আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই ১৯৫৯ সালে। আমি ইতিহাস বিভাগে, আর রওনক জাহান রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। সে সময় মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করা বা বন্ধুত্বের সুযোগ কম ছিল। আমি শুনেছিলাম রওনক জাহান ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু অনার্সের পুরোটা সময়জুড়ে তার সঙ্গে কখনো আমার দেখা হয়নি। অনার্সের রেজাল্ট প্রকাশের পর অন্য মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখেছিলাম তাকেও।
তিনি যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করে ঢাকায় ফিরে আসেন তখন আমাদের দেখা হয়। রওনক জাহানের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে তিনি ছিলেন জ্ঞানতাপস, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যারের খুব প্রিয় শিক্ষার্থী। রাজ্জাক স্যার আমার বিভাগীয় শিক্ষক না হলেও তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব গভীর ছিল। সে হিসেবে স্যারের বাসায় একদিন রওনক জাহানের সঙ্গে দেখা। ওটাই ছিল প্রথম দেখা। তখন আমি তার থিসিসটা পড়ছিলাম, তাই বলেছিলাম আপনার লেখা খুব ভালো।
রওনক জাহানের গবেষণাপত্রটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে প্রকাশ হয়। তখন চারদিকে আন্দোলন চলছে, পাকিস্তান ভেঙে যাবে; এ প্রসঙ্গে রওনক জাহান তার গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ও দৃষ্টিকোণ তুলে ধরেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা অনেকের অবদান সম্পর্কে জানি। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে ড. রওনক জাহানের অবদানের বিষয়টি তেমন উঠে আসেনি। আমরা যদি তার ‘পাকিস্তান: ফেইলর ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’ বইটি পড়ি, তাহলে বুঝতে পারি যে তিনি সে সময় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি তার লেখায় পাকিস্তান ভাঙার পটভূমি যতটা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, অন্য কারো লেখায় ততটা স্পষ্টভাবে উঠে আসেনি। রওনক জাহানের গবেষণার গুরুত্ব এখানেই।
রওনক জাহান প্রচারবিমুখ মানুষ। অনেক সাধারণ মানুষও তার চেয়ে অনেক বেশি পরিচিতি অর্জন করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান কেন এক থাকতে পারল না, এ সম্পর্কিত সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা তিনি করেছেন তার গবেষণায়। এখনো তার এ গবেষণামূলক গ্রন্থটি ততটা পরিচিত নয় বলে মনে করি আমি।
রওনক পিএইচডি করতে গেলেন, আমি গেলাম লন্ডনে। দেশে ফিরে আমি যোগদান করলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারপর ১৯৭৪ সালে যোগ দিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ততদিনে রওনক ফিরে এসেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। তখন আমাদের প্রায়ই দেখা হতো, বেশির ভাগ সময়ই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যারের বাসায়। স্যারের মাধ্যমেই তিনি আমাকে চিনেছেন।
রওনক অনেক উঁচুমানের গবেষক, সে হিসেবে আমরা রওনক জাহানকে মূল্যায়ন করতে পারিনি। কারণ তার গবেষণা সম্পর্কে মানুষের যতটা জানা উচিত ছিল, তারা ঠিক ততটা জানে না। এমনকি অনেকেই রওনকের গবেষণার গুরুত্বকে উপলব্ধি করতে পারেনি। তিনি অত্যন্ত প্রতিভাবান শিক্ষার্থী ছিলেন, তেমনি উন্নতমানের গবেষকও। ‘পাকিস্তান: ফেইলিউর ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’-এর মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয় যে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি তিনি আগেই দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ড. এম মোফাখখারুল ইসলাম: সাবেক অধ্যাপক
ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়