রফতানি বৈচিত্র্যকরণে কাজ করছে মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চল

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার চররমজান সোনাউল্লাহ মৌজায় নির্মিত মেঘনা গ্রুপের অর্থনৈতিক অঞ্চল ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

পৃথিবীর সব দেশেই ফাইন্যান্সিং সিস্টেম এক, ভিন্ন ভিন্ন দেশের পরিপেক্ষিতে কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়েছে। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে প্যারিসের এক কনসোর্টিয়ামে ভিজিট ডেলিগেশনে গিয়েছিলাম। উনি সেখানে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বাংলাদেশ ল্যান্ড হাংরি কান্ট্রি। তখনো অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা শুরু হয়নি। চীন, ভারতবর্ষ, তাইওয়ান, মালয়েশিয়ার মতো দেশের ইকোনমিক জোনগুলো বিশাল, তাদের জায়গা অনেক বড়। 

আমাদের দেশের ডেনসিটি বেশি, জায়গা অনেক কম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ওদের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। সে তুলনায় আমাদের এখানে অল্প জায়গা। নিয়ম-কানুন পৃথিবীর সব দেশে একই। শুধু ওদের দেশে বিশাল জায়গা আছে, বিশাল অবকাঠামো আছে, আগের থেকে হয়ে গেছে, এখনো হচ্ছে। তফাত এটুকুই

 মোস্তফা কামাল

চেয়ারম্যান ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ


মুহূর্তে যে কয়টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় এবং সফল মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো। পরিকল্পিত শিল্পায়নে আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই। 

পরিকল্পিত অথনৈতিক অঞ্চল আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্রেইন চাইল্ড। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অর্থনেতিক অঞ্চলে পরিকল্পিত শিল্প গড়ে ওঠে। সে বিষয়টি মাথায় রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার ঘোষণা দেন। এটা অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। আমরা সেখানে তিনটা অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন পেয়েছি। অনুমোদনের পরপরই আমরা কাজ শুরু করে দিই। জমি ক্রয়, মাটি ভরাট, মাটি ভরাটের সঙ্গে সঙ্গে অঞ্চল পাওয়ার বিষয়টা প্রক্রিয়াধীন, সরকারের তো অনেক ক্রাইটেরিয়া আছে। আমরা ড্রেনেজ সিস্টেম, পাওয়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম উন্নয়ন, রাস্তা তৈরি করার কাজ চালিয়ে যাই। বেজা কর্তৃপক্ষ আমাদের এখানে আসে এবং আমাদের দ্রুত কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাগাদা দেয়।

কোনো দেশের অথনৈতিক অঞ্চল এক-দুদিনে হয় না। এর জন্য ১০-১৫ বছর সময় প্রয়োজন। জমি নেয়ার পর থেকে উন্নয়নকাজ শুরু করেছি। আমরা দেশে ইউরোপ, আমেরিকার মতো অত্যন্ত দ্রুত সিভিল কনস্ট্রাকশন করতে পারি না। আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে বিরতিহীন কাজ করে গিয়েছি। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশে অন্য দুর্যোগেও আমরা কিন্তু কাজ বন্ধ রাখিনি। যার জন্য দ্রুততার সঙ্গে পর্যায়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। কিছু বিদেশী আসছে, আরো আসবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কারখানা পরিদর্শন তো আপনার কাছে শখের মতো। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পরিকল্পিত শিল্পায়নের যে অগ্রযাত্রা, সেখানে বহির্বিশ্ব এবং বাংলাদেশের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য দেখেন

এটি একটি বৃহৎ ব্যাপার। পৃথিবীর সব দেশেই ফাইন্যান্সিং সিস্টেম এক, ভিন্ন ভিন্ন দেশের পরিপেক্ষিতে কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়েছে। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে প্যারিসের এক কনসোর্টিয়ামে ভিজিট ডেলিগেশনে গিয়েছিলাম। উনি সেখানে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ল্যান্ড হাংরি কান্ট্রি।তখনো অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা শুরু হয়নি। চীন, ভারতবর্ষ, তাইওয়ান, মালয়েশিয়ার মতো দেশের ইকোনমিক জোনগুলো বিশাল, তাদের জায়গা অনেক বড়। 

আমাদের দেশের ডেনসিটি বেশি, জায়গা অনেক কম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ওদের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। সে তুলনায় আমাদের এখানে অল্প জায়গা। নিয়ম-কানুন পৃথিবীর সব দেশে একই। শুধু ওদের দেশে বিশাল জায়গা আছে, বিশাল অবকাঠামো আছে, আগের থেকে হয়ে গেছে, এখনো হচ্ছে। তফাৎ এটুকুই।

তাদের অনেক ভূমি আছে, ফলে হরাইজন্টাল শিল্প উন্নয়ন হবে। আমাদের জমির সংকট, প্রেক্ষাপটে আমরা কি ভার্টিক্যালি করতে পারি না? বহুতলবিশিষ্ট অবকাঠামোর কারখানা করা যায় না?

সব ফ্যাক্টরি বহুতলবিশিষ্ট করা যায় না। আইটিসি, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি রকম হালকা শিল্প করা যায়, কিন্তু ভারী শিল্প করা যায় না। 

মেঘনা অথনৈতিক অঞ্চলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের যেসব প্রকল্প রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে একটু বলুন। 


আমাদের এখানে ১১টা বিদেশী কোম্পানি এসেছে। এর মধ্যে একটি চীনের, একটি ভারতের, দুটি অস্ট্রেলিয়ার, দুটি জাপানিজ এবং বাকি সব ইউরোপীয় কোম্পানি। মে মাসের তারিখ জার্মানির সিএইচটি এবং ২৪ তারিখ চীনের একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির কারখানা উদ্বোধন হবে। চীন, তাইওয়ান এবং আরো কয়েকটি দেশের বিনিয়োগকারী অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করেছেন। বিনিয়োগ তো সময়সাপেক্ষ বিষয়। আমরাও যদি কোথাও বিনিয়োগ করতে যাই, দেখব জায়গা কেমন, এলাকা কেমন, রাজনৈতিক কোনো ঝুট-ঝামেলা আছে কিনা, সুযোগ-সুবিধা কেমন। 

আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করে রাখছি। এখন তারা এসে যখন দেখবে আমাদের রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, বন্দর, জেটি সবকিছু আছে। তারা বিনিয়োগ করতে পারবে। বাংলাদেশে এতগুলো ইকোনমিক জোন আছে। এখানে এতগুলো বিদেশী শিল্প আসছে। রাস্তাঘাট, বন্দর, জেটি, নৌ, পরিবহন সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তখন তারা বিনিয়োগ করতে আসবে। সে ক্ষেত্রটা আমরা তৈরি করতে পেরেছি।

অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? এরই মধ্যে তিনটি ইকোনমিক জোনের কথা আমরা জানি। নতুন কী কী পরিকল্পনা আছে?

নতুন পরিকল্পনা বলতে আমরা প্রায় ৪০০ একরের মতো জায়গা নিয়েছি। সেখানে আমরা তিতাস ইকোনমিক জোন নামে আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা করছি। সেটা বেজা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছি। ওটা প্রক্রিয়াধীন। 

একটা জিনিস হলো কি, মাতারবাড়ীতে হাজার ৩০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টের জন্য সরকার হাজার ৪০০ একর জমি দিয়েছে। সেখানে ওয়্যার হাউজ, গোডাউনসহ নানা ধরনের পণ্য রাখতে হবে। আমাদের দেশে জায়গা সংকট। আমি এখানে ৪০০ একর নিয়েছি। বড় জায়গা না হলে শিল্পাঞ্চল করা মুশকিলের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। ভারী শিল্প বা বৃহৎ শিল্প করতে হলে বেশি জায়গার প্রয়োজন। আমরা কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি, এর জন্য ৪০০ একরে হবে না। ৬০০-৭০০ একর জায়গার প্রয়োজন। পৃথিবীর বৃহৎ ফাইন্যান্সিং কোম্পানির সঙ্গে, বৃহৎ ফাইন্যান্সারদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, টেকনোলজি বেইজ যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। এটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। একটা বৃহৎ প্ল্যান করতে গেলে ফাইন্যান্স এবং টেকনোলজি পেতে হবে। বৃহৎ ফাইন্যান্স বলতে আমি বোঝাচ্ছিফিউ মিলিয়ন ডলার।হাজার একর জায়গা ছাড়া এখানে মাঝারি বড় সাইজের শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারতে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে তা আমরা চিন্তা করতে পারি না। মাঝারি বড় সাইজ অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে গেলেও এক থেকে দুই হাজার একর জায়গার কম হলে হয় না। 

আমরা এক দুইশ একরের মধ্যে ১০টা, ২০টা, ৩০টা ফ্যাক্টরি করছি, কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, তোমরা শ্রমঘন কারখানা করো। এখন আমাদের উদ্যোক্তারা ভাবছেন কীভাবে ভালো প্রযুক্তি, ভালো বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলছেন, তোমরা এক্সপোর্টের দিকে যাও। আমাদের শ্রমশক্তি বেশী আছে, শ্রমশক্তি রফতানিও করছি। একই সঙ্গে রফতানিকে বৈচিত্র্যকরণ করতে আমাদের অন্যান্য খাত এবং পণ্য নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে। 

রফতানি নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন? বৈচিত্র্যকরণে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ নতুন কী নিয়ে আসতে পারে?

আমাদের এখনো হাফ বিলিয়ন (৫০০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা আছে। আমাদের এখনো ৩০০-৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো রফতানি আসছে। সরকারের প্রশাসনযন্ত্র আমলাতন্ত্রের দিক থেকে একটু সমস্যা রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে, অপ্রচলিত পণ্য যদি রফতানি করা হয় তাহলে সেখানে ইনসেনটিভ দিতে। আমরা অপ্রচলিত পণ্য রফতানি করছি, কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়কে ধরাধরি করতে হয় বছরের পর বছর। 

রফতানিতে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। তবে এটা আমার একার পক্ষে সম্ভব না। এটা সামষ্টিকভাবে করতে হবে। আর এর দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, রফতানিতে বৈচিত্র্য নিয়ে আসো। কিন্তু কে করবে বৈচিত্র্যকরণ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আছে, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোসহ খাতসংশ্লিষ্ট আরো অনেকেই আছে। অপ্রচলিত পণ্য যখন আমরা পাঠাব তখন সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন। স্পেশালাইজড কেমিক্যাল দেশে প্রথম আমরা করি। কিন্তু আমাকে তাইওয়ানের ফুজিয়ান, ভারতের রিলায়েন্সের সঙ্গে কম্পিটিশন করতে হচ্ছে। তারা কারখানা করেছিল ১৫-২০ বছর আগে। তখন টাকা কম ছিল, মেশিনের দাম কম ছিল। তারা তখনই কারাখানা স্থাপন করে মূলধন উঠিয়ে ফেলেছে। এখন আমি এখানে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছি, ওর এখানে লাগবে হয়তো ৫০ মিলিয়ন বা ১০০ মিলিয়ন। এখানে আমি সরকারের নীতি সহায়তা পেলে পেট্রো কেমিক্যাল বড় করতে পারব। এগুলোর প্রতি সরকার উৎসাহ, ইনসেনটিভ দিলে ইনসেনটিভ না হোক অন্যভাবে কীভাবে কী দেয়া যায় সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ২০২৬ সালে আমরা উন্নত বিশ্ব থেকে জিএসপি সুবিধা পাব না। জিএসপি না পেলে সরকার কীভাবে রফতানিকারকদের উৎসাহিত করবে সরকারের বিষয়টিও চিন্তায় আছে। সরকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।  

কামাল ট্রেডিং থেকে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডস্ট্রিজের যাত্রার গল্পটা একটু শুনতে চাই।

মানুষ তো বলে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত। আমরা নিম্ন মধ্যবিত্তও ছিলাম না, ছিলাম একেবারে নিম্নবিত্ত। অর্থাৎ এদেশে একেবারে চাষাভূষা যাকে বলে। আমার বাবা একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠার গল্প অনেক লম্বা। 

রংপুরে যেটাকে মঙ্গা বলে আমাদের এখানে সেটাকে রাট বলে। আমি আমার পরিবারসহ আমাদের আশপাশের পরিবার ওই অভাব রাটকে প্রত্যক্ষ করেছি। একবার-দুবার না, অসংখ্য বার। সেই ১৫-২০ বছর ধরে। সেখানে কীভাবে মানুষ না খেয়ে ছিল, কীভাবে আমরা না খেয়ে ছিলাম তা এখনো আমার স্মৃতিতে ভাসে। এটা কোনো গল্প না, এটা বাস্তবতা। 

আপনার শৈশবের স্মৃতি নিয়ে যদি একটু বলতেন। 

আমাদের সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে তুলে দেয়া হতো, আমাদের ছোট্ট একটা গরু ছিল, গরুর জন্য ঘাস কাটতে হতো, ঘাস তুলতে হতো, ঘাস তুলে মক্তবে যেতে হতো। চারটা চাল মুখে দিয়ে হয়তো মক্তবে যেতাম। তারপর সেখান থেকে এসে হাতের কাজ মানে বাংলা, ইংরেজি এসব লিখতে হতো। লেখা শেষে পুকুরে গিয়ে চড়ুই পাখির মতোহাতড়াইতাম।শীতকালে স্কুল থেকে যখন ফিরতাম, তখন তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে যেত। ওই সময়ে সারা দিন আমরা টিউবওয়েলের পানি খেতাম। তখন খাওয়ার জন্য বিস্কুট, দুপুরের খাবার কিছুই ছিল না। আমরা তো এভাবেই গড়ে উঠছি। আমরা ভাত না খেয়ে স্কুলে গিয়েছি। রাটের সময়তো আর ভাত পাওয়া যায় না। -১০ মাইল হেঁটে স্কুলে যেতাম। কলেজে ওঠার পর বাবাকে সাইকেল কিনে দিতে বলি। কিন্তু বাবা কিনে না দেয়ায় রাগ করে চলে আসি। এরপর যাত্রাবাড়ীতে এক বাসায় লজিং থাকি। পরে এক পরিচিত পুরান ঢাকায় একটি দোকানে ১৭৫ টাকা বেতনে চাকরি পাই। চাকরি তো পেলাম। যাত্রাবাড়ী থেকে রিকশায় আসতে গেলে পুরো মাসের বেতনের টাকা খরচ হয়ে যায়। পরে সেখান থেকে পুরান ঢাকা চলে এলাম। পরে অবসর সময় কাটবে কীভাবে। সকালে একটা লজিং নেই, বিকালে একটা লজিং নেই। সেখানেই সকাল-রাতের খাবার খেতাম। আমার তো মাথায় ছিল আমাদের একান্নবর্তী পরিবার, কষ্টের সংসার। আমার বন্ধু প্রভাবিত করে আমাকে বক্সওয়ালা গাড়ি নিতে। পরে গাড়ি নিয়ে ফুলবাড়িয়া থেকে গুলিস্তান সোহরাওয়ার্দী হয়ে ফার্মগেট, মিরপুর-১১ ভাড়ায় চালানো শুরু করলাম। নিজেই কন্ডাক্টর হতাম। 

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা, তা আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাবনা নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখেন?

পৃথিবীর যেকোনো অর্থনৈতিক সমস্যায় হোক ঘূর্ণিঝড় বা দুর্বিপাক, সেখানে উন্নয়ন কিছুটা ব্যাহত হয়। বিশ্বে অর্থনৈতিক যে অস্থিরতা, যেমন করোনা গেল, করোনার পর পৃথিবীটা আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পরে ভূরাজনীতির নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে, যা কিছু হবে তার সঙ্গে আমাদের খাপখাইয়ে নিতে হবে। যার জন্য আমরা একটু সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মধ্যে আছি। আর অর্থনৈতিক বিষয়গুলো এমন ব্যাপার হঠাৎ করে কিছু ঘটে গেলে পুনরুদ্ধার করা যায় না। ঘটে যাওয়ার পর শোধরানোর চেষ্টা করতে হয়। আমরা বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী, তবে বিষয়গুলো যে সহসা কেটে যাবে, এমন মনে হচ্ছে না। 

স্পেসিফিকভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চল
নিয়ে কোনো পরিকল্পনা, যেমন সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার জন্য দ্রুতগতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনার কাছে কি মনে হয় যে গতির লাগাম টানা দরকার?

না না। আমি এটা মনে করি না। কাজ চলতে থাকবে, কোনো কাজ তো বন্ধ থাকবে না। এখন তো অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বসে থাকার মতো বা বাদ দেয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি দেশে নেই। যেসব বিনিয়োগ সরে আসছে সেগুলো ধরে রাখার জন্য আমাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো দ্রুত প্রস্তুত করা উচিত। 

দেশের জমিস্বল্পতা, জ্বালানি অনিশ্চয়তা, পানি সংকটের প্রেক্ষাপটে আমাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ কতটুকু সম্ভব হচ্ছে। আমাদের যতটা এফডিআই দরকার সেভাবে তো দেখছি না। আপনিও নিজের হাতে তিন-চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ছেন। বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে পারছি কি আমরা?

আপনি যা উল্লেখ করেছেন তা বাস্তব সত্য। কিছু কিছু আমরা গড়ছি। গত কয়েক বছরে সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন যথেষ্ট করেছে। আমরা আশা করি সংকট থাকবে না। সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডেও এমন সমস্যা ছিল। এটা বড় কোনো সমস্যা নয়, আমাদের পরিকল্পিতভাবে এগোনো উচিত। আমাদের সরকার যেভাবে পরিকল্পনা করছে, আমাদের সুশীল সমাজ যেভাবে সরকারের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। একসঙ্গে কাজ করে আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করব। আমার যেটা নেই তো নেই, আমাকে বিকল্পের চিন্তা করতে হবে। 

জ্বালানি অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য সরকারের পরিকল্পনা কি সঠিক পথে আছে বলে মনে করেন?

সঠিক দিকে নেই। পেট্রোবাংলার ক্ষমতা আরো বাড়ানো উচিত। বাপেক্স দিয়ে গ্যাস ওঠাতে পারে, কয়েক বছর আগে আমরা সমুদ্র বিজয় করলাম। সমুদ্র তো আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এসব সুযোগ এখন চীন নিয়ে যাচ্ছে। সে তো বসে নেই। আমার একটা কূপের দুই-তিন কিলোমিটার দূরে অন্যের জায়গা থাকলে সে তো তা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ব্লু ইকোনমি যাতে আরো বিস্তৃত করতে পারি তা নিয়ে কাজ করা উচিত। বাংলাদেশে গ্যাস এখনো অনেক জায়গায় আছে কিন্তু সেগুলো উত্তোলন কার্যক্রম খুব ধীর গতিতে হচ্ছে। ফুয়েল ইজ বিগ ফাইন্যান্সিয়াল ইস্যু। 

অপরিকল্পিত বিনিয়োগ করে যারা বড় হয়েছে, যারা বিদ্যমান বিনিয়োগকারী তাদের এবং যারা পরিকল্পিত বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে অর্থনৈতিক অঞ্চলে তাদের ক্ষেত্রে যে নীতি বৈষম্য, তাতে কি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে?

যেগুলো হয়ে গেছে সেগুলো স্থানান্তর কিংবা নষ্ট করে দেয়ার তো কোনো যৌক্তিকতা নেই। নতুন করে পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ করা উচিত। এটার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ, যার কারণে কেমিক্যাল, চামড়া শিল্প, ডায়িং ফ্যাক্টরি মতো খাতভিত্তিক নির্দিষ্ট জায়গায় করে দিতে হবে। কারণ বর্জ্যগুলো আবার একটু ভিন্ন। কারণ এসবের পরিশোধন খুব বেশি দরকার। ধানের জমি নষ্ট করে ফেলব, আমার জমি আমি কেটে ফেলব এটা তো উচিত না। 

এজন্য সরকার বলেছে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। বগুড়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চল নেই। বগুড়ায় কিছু করতে হলে জেলা প্রশাসন বলে দেবে। জেলা প্রশাসন ঠিক করে দেবে। তিন ফসলি জমি হলে সেখানে শিল্পাঞ্চল গড়া যাবে না। সরকারকে আমি অনুরোধ করব যেসব অঞ্চল এখনো উন্নত নয় সেসব অঞ্চলে ইনসেনটিভ দিয়ে সরকারেরও কাজ করা উচিত এবং উদ্যোক্তাদের সেখানে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া উচিত।

এখনো যারা পরিকল্পিত শিল্পায়নে আসেনি তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ

পরিকল্পিত শিল্পায়নে না এলে আপনি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আপনি গ্যাস পাবেন না, পানি পাবেন না, অন্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। একজন উদ্যোক্তার এসবের দরকার। রাস্তাঘাট না থাকলে পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। তার পরিবেশগত নানা সমস্যার সৃষ্টি হবে। 

বিশ্বের কয়েকটি দেশে আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে দেখেছি, বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসায় এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বিরোধ। প্রেক্ষাপটে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিকল্পনা কী?

এটা নিয়ে আমি গত সাত-আট বছর ধরে কাজ করছি। পরে প্রাইসওয়াটারহাউজকুপারস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে দিয়েছিলাম। একটা কনক্লুশনে এসেও আমরা ট্রাস্ট করতে পারিনি। আমাদের দেশে ট্যাক্স অন ট্যাক্স বলে একটা বিষয় আছে। অলিখিতভাবে আমরা একটা শাসনতন্ত্র তৈরি করেছি, যেমন ভারতের টাটা, তাদের ফ্যামিলির কেউ- নেই। উল্টো তারা এখন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস কিনে নিয়েছে। আমাদের পাকিস্তান আমলে থাকা সেই ২০ পরিবার বলেন, ২২ পরিবার বলেন আর ২৪ পরিবার বলেন কারো কিন্তু কোনো অস্তিত্ব নেই আর। এগুলো আমাকে তাড়িত করে। যার জন্য আমরা একটা আইন করছি, ছেলেমেয়েকে দিয়ে সিগনেচার করাব। আমাদের পরবর্তী জেনারেশন টু জেনারেশন যদি টিকে থাকে, ওদের জেনারেশনে ৩০ বছরের নিচে কেউ পরিচালক হতে পারবে না। যোগ্যকে যোগ্য জায়গায় বসাতে হবে। এতে যদি তারা কোনোকনসেনসাসেআসতে না পারে তাহলে কোম্পানিতে বোর্ড বসবে, প্রফেশনালরা চালাবে।

 

 শ্রুত লিখন: আরফিন শরিয়ত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন