পর্যালোচনা

বাংলাদেশ ও জাপানের কৌশলগত সম্পর্কের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ড. এবিএম রেজাউল করিম ফকির

এ সপ্তাহের সবচেয়ে আলোচিত কূটনৈতিক খবর হলো বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত নতুন দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক। সপ্তাহ কয়েক ধরে চলমান নানা নাটকীয়তার পর গত ২৬ এপ্রিল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে জাপানের রাজধানী টোকিওতে বাংলাদেশ ও জাপান একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে এবং একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করে। এ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ও যৌথ বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে দেশ দুটির বিদ্যমান সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হলো। বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫১ বছর আগে। সে হিসাবে দেশ দুটি গত বছর (২০২২ খ্রিস্টাব্দ) কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করল। কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশ দুটির মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। সেজন্য জাপান বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নে অব্যাহতভাবে ঋণ ও অনুদান দিয়ে এসেছে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতিশীল হলে জাপান বাংলাদেশে শিল্প ও সেবা খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। দেশের সড়ক যোগাযোগ, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ইত্যাদি অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থনৈতিক ও প্রাযুক্তিক সহায়তা দিয়ে আসছে। বিদ্যমান এ সম্পর্ককে এতদিন উভয় দেশ ‘সার্বিক অংশীদারত্ব’-ভিত্তিক সম্পর্ক হিসেবে বর্ণনা করলেও গত ২৬ এপ্রিল নতুন সম্পর্ককে উভয় দেশ ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’-ভিত্তিক সম্পর্ক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

দুই দেশের সম্পর্ককে বৈশিষ্ট্যায়িত করতে ব্যবহৃত ‘কৌশলগত’ পরিভাষাটি কূটনীতিক মহলে এবং এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। কারণ কৌশলগত পরিভাষাটি আমাদের দেশে সমরবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত পরিভাষা বলে বিবেচনা করা হয়। বস্তুত দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক ও যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে দেশ দুটি নতুন সামরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু দশক দুই আগে এ দেশের কোনোটিরই সামরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মতো পররাষ্ট্রনৈতিক ও সামরিক ভিত্তি ছিল না। কারণ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হলো—বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত নীতি—‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’। তাছাড়া বাংলাদেশ কৌশলগত অংশীদারত্ব সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মতো অর্থনৈতিকভাবে ও সামরিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। অন্যদিকে জাপানের কোনো দেশের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক প্রতিবন্ধকতা ছিল। এ প্রতিবন্ধকতা আরোপিত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক। কারণ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রণীত সংবিধান অনুসারে জাপানের যুদ্ধ করার অধিকার ছিল না। কিন্তু চীন সাগর ও মধ্য এশিয়ায় গণচীনের আধিপত্যবাদী কার্যক্রম মোকাবেলার স্বার্থে জাপান ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে তার সংবিধান সংশোধন করে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে জাপান যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অধিকার ফিরে পায়। অধিকার ফিরে পাওয়ার বিষয়টি নিছক সংবিধানের সংশোধনী থেকে উৎসারিত হয়েছে তেমন নয়, বরং চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মিত্র তৈরিতেই যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে এ সুযোগ দেয়। জাপান তার সংবিধান সংশোধনের পর যুদ্ধ সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। এর পর থেকে জাপান পূর্ণোদ্যমে তার সামরিক শক্তি গঠনে মনোযোগ দেয়। জাপান এখন সামরিক বাহিনী গঠন, অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রয় এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে। দেশটি জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়াতে উচ্চপ্রাযুক্তিক পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোচ্ছে। 

বাংলাদেশ ও জাপান এ দুই দেশ অর্থনৈতিক, প্রাযুক্তিক ও সামরিক শক্তিতে সমপর্যায়ের নয়। কাজেই দুই দেশের সম্পর্ক হলো এক ধরনের অসম সম্পর্ক, যেখানে বাংলাদেশ অনুবর্তী আর জাপান কর্তৃত্ববাদী। তা সত্ত্বেও এ দেশ দুটি নতুন এমন একটি কৌশলগত অংশীদারত্বের সম্পর্কে জড়াল, যখন বিশ্ব রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও চীনের চীনসাগর অভিমুখী আধিপত্যবাদী নীতি ও আরব উপদ্বীপাঞ্চলের যুদ্ধাবস্থাকে ঘিরে বিশ্বে নতুন মেরুকরণের সূচনা হয়েছে। চলমান এ মেরুকরণের বাস্তবতায় বাংলাদেশের কোনো এক ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ মানে হলো—অন্য মেরুর দেশগুলোর আক্রোশের লক্ষ্যবস্তু হওয়া। মেরুকরণের এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জাপানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করল। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্যত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ করল, অর্থাৎ বিপরীতক্রমে রাশিয়া-চীনের নেতৃত্বাধীন বলয়ের দেশগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। 

এ পর্যায়ে কৌশলগত অংশীদারত্বের স্বরূপটি চিত্রায়ণের জন্য এ দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক ও যৌথ ঘোষণাকে বিশ্লেষণ করা যাক। নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশ ও জাপান এ দুই দেশের মধ্যকার স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকটি আট দফাবিশিষ্ট এবং যৌথ ঘোষণাটি ৩০ দফাবিশিষ্ট। কৌশলগত অংশীদারত্ব সম্পর্কিত জাপান-বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতিটি ৩০ দফাবিশিষ্ট, যা তিন পর্বে বিভক্ত: ১) প্রথম পর্ব: আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে পারস্পরিক সহযোগিতা: ১-১২ দফা, ২) দ্বিতীয় পর্ব: পারস্পরিক সুবিধা এবং আঞ্চলিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা: ১৩-২৫ দফা, ৩) সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যকার পারস্পরিক বিনিময়: ২৬-৩০ দফা। যৌথ বিবৃতির দলিলটিকে সামগ্রিকভাবে কৌশলগত অংশীদারত্বের দলিল হিসেবে বর্ণনা করা হলেও এ দলিলের প্রথম পর্বের ১০টি দফায় মূলত বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে যথাক্রমে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অংশীদারত্বের বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এ কৌশলগত অংশীদারত্বের দফাগুলোর কয়েকটিতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় আর কয়েকটি জাপানের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বিধৃত রয়েছে। এ কৌশলগত অংশীদারত্বের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিম্নে পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো।

জাপানের চীন-রাশিয়াবিরোধী যে পররাষ্ট্র ও সামরিক নীতি রয়েছে তাকে সমর্থনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্যত জাপানের সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অঙ্গীকার আদায় করেছে। জাপান মূলত একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে মেইজি বিপ্লবের পর জাপান একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতি ছিল সমগ্র এশিয়াকে করায়ত্ত করা। সে সময় থেকে চীন ও রাশিয়া জাপানের সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে মেরুকরণের বাস্তবতায় জাপান চীন ও রাশিয়াবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। এর কারণ নিহিত রয়েছে গণচীনের চীন সাগর অভিমুখী সম্প্রসারণবাদী তৎপরতায়। কারণ চীন সাগরে গণচীনের সম্প্রসারণবাদী নীতি সফল হলে জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসহ চীন সাগরে অবাধ চলাচলের অধিকার হারাবে। জাপানের বিপুল সমুদ্রসীমা চীনের করায়ত্ত হয়ে পড়বে। চীন সাগর অভিমুখী চীনের এ সম্প্রসারণবাদী তৎপরতাকে ঠেকাতে জাপান তার মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে গঠিত কোয়াডের আওতায় যুদ্ধকৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির অনুবর্তী বিধায় জাপান ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছে। যৌথ বিবৃতিতে জাপান তার চীন-রাশিয়াবিরোধী অবস্থানকে স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেছে যে ইউরোপ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা একই সূত্রে গাঁথা এবং চলমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে স্থিত রাখতে এ দুই অঞ্চলের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখযোগ্য যে জাপানসহ পশ্চিমা শক্তি রাশিয়া ও চীনকে যথাক্রমে ইউরোপ ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে। বাংলাদেশ ওই যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে জাপানের চীন-রাশিয়াবিরোধী অবস্থানকে সমর্থন জানাল। 

এ যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ জাপানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরো দুটি বিষয়ের অনুকূলে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। সেগুলো হলো উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক মারণাস্ত্র ও স্থাপনা তৈরির বিপক্ষে জাপানের কৌশলগত অবস্থানকে সমর্থন জানানো এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে জাপানকে এর সদস্য লাভে সমর্থন জানানো। বাংলাদেশ যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে এতসব সমর্থনের ফলে কার্যত জাপানের বৈশ্বিক পররাষ্ট্রনীতিকে সমর্থন জানাল। 

জাপানের বৈশ্বিক পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিকে সমর্থনের বিপরীতে বাংলাদেশ জাপানের কাছ থেকে রোহিঙ্গা নীতিকে সমর্থন ও আসিয়ান ঘোষিত পাঁচ দফা ঐকমত্যের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারকে তাগিদ জানানোসহ ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার অঙ্গীকার ও সম্মতি আদায় করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ জাপানের কাছ থেকে পরোক্ষভাবে বঙ্গোপসাগরে সম্ভাব্য (বা প্রচ্ছন্ন) ভারত, চীন ও মিয়ানমার কর্তৃক প্রযোজিত সম্প্রসারণবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে নৈতিক সমর্থন আদায় করল। কারণ এ বঙ্গোপসাগর হলো বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত একটি সমুদ্রাঞ্চল। আর জাপান সমুদ্রসীমায় স্বাধীন ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি পোষণ করে, তার আওতায় বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাপানের নৈতিক সমর্থন লাভ করল। 

বাংলাদেশ জাপানের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও প্রাযুক্তিক উন্নয়নেও ব্যাপক সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছে। জাপান মনে করে যে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহ শৃঙ্খল উন্নত করা হলে আঞ্চলিক অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটবে, যা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে অবদান রাখবে। বাংলাদেশকে ঘিরে জাপানের এ কৌশলগত অবস্থান ১০ বছর আগে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিগ-বি নীতির প্রতিফলন বিশেষ। উল্লেখ্য যে ১০ বছর আগে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গণচীন সরকারের গৃহীত ‘‌এক অঞ্চল, এক পথ নীতি’-এর বিপরীতে বিগ-বি নীতি গ্রহণের বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন। এই বিগ-বি নীতির আওতায় জাপান বাংলাদেশে শিল্প মান শৃঙ্খল ও স্থিতিস্থাপক সরবরাহ শৃঙ্খল সৃজনে সহযোগিতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এ দ্বিবিধ শৃঙ্খল সৃজনে প্রয়োজনীয় শিল্প অবকাঠামো ও যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরিতে জাপান সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এ সহযোগিতার আওতায় জাপান চট্টগ্রামের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে (যা চীন থেকে সংগৃহীত ডুবোজাহাজের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে)। একই সঙ্গে জাপান মাতারবাড়ীকে ঘিরে সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এছাড়া জাপান শিল্প উৎপাদন শৃঙ্খল উন্নয়নে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ‘বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপন এবং জাপানের বিনিয়োগে শিল্প ও সেবাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে সহায়ক ‘জাপান-বাংলাদেশ পাবলিক-প্রাইভেট যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপ’ নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। শৃঙ্খল সৃজনে সহায়ক ওই সংস্থান নির্মাণকাজের বাইরেও জাপান ঢাকা শহরে ‘ঢাকা ব্যাপকভিত্তিক দ্রুত অতিক্রমণ’-এর আওতায় মেট্রোরেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিমানবন্দর বর্ধিতকরণ প্রকল্প এবং পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পে আর্থিক ও প্রাযুক্তিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। 

যৌথ বিবৃতিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ভারত ও চীনের জন্য স্পর্শকাতর একটি বিষয় রয়েছে। এ যৌথ ঘোষণায় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দরে জাপান সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর যুদ্ধজাহাজের পৌনঃপুনিক আগমন এবং দুই দেশের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের পারস্পরিক সফর বিনিময়ের কথা উল্লেখ করে, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক উন্নয়নের আস্থা ব্যক্ত করেছেন। সেজন্য দুই দেশের পরস্পরের রাজধানী শহরে সামরিক শাখা স্থাপনের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ টোকিওতে প্রতিরক্ষা শাখা এবং জাপান ঢাকায় ন্যাশনাল সিকিউরিটি শাখা (কোক্কা আনজেন হোশো উইং) স্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রস্তাবিত পারস্পরিক এ দুই সামরিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সংলাপ বৃদ্ধিপূর্বক সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এ সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের সামরিক স্থাপনা উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে সমরাস্ত্রের ভাণ্ডার বৃদ্ধি ও যুদ্ধকৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি সমঝোতা স্মারকের ৪নং দফায় আরো পরিস্ফুট হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে—এ সমঝোতার আওতায় প্রতিরক্ষা সংলাপ, সফর বিনিময়, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কোর্স, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত অন্যান্য কার্যক্রম এবং সহযোগিতা জোরদার করা হবে।

যৌথ বিবৃতি সম্পর্কে ওই পর্যালোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশ ও জাপান অর্থনৈতিক, প্রাযুক্তিক ও সাংস্কৃতিক সমঝোতার আড়ালে ধীরে ধীরে সামরিক মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। ১০ বছর আগে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত বিগ-বি নীতিটি যে জাপানের একটি দুরভিসন্ধিমূলক কৌশলগত নীতি ছিল, তা আজ স্পষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জাপান তার সাম্রাজ্যবাদী সমরনীতি পরিত্যাগ করে। কিন্তু ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে সংবিধান সংশোধনের পর জাপান তার পূর্ণাঙ্গ সামরিক সক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট রয়েছে। সেজন্য তার নতুন সামরিক মিত্র দরকার। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জাপানের সাম্রাজ্য বিস্তার প্রয়াসের সময় জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোয় যে যুদ্ধের ক্ষত রেখে যায়, তা এসব অঞ্চলের দেশগুলোয় সামরিক মিত্র হিসেবে জাপানের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপানের সামরিক তৎপরতার আঁচ এ দেশে লাগলেও ক্ষতের পরিমাণ ততটা লক্ষণীয় ছিল না। যে কারণে বাংলাদেশের কাছে জাপানের সামরিক মিত্রতার প্রস্তাবনা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এ সামরিক মিত্রতা সফল হলে চীনের ওপর বাংলাদেশের যুদ্ধকৌশলগত নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। চীনের মিয়ানমার হয়ে বঙ্গোপাগরমুখী যে ‘‌এক অঞ্চল, এক পথ’ নীতি রয়েছে, তার বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। 

ড. এবিএম রেজাউল করিম ফকির: অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ; পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এবং ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন