আধুনিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ

শফিকুল ইসলাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের ল্যাব ছবি: মাসফিকুর সোহান

দেশে চারু শিল্পের যে কয়টি ধারার শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম গ্রাফিক ডিজাইন। ভিজ্যুয়াল কনটেন্টের দুনিয়ায় আকর্ষণীয়ভাবে তথ্য উপস্থাপনের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ এটি। কল্পনা সৃজনশীলতার মেলবন্ধনে একটি ডিজাইন তৈরিতে যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে তোলা হচ্ছে তথ্য বা বার্তাকে। আধুনিক সমাজের এমন কোনো অনুষঙ্গ নেই যেখানে গ্রাফিক ডিজাইনারদের ছোঁয়া নেই। কারণে প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে গ্রাফিক ডিজাইনের গ্র্যাজুয়েটদের চাহিদা রয়েছে সর্বত্রই।

গ্রাফিক ডিজাইন মানুষের অস্তিত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদিও শুরুটা কোনো কম্পিউটার বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে হয়নি। প্রাগৈতিহাসিক কালের দক্ষিণ ফ্রান্সের লাসকাক্স গুহা, রোমের ট্রাজান কলাম, কয়েক হাজার বছর পরে মেসোপটেমীয়দের পাথরে খোদাই করা ব্লাউ মনুমেন্ট যেখানে সবার প্রথম শব্দ ছবি উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছিল। সেগুলো নিছক সাজসজ্জা বা সৌন্দর্যের জন্য করা হয়নি। তারা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই পাথর, গুহার দেয়ালে চিত্র আঁকত। আধুনিক সময়ে যা কাগজ, ক্যানভাস বা কম্পিউটারের পর্দায় করা হচ্ছে। বর্ণমালা, ভাষার উত্পত্তি, সভ্যতা প্রযুক্তি বিকাশের পালাবদলে পরিবর্তন এসেছে সেই যোগাযোগ মাধ্যমে। এখন যোগাযোগ মানেই শুধু কথা বলা বা ভাব বিনিময় নয়। ছোট একটি পোস্টার, চিত্র বা নকশা নীরবে বলে যায় অনেক কথা। মানুষের নির্দিষ্ট কোনো কল্পনা যখন শব্দ আর ছবির সমন্বয়ে বাস্তব রূপ পায় এবং সেটি যখন সমাজে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে তাকেই বলা হচ্ছে গ্রাফিক ডিজাইন। আধুনিক সময়ে যেটাকে ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনস বা দৃশ্যমান যোগাযোগ ব্যবস্থাও বলা হয়।

চীনে প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কার, শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী মুদ্রণ ব্যবস্থা এবং কম্পিউটার, ইন্টারনেট সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোর মতো ক্রমাগত প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে নতুন বাঁক নিয়েছে গ্রাফিক ডিজাইন। ১৯৯০ সালে অ্যাডোবি ফটোশপের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল, যা গ্রাফিক ডিজাইনারদের কাজ করার পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। তবে এর আগে সফটওয়্যারের কাজটিই করা হতো হাতে। ছাপা পদ্ধতি উদ্ভাবনের পরে যোগাযোগ বাণিজ্যিক প্রয়োজনেই সমাজে গ্রাফিক ডিজাইনের নিত্য প্রয়োজনীয়তার ব্যাপকতা শুরু হয়।

আইবিআইএস ওয়ার্ল্ডের সমীক্ষা অনুসারে, বর্তমানে বৈশ্বিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম বিবেচনায় গ্রাফিক ডিজাইন শিল্পের অবস্থান নবম। ২০২২ সালে বৈশ্বিক গ্রাফিক ডিজাইন শিল্পের বাজার দাঁড়িয়েছে হাজার ৩৪০ কোটি ডলারে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গড়ে প্রতি বছর দশমিক শতাংশ হারে বেড়েছে বৈশ্বিক গ্রাফিক ডিজাইন শিল্পের বাজার।

দেশে-বিদেশে শিল্পে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালু হয় গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস বিভাগের প্রধান . মুহাম্মদ এমদাদুর রাশেদ বলেন, বিশ্ব যেভাবে এগোচ্ছে এবং আধুনিকায়ন হচ্ছে তাতে গ্রাফিক ডিজাইন অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের সঙ্গে ভার্চুয়াল মার্কেটেও কাজের সুযোগ বেড়েছে অনেক। সম্ভাবনা সামনে রেখেই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফাইন আর্টস বিভাগে গ্রাফিক ডিজাইন ডিসিপ্লিন চালু করা হয়।

এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা শত শত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে গ্রাফিক ডিজাইনে ডিপ্লোমা কোর্স চালু আছে। এর বাইরেও বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে আছে স্বল্পমেয়াদি দীর্ঘমেয়াদি কোর্স। দেশের একমাত্র মুদ্রণ প্রযুক্তি বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের গ্রাফিক ডিজাইন টেকনোলজির শিক্ষক মো. হারিছুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকেই আয় শুরু করে। তারা গার্মেন্টস শিল্প, ডিজাইন হাউজসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে খণ্ডকালীন চাকরি করে।

নান্দনিক শিল্পে অপেক্ষা করছে অবারিত সম্ভাবনা। মুদ্রণ শিল্প, প্রিন্ট ডিজিটাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিকস মিডিয়া, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ডিজাইন হাউজ, প্রকাশনা শিল্প, ফ্যাশন হাউজ, ফার্মাসিউটিক্যালস, অ্যানিমেশনস, গেইমিং, সিরামিক ডিজাইন, টেকনোলজি, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় অন্যান্য অনুষঙ্গকোথায় নেই ডিজাইন! ডিজাইন ছাড়া আধুনিক সভ্যতার নান্দনিকতা কল্পনাই করা যায় না। আর যার ব্যাপ্তি এত বিস্তৃত যে, সেখানে কর্মসংস্থান কাজের সুযোগ অবারিত তা সহজেই অনুমেয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. হাশেম জানান, প্রাকৃতিক জিনিস ছাড়া সব জায়গায়ই এখন ডিজাইন। ডিজাইন বাদ দিয়ে বর্তমানে অনেক কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না।

গ্রাফিক ডিজাইন এমন একটি শিল্প যেখানে দেশে-বিদেশে কাজের সুযোগ অনেক বেশি। ভার্চুয়ালি কাজেরও সুযোগ বাড়ছে। সরকারি বেসরকারি চাকরিসহ ফ্রিল্যান্সিং, প্রডাক্ট ডিজাইন, টেক্সটাইল ডিজাইন, মার্কেটিং, পাবলিকেশন ডিজাইন, ব্র্যান্ডিং, পাবলিসিটি ডিজাইন, প্যাকেজিং, প্রিন্টিং প্রেস, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ডিজাইন, গেইম ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, মোশন গ্রাফিকস, থ্রিডি, টুডি মডেলিং, কার্টুন অ্যানিমেশন, ক্যারেক্টার অ্যানিমেশন, ব্রডকাস্ট ডিজাইন, ফিল্ম প্রডাক্টশন, ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস প্রডাকশন, ওটিটি প্লাটফর্ম, রেডিমেড গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন ডিজাইনাররা।

এছাড়া ইভেন্ট ডিজাইন, সেট ডিজাইন, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, ফটোগ্রাফি, ইমেজ ম্যানিপুলেশন, ইন্টারেক্টিভ মিডিয়া ডিজাইন, ফন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইউআই/ইউএক্স ডিজাইন, মোবাইল কোম্পানি, সংবাদপত্র, ফ্যাশন হাউজ, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, অলংকরণ, ইনডিপেনডেন্ট করপোরেট কমিউনিকেশন, ভিজ্যুয়াল স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়া যায় শিল্পে।

এদিকে দেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় মানসম্মত ক্যারিয়ারও গড়ছেন অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মাকসুদুর রহমানের ভাষ্যে, আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিদেশে বিশেষ করে আমেরিকা, কানাডা সিঙ্গাপুরে চাকরি করছে। অনেকে সেখানে গিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন