নির্বাচনের সংকটই দেশের সব সংকটের মূল

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় এলে প্রথমে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পরবর্তী সময়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, আসন্ন নির্বাচন বিএনপির চলমান আন্দোলন নিয়ে বণিক বার্তা সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন

আপনাদের আন্দোলনের অন্যতম ইস্যুনির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের বিপক্ষে অনেকেই কথা বলছেন। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

আওয়ামী লীগই প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিল। যার জন্য তারা ১৭৩ দিন হরতালও পালন করে। সে সময় তাদের দাবিকে সমর্থন করেছিল জাতীয় পার্টি জামায়াতে ইসলামী। সে দাবির পেছনে তাদের যুক্তি ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস নেই। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলটি পাস করিয়ে নিয়ে আসেন। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ সেটি পার হয়ে এসেছে, ক্ষমতায় আছে। তাই তারা এটিকে শক্ত করে ধরে বলছে বদলানো যাবে না।

রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতার সে পরিস্থিতি এখনো বিদ্যমান। ২০১৪ ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংকটসহ সব সংকট একটা জায়গায়। নির্বাচনের সংকটই দেশের সব সংকটের মূল। মানুষ যখন থেকে ভোট দিতে পারছে না, তখন থেকেই সংকটগুলো তৈরি হচ্ছে। তাই আওয়ামী লীগের উচিত আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করা।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি লক্ষ্য। উন্নয়নের পরিকল্পনাগুলো অর্থনীতিতে কীভাবে অবদান রাখবে বলে আপনি মনে করেন?

গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হয় না। আমাদের এখানে রাজনৈতিক উন্নয়ন সাধন না করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা করায় জবাবদিহির ঘাটতি হচ্ছে। ফলস্বরূপ ওয়াসার চেয়ারম্যানের বেতন - লাখ টাকা, হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লুট হচ্ছে, ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩০ হাজার কোটি টাকা, সরকারের উচ্চপদস্থ লোকজন ব্যাংকে এখন হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি হচ্ছে। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির বিষয়ে কোথাও কোনো জবাবদিহি নেই।

যখন সাধারণ মানুষ একবারের জায়গায় দুবার খেতে পারবে, পরিপূর্ণ পুষ্টি খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারবে, মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবেসেটিকে আমি বলব উন্নয়ন। মেট্রোরেল তৈরি করলে বা ঢাকা শহরে একটি ফ্লাইওভার বানালেই উন্নয়ন হয় না। আজকে কেউ কোনো কাজ করে না, সবাই উন্নয়ন করে আর টাকা খায়।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা ডলার সংকট নিয়ে সব মহলে আলোচনা হচ্ছে। বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।

দেশের অর্থনৈতিক খাতে সংকটের প্রধান কারণ হলো দুর্নীতি। রাজনৈতিক মদদপ্রাপ্ত কিছু ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে অর্থ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকের পরিচালনা সিস্টেমে পরিবর্তন আনা হয়েছে। অতীতে একটি পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন পরিচালক হতে পারতেন, সেটি পরিবর্তন করে এখন চারজনে উন্নীত করা হয়েছে। এভাবেই একটি পরিবারকে যাচ্ছেতাই করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। শেয়ারবাজার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেকের মতে, ব্যাংক খাতে রকম ভয়াবহ অবস্থা বাংলাদেশে আর কখনো আসেনি।

ডলারের বেলায় দেশের একই অবস্থা বিরাজ করছে। ডলার আগেই পাচার হয়েছে, রিজার্ভ ভাঙিয়ে বেসরকারি খাতে দেয়ায় দেশের বাইরে চলে গেছে। এটিও করা হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে বিত্তশালী করার জন্য। এটা স্রেফ চুরি-ডাকাতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। এভাবেই দেশের অর্থনীতি চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে।

সরকারে ঋণ নেয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন?

শুধু আইএমএফ নয়, আরো অনেক জায়গা থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। ঋণের টাকা আগামী বছর থেকে পরিশোধ করতে হবে। সেই ঋণ শোধের মাত্রা অনেক বেশি। আগামী বছর থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার করে পরিশোধ করতে হবে। জনগণের কাছ থেকে ঋণের টাকাগুলো নেয়া হবে। সম্প্রতি গ্যাসের দাম, বিদ্যুৎ বিল বাড়ানোসহ বিভিন্নভাবে জনগণের ওপর এরই মধ্যে চাপ দেয়া শুরু হয়ে গেছে।

দুর্ভাগ্যক্রমে ব্যবসার স্বার্থে, নিজেদের লোককে সুবিধা দেয়ার স্বার্থে একটা আমদানিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা হয়েছে। অব্যবস্থাপনার কারণে আজকে অবস্থা হচ্ছে। অর্থনীতি একেবারে ধসে পড়েছে। ডলারের সংকটের কারণে অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে। সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রথমে আমাদের নিজেদের সম্পদ কীভাবে উত্তোলন করা যায়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা আগামী নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন?

যদি সঠিক নির্বাচন হয় তাহলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব থাকবে না। শুধু বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের এমন অবস্থা হবে। যেখানে সব পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থার ফলে অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। মানুষের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে।

আপনারা ক্ষমতায় এলে ঋণসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে সামাল দেবেন?

শুধু আমরাই নই, যে দলই পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসুক, রাষ্ট্রকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া খুব মুশকিল হবে। রাষ্ট্রকে মেরামত করা ছাড়া কোনো কিছুই ঠিক করা যাবে না। সেজন্য আমরা ২৭ দফার একটি কর্মসূচি দিয়েছি। যেখানে আমরা কমিশন গঠনের মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধান করার কথা ভাবছি। অপচয়, দুর্নীতি, বড়লোককে বড় লোক বানানোর প্রক্রিয়া কমিয়ে আনতে পারলেই সমস্যার সমাধান হবে।

বিএনপির আন্দোলন দীর্ঘদিন স্তিমিত থাকার পর হঠাৎ গতি বেড়ে যাওয়ার কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?

বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় ভিন্ন কোনো মতকে সহ্য করছে না। আইন-কানুন সেভাবেই তৈরি করছে। এর ফলে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আমাদের প্রধান দুই বা তিনটি সংকট তৈরি হয়েছে। একটি হলো মিথ্যা মামলা দিয়ে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী আমাদের দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চার বছর ধরে আটকে রেখেছে। এটা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তিনি বিদেশে নির্বাসিত অবস্থায় আছেন। তৃতীয়ত, একটা গণতান্ত্রিক দলের ৪০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা। ওয়ার্ড ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত মিথ্যা গায়েবি মামলা আছে। মামলাগুলো নিয়ে আমরা এখানে রাজনীতি করছি।

এত বাধা-বিপত্তির পর প্রচণ্ড রকম ধাক্কা খেয়ে আমরা দাঁড়াতে শুরু করেছি। আজকে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছি। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকেই দলকে নির্দেশ দিয়ে পুনর্গঠিত করেছেন।

অন্যদিকে সবগুলো আর্থিক খাতেই সরকার দুর্নীতি করেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংকগুলোতে লুটপাট চলছে। মূল্যস্ফীতি ভয়ংকরভাবে বেড়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে। সব মিলিয়ে দেশে চরম একটা নৈরাজ্য চলছে, যেখান থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে চায়। যার ফলে তাদের সমর্থনটা পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ সমর্থন দিচ্ছে বলেই আমাদের আন্দোলন বেগবান হচ্ছে।

রাজনৈতিক মাঠে দলের চেয়ারপারসন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে দলের ভেতরে কোনো ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে কি?

রাজনীতির বিরূপ একটা পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, যেখানে আমাদের ওপর অনবরত আক্রমণ করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে একটি দলের ওপর আক্রমণ করে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না। এসব কর্মকাণ্ড ঘটানোর কারণ হলো সরকার বিরোধী দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না।

আওয়ামী লীগের বডি কেমিস্ট্রি হলোআমি ছাড়া আর কেউ নেই অপরদিকে গণতন্ত্র ঠিক তার বিপরীত। আমাদের নেতৃত্ব খুবই শক্তিশালী। তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা দলকে সুসংহত করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশী কূটনীতিকরা আলোচনা করছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

বাংলাদেশ বিশ্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অংশ। এখানে বিদেশীরা বিভিন্ন খাতে টাকা দিচ্ছে। উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে যারা থাকে, তারা সবাই চায় গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হোক। আমাদের দেশে মানবাধিকার প্রচণ্ড মাত্রায় লঙ্ঘন হচ্ছে। যেমন গুম হয়ে যায়, বিনা কারণে প্রকাশ্যে মারা হচ্ছে, জেলের ভেতরে হত্যা করা হচ্ছে। অবস্থা যেন না হয়, নির্বাচন ব্যবস্থা যাতে ঠিক থাকে, সেজন্য পশ্চিমা বিশ্ব কথা বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী বলে গিয়েছেন, আমরা গণতন্ত্র মানবাধিকার বিষয়ে কখনো আপস করি না, আমরা এগুলো বলব, বলতেই থাকব।

ডোনাল্ড লুর ভারত হয়ে বাংলাদেশ সফর নিয়ে অনেক রকম কথা হচ্ছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

এটি একটি দেশের নিজস্ব প্রক্রিয়া। এতে বাংলাদেশের নির্বাচন কোনোভাবেই প্রভাবিত হবে না। কেননা উনাদের বক্তব্যে উনারা স্পষ্ট করেই বলেছেন, দেশে আগের মতো নয়, বরং সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই।

তবে স্যাংশনের ব্যাপারটি আমি অন্যভাবে দেখছি। স্যাংশন আমাদের দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর আরোপিত হওয়া লজ্জার। তারা গুম করেছে, বেআইনিভাবে হত্যা করেছে বলেই স্যাংশন আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এটার জন্য তারা দায়ী না। সরকার নির্দেশ দিয়েছে বলেই তারা বেআইনি কাজ করেছে। সুতরাং তাদের ওপর ব্লেইম না এসে সরকারের ওপর আসা উচিত।

আগামী নির্বাচনে বিদেশীদের কোনো প্রভাব থাকবে কিনা?

সরকারের দুর্বলতার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। যেহেতু সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তাই বিষয়গুলোতে কিছু বলতে পারে না। যেহেতু বাংলাদেশ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন না, তাই নির্বাচনে কিছু প্রভাব তো থাকবেই।

কিছুদিন আগেই আপনি জেল থেকে ছাড়া পেলেন। স্বাধীনতার আগে ছাত্রজীবনে বিভিন্ন সময়ে কারাবরণ করেছেন। আগেকার আর এখনকার কারা ব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?

বর্তমান সরকারের আমলে কারাগারের যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, অতীতে এমনটি ছিল না। এমনকি ব্রিটিশদের শাসনামলেও রাজনৈতিক বন্দিদের অবস্থা বর্তমানের চেয়ে ভালো ছিল। আগে বন্দিদের সসম্মানে কারাগারে রাখা হতো। তবে অন্যবারের তুলনায় এবার কারাগারে গিয়ে সবচেয়ে বেশি খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। একটি সেলের মধ্যে তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিলাম। একটানা সাত-আটদিন তালাবদ্ধ অবস্থায় সেলের ভেতরে কাটিয়েছি। একই সঙ্গে ডিভিশন প্রাপ্য থাকা সত্ত্বেও দেয়া হয়নি। প্রথমবারের মতো ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন