সময়ের ভাবনা

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষা: জ্ঞান না সনদ কোনটা অর্জিত হচ্ছে?

তৌফিকুল ইসলাম

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গবেষণা ও চর্চা হয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয়ে পাঠদান করা হয়, সে বিষয়গুলোর গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং সমাজে উপযোগিতার দিকটি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। অধুনা সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে চাকরির বাজারে চাহিদার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্ঞানের মৌলিক শাখাগুলো পড়ানো হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজারমুখী বিষয়ের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য এখনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের নির্ভরতা রয়েছে। যে কারণে আসনস্বল্পতার পরও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে মূলত ‘‌ভর্তিযুদ্ধ’ বলা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বিভাগ পছন্দের বিষয়টি চলে আসে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সীমিত আসনের ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে সিরিয়ালে আগের দিকে অবস্থান থাকলে পছন্দের বিষয় প্রাপ্তির সুযোগ থাকে। সেটা না হলে তখন অপছন্দের বিষয় নিয়ে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে দেখা যায় অনেক শিক্ষার্থীকে। যার ফল দাঁড়ায় চার থেকে পাঁচটি বছর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বই/লেকচার শিটের শুকনো পাতায় চোখ বুলিয়ে কোনোমতে পরীক্ষাগুলো উতরে যাওয়া। অনেকের তো বইয়ের কাছেই যাওয়া হয় না, সিনিয়রদের কয়েক বছর আগের হ্যান্ডনোটের ফটোকপি পড়েই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হয়। কেউ কেউ আছেন যারা সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলিতে এগিয়ে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন উপভোগ করতে চান। কিন্তু নিজের ডিপার্টমেন্টের পরিচয় দিতে গিয়ে সংকোচবোধ করেন। যে কারণে আরবি বিভাগের শিক্ষার্থীকে বলতে শোনা যায়, তিনি সৌদি আরবের ডিপার্টমেন্টে পড়েন। কেউ দর্শন বিভাগে পড়ার কথা বলতেও সংকোচবোধ করেন। অথচ কলা ও সামাজিক অনুষদের ক্ষেত্রে আইন, অর্থনীতি, ইংরেজি, বাংলা, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লোক প্রশাসন, অপরাধ বিজ্ঞান, ইতিহাস, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ ইত্যাদি বিভাগের শিক্ষার্থীরা অন্তত বিভাগের পরিচয় নিঃসংকোচে দিতে পারেন। অপেক্ষাকৃত নতুন বিভাগ যেমন অপরাধবিজ্ঞান, যোগাযোগ বৈকল্য, বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরাও বিভাগের পড়াশোনাকে উপভোগের চেষ্টা করেন। তাহলে এই যে বিভাগকেন্দ্রিক পড়াশোনার বৈচিত্র্য সেটা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বাভাবিক বিষয় হলেও কর্মজীবনে কি আদৌ তার প্রভাব পড়ছে?

এখন সবার লক্ষ্য হয়ে গেছে বিসিএস, যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিগুলোয় পাঠ্যপুস্তকের বইয়ের চেয়ে বিসিএসকেন্দ্রিক পড়াশোনাই বেশি হয়। তাই কে কোন বিভাগে পড়ল সেটি নিয়ে হীনম্মন্যতায় না ভুগে নিজ নিজ মেধা দিয়ে পরবর্তী সময়ে ভালো অবস্থানে যাওয়াকেই প্রাধান্য দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পরামর্শ দেন। বিশেষ করে ওরিয়েন্টেশন বা প্রথম ক্লাসে শিক্ষকরা এভাবেই শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরাও ডিপার্টমেন্ট ও চাকরির পড়া দুটোকে পাশাপাশি রেখে নিজেদের শিক্ষাজীবন শেষ করে থাকেন। যারা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান তারা বিভাগের পড়া যত্ন নিয়ে পড়লেও অন্যরা কোনোমতে মোটামুটি ধরনের রেজাল্ট হলেই খুশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের যে পরিমাণ খরচ হয়, এত টাকা খরচ করার ফলাফল কী হচ্ছে? কর্মজীবনে চাকরির জন্য যদি পঞ্চম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীর বই পড়ার প্রয়োজনই হয়, তাহলে কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রয়োজন কেন হবে? এক্ষেত্রে যে চার-পাঁচ বছর সময় ব্যয় করা হয় সেটি কি শুধুই সনদ অর্জনের জন্য? না এর ফলে জ্ঞান অর্জনের প্রকৃত ইচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনে কাজ করে?

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি শুধুই সনদ প্রদানের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে না সেখানে গবেষণাসহ উচ্চশিক্ষার চর্চা হচ্ছে সেটি এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। না হলে সময়ের চাহিদা এবং বাস্তবতার নিরিখে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো শুধু সনদ মিলবে, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান আর হবে না।

এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ধরনের বিভাগগুলোর মধ্যে উর্দু, ফার্সি, পালি, সংস্কৃত বিভাগগুলোর প্রসঙ্গ চলে আসে। এ বিভাগগুলোয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের স্পৃহা কতটুকু তৈরি হচ্ছে আর শুধু সনদ অর্জনের চিন্তা কতটা কাজ করছে সেটি এখনই বিবেচনা করা প্রয়োজন। না হলে আগামীতে হতাশাগ্রস্ত এক প্রজন্ম আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। এটা সত্য, এসব ভাষাভিত্তিক বিষয়গুলোয় অসাধারণ শিক্ষকরা পাঠদান করেন। যারা নিজ নিজ গণ্ডিতে অনেক অভিজ্ঞ এবং প্রচুর অধ্যয়ন করেন। তারা শিক্ষার্থীদের ভেতর বিভাগের পড়াশোনায় আগ্রহ তৈরির চেষ্টাও করেন, কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাতে কতটুকু সাড়া দেয় সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় বটে। এজন্যই ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েও শিক্ষার্থীরা সংস্কৃত বলতে বা পড়তে পারেন না।

একই অবস্থা উর্দু, ফার্সি ও পালি বিভাগের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। উর্দু বিভাগও ২০১৬ সাল থেকে তিনবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করতে পারেনি। উর্দু বিভাগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এ ভাষাটির প্রসঙ্গ এলেই যে দেশের কথা উঠে আসে, সে পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব ধরনের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয়টির আন্তঃসংযোগ নেই। আবার পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ থাকলেও সেখানে বিভাগটিকে গুরুত্ব প্রদান করা হয় না এমন অভিযোগ রয়েছে। তবে বিভাগ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উর্দু বিভাগকে অবহেলা করে না।

উর্দু, ফার্সি, পালি, সংস্কৃত বিভাগের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বাংলায়ই পরীক্ষায় উত্তর দেন। যে কারণে তাদের সংশ্লিষ্ট ভাষায় দক্ষতা অর্জন হচ্ছে না। ফলে ভাষাগত বিভাগগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন শিক্ষাবিদরা প্রায় সময়ই বলে থাকেন। না হলে অদূর ভবিষ্যতে বিভাগগুলো যোগ্য শিক্ষকের সংকটে পড়বে। এটা সত্য, সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে পারলে পাঠক মনের কাছে এসব ভিনদেশী ভাষা খুবই আকর্ষণীয় বটে। তবে সে রকম জ্ঞানতৃষ্ণা নিয়ে বিভাগগুলোয় অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষার্থী পাওয়া খুব কঠিন। যে কারণে শিক্ষাবিদদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনে এসব ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বিভাগের অধীনে না পরিচালনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটের অধীনে নিয়ে আসা উচিত বলে মত দেয়া হয়েছে। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন দুরবস্থা রয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ ভাষাগুলোর প্রায়োগিক দিক ও গবেষণার কথা বলে থাকেন। কিন্তু স্নাতকোত্তর শেষ করার পর সংশ্লিষ্ট ভাষা নিয়ে গবেষণা করার মতো শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। তাই বিভাগের শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও আসন সংখ্যা কমিয়ে এ ভাষাগুলো নিয়ে পড়ার আগ্রহ আছে এমন শিক্ষার্থীদের নিয়েই যেন বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে আবেদন এখন পর্যন্ত রাখেনি। বস্তুত এই যে দেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তিযুদ্ধ এবং দেশসেরা বিদ্যাপীঠে যেকোনো বিষয় হলেই পড়ার মানসিকতা, সেটাই মূলত শিক্ষার্থীদের এসব বিষয় পড়তে ধাবিত করে। যে কারণে বিভাগগুলো থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা শিক্ষার্থীরা অকপটে স্বীকার করেন কেউ ইচ্ছা করে এসব বিভাগে ভর্তি হয় না। তাহলে দীর্ঘদিন ধরে এই যে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে অপছন্দের বিষয় পড়তে গিয়ে তারুণ্যের শক্তির নিদারুণ অপচয় হচ্ছে, বিষয়টি কি দেখার কেউ নেই? সরকারি কোষাগারের বিপুল পরিমাণ অর্থ শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও তো জবাবদিহি থাকা উচিত। স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হতে পারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ও গবেষণা বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তত সময়োপযোগী ভাবনার প্রকাশ থাকা উচিত। আমরা আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদেশী ভাষার বিভাগগুলোর ক্ষেত্রে দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন