ব্যয় সংকোচন ও টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাব

ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয় কমার শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক

গোটা বিশ্বেই জনগণের মাথাপিছু আয়কে ডলারে প্রকাশ করা হয়। গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় দেখানো হয়েছিল হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। এক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছিল সাড়ে ৮৫ টাকা। টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের ফলে ডলারের বিনিময় হার এখন ১০৮ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। বর্তমান বিনিময় মূল্যকে আমলে নিলে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ কমে প্রায় ৫৮৮ ডলার।

টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে চলতি অর্থবছরেও মাথাপিছু আয় কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত অর্থবছরে মাথাপিছু আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল শতাংশ। চলতি অর্থবছরেও একই হারে প্রবৃদ্ধি হলে টাকার অংকে মাথাপিছু আয় ২২ হাজার টাকা বাড়তে পারে। তবে বিদ্যমান বিনিময় হার আমলে নিলে ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয় বাড়ার বদলে উল্টো কমে যাবে।

বাংলাদেশের জিডিপি মাথাপিছু আয়কে প্রথমে টাকার অংকে হিসাবায়ন করা হয়। এরপর সেটিকে বিদ্যমান বিনিময় হার আমলে নিয়ে রূপান্তর করা হয় ডলারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে দেশের মোট জিডিপির আকার ছিল ৩৯ হাজার ৭৬৫ বিলিয়ন টাকা। মার্কিন মুদ্রার হিসাবে এর পরিমাণ ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। গত ছয় মাসে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। অবমূল্যায়ন আমলে নিলে বাংলাদেশের জিডিপির আকারও ডলারের হিসাবে সংকুচিত হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টাকার অবমূল্যায়নের ফলে ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয়ও বছর কমবে। অর্থনীতি শ্লথ হয়েছে, এর প্রভাব জিডিপিতে দেখা যাবে। আমদানি কম হচ্ছে। মূলধনি যন্ত্র আমদানি কমে আসবে। বিনিয়োগও কম হবে। সব মিলিয়ে প্রবৃদ্ধির ওপর অর্থনৈতিক শ্লথতার বিরূপ প্রভাব দেখা দেবে। প্রবৃদ্ধি যদি সাড়ে শতাংশ হতো সেটা হয়তো বা শতাংশে নেমে আসবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক . আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, মুদ্রা বিনিময় হার, মুদ্রানীতি রাজস্বনীতিতিনটি যখন সংকোচনমূলক হয় তার একটা প্রভাব চাহিদার ওপর পড়ে। মুদ্রা বিনিময় হারের মাধ্যমেই চাহিদায় প্রভাব দেখা যায়। কারণ আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। ফলে চাহিদা শ্লথ হয়ে যায়। জিডিপি টাকার অংকে যে বৃদ্ধি হতো, সে বৃদ্ধিটা কম হবে। আর ডলারে যখন হিসাব করব তখন কমে যাবে। টাকার ২৫ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে।

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হিসাব করা হয় ভোগ, বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয়তিন নির্দেশকের ওপর ভিত্তি করে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভোগে এরই মধ্যে প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগও প্রভাবিত। বাকি থাকে সরকারি ব্যয়। সরকার নিজেই ব্যয় সংকোচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। আমদানিতে বিধিনিষেধের কারণে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যও কমবে। দেশের জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। আমদানি কমায় সেবা খাত সংকুচিত হবে।

বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কমাতে শিল্পে জ্বালানি রেশনিং নীতি নিয়েছে সরকার। এতে জ্বালানি ব্যবহার কমে যাচ্ছে। কমছে শিল্পোৎপাদনও। শুধু কৃষি খাতে বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব তেমন নেই। দেশের মোট জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১৫ শতাংশ। বাকি ৮৫ শতাংশ অবদানই শিল্প সেবা খাতের। শিল্প সেবা খাত সংকোচনের নেতিবাচক প্রভাব জিডিপিতে পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

যদিও সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, জিডিপিতে মুদ্রা অবমূল্যায়নের নেতিবাচক নয়, বরং ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ডলারের বিনিময় হার বাড়ার কারণে রফতানিকারকদের পাশাপাশি প্রবাসীরা উৎসাহিত হচ্ছেন। আমদানি নিরুৎসাহিত হয়ে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ছে। এসবের ইতিবাচক প্রভাব জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে পড়বে।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী . শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, মাথাপিছু আয় যখন বলা হয়, তখন নামিক মূল্যে বলা হয় না, অর্থাৎ যা বাড়ে সেটা বলা হয় না। মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়ে বলা হয়। প্রবৃদ্ধি যদি ১৪ শতাংশ হয়, সেখান থেকে মূল্যস্ফীতি যদি শতাংশ হয়, সেটা বাদ দিয়ে বলা হয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি। কাজেই মাথাপিছু আয়টা প্রকৃত আয়, যেটা মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়ে গণনা করা হয়। জাতীয় মাথাপিছু আয় গত অর্থবছরে ছিল হাজার ৮২৪ ডলার। আমদানি-রফতানি সবই হয় বর্ধিত মূল্যে হিসাব করে। আমাদের সব আয়কেই আমরা ১০৬ টাকা দিয়ে ভাগ করব। ফলে মুদ্রা বিনিময় হার যেটাই থাকুক সেটার মাধ্যমে আমরা ডলারে প্রকৃত আয় জানতে পারব।

গত অর্থবছরে রেকর্ড ১৪১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক বাণিজ্য করেছে বাংলাদেশ, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বৈদেশিক বাণিজ্যের মধ্যে ৮৯ বিলিয়ন ডলার ছিল আমদানি খাতের। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে আমদানির লাগাম টেনে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিদ্যমান ডলার সংকট কাটাতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঋণপত্রের মার্জিন বাড়ানোসহ বিভিন্ন ধরনের শর্ত জুড়ে দেয়ায় এরই মধ্যে আমদানি কমে এসেছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আগস্ট সেপ্টেম্বরে বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি ব্যয় কমেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গিয়েছে।

২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৬৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে ব্যয় ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে সাড়ে ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অন্তত ২০ বিলিয়ন ডলার আমদানি কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। লক্ষ্য বাস্তবায়নে নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়নও হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চাচ্ছে চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসুক। লক্ষ্য বাস্তবায়নে এরই মধ্যে কঠোর অনেক সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আগস্ট সেপ্টেম্বরে গৃহীত পদক্ষেপের সুফলও পাওয়া গিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি কমে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধিতেও পড়বে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ইউরোপ আমেরিকায় চলমান অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আসন্ন শীত মৌসুমে ইউরোপের অর্থনীতি বেসামাল হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। অবস্থায় চলতি অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ৩০ বিলিয়ন ডলার কমতে পারে। এর প্রভাবে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে আমদানি কমে গেলেও এখনই তার নেতিবাচক প্রভাব দেশের জিডিপিতে পড়বে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ . মো. হাবিবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে রফতানি রেমিট্যান্স উচ্চপ্রবৃদ্ধির ধারায় আছে। প্রবৃদ্ধির ধারা সহসা কমবে বলে মনে হয় না। আমদানি কমার বড় কোনো প্রভাব এখনই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পড়বে না। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হলে সেটি ভিন্ন কথা।

ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের ফলে মাথাপিছু আয় কমে যাবে কিনা জানতে চাইলে . মো. হাবিবুর রহমান বলেন, জনগণের মাথাপিছু আয় টাকায় হিসাব করা হয়। এরপর সেটিকে ডলারে রূপান্তর করে দেখানো হয়। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয় কিছুটা কমে যাবে। তবে অর্থবছর শেষে টাকার অংকে জিডিপির আকার মাথাপিছু আয় বাড়বে। এটিকে আমলে নিলে ওই সময়ের বিনিময় হার অনুযায়ী মাথাপিছু আয় কমে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা বা হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলার। এক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ধরা হয় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে মাথাপিছু আয় লাখ ৪১ হাজার ৪৭০ টাকা বা হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার দেখানো হয়। এক বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয়ে প্রবৃদ্ধি হয় প্রায় শতাংশ। গত অর্থবছরে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য সাড়ে ৮৫ টাকা ধরা হলেও বর্তমানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ১০৮ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে টাকার অংকে মাথাপিছু আয় বাড়লেও ডলারের হিসাবে সংকুচিত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনও মনে করছেন, ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় মাথাপিছু আয় কমবে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টাকাকে অতিমূল্যায়িত দেখানো হয়েছিল। কারণে অল্প সময়ের ব্যবধানে টাকার ২৫ শতাংশেরও বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশের জনসংখ্যাও বেড়েছে। কারণে চলতি অর্থবছরে ডলারের হিসাবে মাথাপিছু আয় কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশে প্রকৃত জিডিপি হিসাবায়ন করায় এর আকার কমার সম্ভাবনা নেই।

তিনি বলেন, বিলাস পণ্যসামগ্রী আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কারণে দেশে গাড়ি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, ফার্নিচারসহ বিলাসপণ্য উৎপাদন বাড়বে। উৎপাদন বাড়লে তার ইতিবাচক প্রভাব জিডিপিতে যুক্ত হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন