার পহেলা প্রতিষ্ঠান নেটস্কেইপ, অথচ মাইক্রোফটের ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ও ক্রোমের মতো ব্রাউজারের সামনে সুবিধাই করে উঠতে পারেনি। ক্রমাগত এই যে এগিয়ে যাওয়ার বিদ্যা, এটা উন্নত বিশ্ব বুঝে ফেলেছে। এজন্য দুহাতে পয়সা ঢালছে গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে। মার্কিনদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠিক একইভাবে এগিয়ে এসেছে চীন। সাফল্য দেখাচ্ছে তারাও। হয়তো এ দফায় শিল্পবিপ্লবের গল্পকে পুনরাবৃত্তি করতে চায় না চীন। সমীকরণের প্রবণতা বুঝতে পেরেই ইউরোপে উদীয়মান টেক হাব হিসেবে ফ্রান্সকে প্রতিষ্ঠা করতে ছয় বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছেন মাখোঁ। সফলতাও পেয়েছেন। অনেক কোম্পানিই রাজি হয়েছে উত্তর ফ্রান্সে কারখানা স্থাপন করতে। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রিয়া। সবাই বুঝে গেছে, প্রযুক্তি ও বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিযোজনের মাধ্যমে নতুনভাবে পুনর্গঠিত হচ্ছে বিশ্বের অর্থনীতি ও বাণিজ্য। প্রযুক্তিকে যারা উচ্চে আসীন করতে পারবে, তারাই ভবিষ্যতের জয়ী। আর বাদবাকিরা পরিণত হবে পরাজিত ও নিছক ভোক্তা শ্রেণীতে। আবিষ্কার কেবল অর্থনীতিকেই স্ফীত করে না, প্রভাব ফেলে ভূরাজনৈতিক আধিপত্যেও। 

অগ্রসরমাণ দুনিয়ায় দাঁড়িয়েই ঘোষিত হলো ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট। নতুন অর্থবছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছর প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ১ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৫২৬ কোটি টাকা বেড়েছে বরাদ্দ বাজেট। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ১৩ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ছিল ১৬ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৩ হাজার ৭ কোটি টাকা বা ২২ শতাংশ কমেছে বরাদ্দ। সারা বিশ্ব যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দৌড়ে এগিয়ে চলছে, সে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এমন চিত্র মোটেও আনন্দদায়ক নয়। কতটুকু সহজ হতে যাচ্ছে আইসিটি ও বিজ্ঞান খাত, তা নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না। প্রযুক্তিপণ্যের আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠতে পারে আসছে দিনগুলোয়। দেশের প্রযুক্তি খাত এখন পর্যন্ত আমদানিনির্ভর। ল্যাপটপ বা প্রিন্টার থেকে শুরু করে প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত হার্ডওয়্যার আনতে হয় বাইরে থেকে। শুল্ক বাড়ানো হলে আমদানি খরচ বেড়ে যাবে অপ্রত্যাশিত হারে। খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেই যদি বেশি দামে আমদানি করতে হয়, তারা কম দামে গ্রাহকের হাতে তুলে দেবে কীভাবে? প্রযুক্তি পণ্যের পাশাপাশি বেড়ে যাবে ইন্টারনেটের দাম। বাংলাদেশে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ তরুণ। প্রযুক্তি তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বিষয়টি কেবল একার জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে দেশীয় অর্থনীতির জন্যও লাভজনক। রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অবদান রাখছে তারা। তরুণ সমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার জন্যই দেশীয় সফটওয়্যার ও আইটি পরিষেবায় প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেত। অথচ সফটওয়্যার উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। বিদেশী সফটওয়্যারে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশে নেয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে ধার্য করা হয়েছে ভ্যাট। ভ্যাটের ভার বাড়িয়ে তুলবে সফটওয়্যারের আমদানি খরচ। আর পরিষেবা বাবদ খরচ বাড়লে আবশ্যিকভাবেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজারে। শুল্ক না কমানোর কারণে বা কর প্রত্যাহার না করার কারণে চাপ তৈরি হবে গোটা খাতে। একদিকে দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা ও অন্যদিকে আমদানিকে দূরবর্তী করে তোলা ভালো লক্ষণ নয়। অন্তত এমন কোনো দেশের জন্য, যারা প্রযুক্তিবান্ধব ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। 

ভবিষ্যতের ইতিহাসসচেতন মানুষের কাছে চ্যাটজিপিটির উত্থানের দিন বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জয় করতে শুরু করছে নতুন নতুন মেরু। চ্যাটজিপিটি, মিডজার্নি ও বার্ডের মতো প্রযুক্তি মানুষকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। ইউরোপীয় কমিশন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিচালনার স্বার্থে নীতিমালা প্রস্তাব করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামরিক ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে তৈরি করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত। তৃতীয় বিশ্বে বসবাসের অপকারিতা হিসেবে এমনিতেই প্রযুক্তি দূরবর্তী নক্ষত্রের মতো অবস্থান করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌড় সবসময়ই শূন্যে শেষ হয়। বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর কারণে স্বল্পমূল্যের শ্রমবাজারে ভালো অবস্থান নিয়ে আছে, এটা চিরস্থায়ী সফলতা নয়। প্রযুক্তি আরেকটু শক্তিশালী হলে কায়িক শ্রমের জায়গাগুলোর দখল নেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শ্রমবাজারে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই তখন পড়বে ঝুঁকির মুখে। এর মধ্যেই অ্যাপোলো এগ্রিকালচার কেনিয়ার কৃষকদের কৃষি পরামর্শ ও সেবা দিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উপকরণ হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এমন পরিস্থিতিতে শ্রম ও বৌদ্ধিক অভিযোজন জরুরি। বদলে যাওয়া দুনিয়ায় নতুনভাবে কাঠামোবদ্ধ করা জরুরি অর্থনৈতিক রূপরেখা। যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হবে অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রধান হাতিয়ার। তার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ। যদি অগ্রযাত্রায় সীমাবদ্ধতা তৈরি করা হয়, সেটা হবে উদ্বেগজনক। 

ইয়ানিস ভারোফাকিস ২০২৩ সালে প্রকাশ করেন তার বই ‘টেকনো-ফিউডালিজম: দ্য ডিমাইজ অব ক্যাপিটালিজম অ্যান্ড দ্য রাইজ অব আ নিউ পাওয়ার’। টেকনো-ফিউডালিজম বলতে তিনি এমন ধরনের বিশ্ব ব্যবস্থাকে বুঝিয়েছেন, যার নিয়ন্ত্রণ থাকে গুটিকয়েক টেক প্রতিষ্ঠানের হাতে। বর্তমান দুনিয়ায় মানুষের জীবনযাত্রা, তথ্য অধিকার, পারস্পরিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে অধিকাংশ বিষয়কেই নিয়ন্ত্রণ করছে টেক প্রতিষ্ঠান। মহামারীর সময় বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে। পুঁজিবাদের বুকে পা রেখে মাথা উঁচু করেছে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা। নতুনভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে অগ্রবর্তী শ্রেণী ও পশ্চাদ্বর্তী শ্রেণী। বাংলাদেশের মতো সম্ভাবনাময় দেশের জন্য সময়টা সিদ্ধান্তমূলক। এখানকার শ্রমমুখী প্রজন্মকে প্রযুক্তির দিকে দক্ষ করে তুলে তা নতুন পরিস্থিতিতে উৎপাদনমুখী হয়ে উঠতে পারে। তাত্ত্বিক পড়াশোনার চেয়ে বর্তমানে প্রযুক্তিগত দক্ষতার উপযোগিতা বেশি। ফলে এ সময়ের অনীহা আরো একবারের জন্য পরাজয় নিয়ে আসতে পারে বাংলা মুল্লুকে। ঢাকার বাতাসে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়, দুঃখজনকভাবেই বাজেটগুলো তা প্রতিবিম্বিত করছে না।

আহমেদ দীন রুমি: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন