আলোকপাত

আকবর আলি খান ছিলেন বিবেকের কণ্ঠস্বর

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

. আকবর আলি খানের মৃত্যু হঠাৎ করেই ধাক্কা দিল। দীর্ঘদিন ধরে তার স্বাস্থ্যগত সমস্যা বেড়ে যাচ্ছিল। শত অসুস্থতার মাঝেও তিনি জনসম্মুখে কথা বলার ক্ষেত্রে নির্ভীক ছিলেন। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে নিয়মিত কথা বলে যাচ্ছিলেন। এক্ষেত্রে তার অবস্থান ছিল স্পষ্টভাষী। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তিনি সবার দৃষ্টিকে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। ভাবি প্রিয় কন্যার মৃত্যু তার জীবনে বড় বিয়োগান্তক ঘটনা ছিল। এর সঙ্গে তার বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা তো ছিলই। তার পরও আকবর আলি খানের বিবেকের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার বীরত্বপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা মোটেও আকস্মিক ছিল না। তিনি বিভিন্ন পেশার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেনশিক্ষক, আমলা, মুক্তিযোদ্ধা, নীতিনির্ধারক, লেখক, বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তার দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল জীবনে প্রতিনিয়ত সততার দীপ্ত প্রকাশ, সেবার মনোভাব এবং শেখার জন্য মনোবাসনা ছিল।

আকবর আলি খান ভেতর থেকে জ্ঞানতৃষ্ণা অনুভব করলেও এক্ষেত্রে তিনি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন না। তার প্রথম দিকের বইডিসকভারি অব বাংলাদেশতাকে অসংখ্য উপাধী দিয়েছিল। তিনি তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ অবস্থানের ক্ষেত্রে খুবই সূক্ষ্ম ছিলেন এবং তার পাঠচর্চা ধরে রাখতে খুব আগ্রহী ছিলেন। আকবর আলি খানের গোঁড়ামিমুক্ত অবস্থান এবং যোগাযোগের ভাষা যার মধ্য দিয়ে তিনি জটিল অর্থনৈতিক ইস্যুকে উত্থাপন এবং বিভিন্ন ধরনের পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন। যা লেখক হিসেবে তাকে সফলতা এনে দিয়েছিল। এটি কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার নয় যে ইউপিএল এবং প্রথমা তার বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশ এখনো অব্যাহত রেখেছে। তার বইয়ের আগ্রহী পাঠকদের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলছে।

তার লেখালেখির ক্যারিয়ার প্রশাসন থেকে অবসর-পরবর্তী কোনো বিষয় ছিল না, তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পুরো কর্মজীবনেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তার দুটি বইডিসকভার অব বাংলাদেশপরার্থপরতার অর্থনীতিপ্রকাশিত হয়েছিল যখন তিনি সরকারের উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন।

আকবর ভাই জনসেবার ধারণার ক্ষেত্রে উদাহরণ দিতে গিয়ে শুধু কারো ব্যক্তিগত উন্নতির কথা তুলে না ধরে জনসেবার কথা বলতেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোনো নির্দেশনার ক্ষেত্রে তিনি সম্মত না হলেনোট অব ডিসেন্টলেখার ক্ষেত্রে নির্ভীক ছিলেন। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, তিনি বিশ্বাস করতেন একজন সরকারি কর্মকর্তার কাজ হচ্ছে সৎ এবং উপযুক্ত পরামর্শ প্রদান, যা নিছক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়ক ভূমিকা হিসেবে নয় বা তাদের ওপর ন্যস্ত স্বার্থের ক্ষেত্রে মন্দ দিককে অন্ধভাবে অনুসরণ করাও নয়, কিন্তু তিনি উন্নয়নমূলক প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কার্যকর সমাধান অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি খুবই সফল অর্থসচিব এবং মন্ত্রীপরিষদ সচিব ছিলেন। অবসরের পর তিনি বিশ্বব্যাংকে অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৫ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বিশ্বব্যাংকের কার্যালয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমলাতান্ত্রিক গতানুগতিক পদ্ধতি এবং প্রতিবন্ধকতায় পূর্ণ ধ্যান-ধারণার মধ্যেও তিনি ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। এটি জাতির জন্য একটি ক্ষতি, যখন তিনিসহ অন্যরা সরকারের ব্যবসা সংশ্লিষ্ট সংলাপের প্লাটফর্মদ্য বেটার বিজনেস ফোরাম গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যা পরবর্তী সরকার আর অব্যাহত রাখেনি।

তার ব্যক্তিগত জীবনে বিয়োগান্তক ঘটনা থাকার পরও তিনি কখনো জনসেবার কাজ থেকে বিরত হননি। বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্যে স্পষ্টভাষী কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা মোটেও সহজ ছিল না। আকবর আলি খান এক্ষেত্রে পুরোপুরি নির্ভীক ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যাওয়া জ্ঞানী ব্যক্তিদের তালিকায় তিনিও চলে গেলন। তার সময় শেষ হয়ে গিয়েছে, এখন অন্যদের ধারা বজায় রাখতে হবে। তার রেখে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি অবশ্যই উজ্জ্বল হবে।

. আকবর আলি খান আমলা হওয়ার আগে শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার সময় থেকে আমলা এর পরবর্তী জীবনে ওনার যে সামাজিক নেটওয়ার্ক সেটাও খুব সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময়। সে অর্থে তিনি আমলা-পরবর্তী জীবনে এক বর্ণাঢ্য অধ্যায় সংযোজন করেছেন। এতে অবশ্য আমি আশ্চর্য হইনি। কারণ তিনি বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ এবং সবসময় জ্ঞান অন্বেষণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। বাড়তি যে গুণ ছিল তার তা হলো সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটা ভাষা তৈরি করতে পেরেছেন তিনি। অনেক বইয়ে নানা জটিল বিষয় তিনি এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, উপস্থাপন করেছেন যে সহজেই তা মানুষের কাছে বোধগম্য হয়েছে।

তিনি ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। যেসব অনুজের সঙ্গে আকবর আলি খান খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাদের সঙ্গে আমাদেরও যোগাযোগ ছিল। সে হিসেবে তাকে সে সময় থেকেই খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে এসেছি। আজকের যুগে কয়েকটি ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। বর্তমানে খুব নিষ্ঠাবান জনস্বার্থে নিবেদিত আমলার সংখ্যা কমে গিয়েছে। তিনি সেক্ষেত্রে রোল মডেল। খুব দক্ষতা নিষ্ঠার সঙ্গে এবং জনস্বার্থের বিষয় বিবেচনায় রেখে আমলা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কেবিনেট সচিবও ছিলেন তিনি। সব ক্ষেত্রে তিনি নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

শিক্ষক জীবন থেকেই জ্ঞানচর্চার বিষয়টা ধরে রেখেছিলেন আকবর আলি খান। অনেকেরই জ্ঞানচর্চা বা গবেষণায় মনোনিবেশ নেই। আমলা জীবন শেষ হওয়ার পরে নাগরিক জীবনে জ্ঞানচর্চাকে বজায় রেখে তিনি নিজের আরেকটি চরিত্রকে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। সেক্ষেত্রে বলব, লেখক হিসেবেও তিনি সফল। কারণ তার বইগুলোর কাটতি অনেক। তিনি বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন বা লিখেছেন, যাতে করে তা পাঠকের মধ্যে আগ্রহের জন্ম দেয় এবং প্রবেশ করতে পারে। এক্ষেত্রেও তিনি রোল মডেল।

শতপ্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি বিবেকের কণ্ঠস্বর হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। নাগরিক সমাজের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটিকে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বা বিবেকের কণ্ঠস্বর অথবা জনস্বার্থে নিবেদিত কণ্ঠস্বর বলতে পারি। এক্ষেত্রেও তিনি খুব সফল সাহসিকতার সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। কারণ খুবই স্পর্শকাতর বিষয়ে বা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তিনি খুব স্পষ্ট সাহসী বক্তব্য রেখেছেন। দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। পারিবারিক ট্রাজেডি কিংবা শারীরিক সমস্যা তাকে বিরত রাখেনি। তিনি যেটা করতে চেয়েছেন, সেটা করে গিয়েছেন।

সমাজে আকবর আলি খানদের মতো কণ্ঠস্বরগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার গ্রহণযোগ্যতা কাকতালীয় কোনো বিষয় নয়। সামাজিক নেটওয়ার্ক তার বিস্তৃত ছিল। জ্ঞানের প্রতি আকবর আলি খানের দুর্বলতা ছিল। তার ট্র্যাক রেকর্ডের দিকে নজর দেয়া দরকার।

. আকবর আলি খান সমসাময়িক সময়ের অন্যতম ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাংলাদেশে আজ রোল মডেলের আকাল চলছে। আকালে তিনি নিজের মধ্যে তিনটি রোল মডেল সন্নিবেশ করেছিলেন। একটি হচ্ছে দক্ষ এবং জনস্বার্থে নিবেদিত আমলা, দ্বিতীয় কর্মঠ এবং লেগে থাকা গবেষক, এবং জ্ঞানপিপাসু। তৃতীয় হচ্ছে বিবেকের কণ্ঠস্বর। জনস্বার্থে যেগুলো বলা দরকার, পাবলিক ডিসকোর্সে সে বিষয়গুলো সাহসিকতার সঙ্গে সময়ের প্রয়োজনে তিনি বলে গেছেন। . আকবর আলি খান বাংলাদেশে আজকে অন্যতম রোল মডেল এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

 

. হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন