অভিমত

চা শ্রমিকের যৌক্তিক মজুরির প্রশ্ন

আবু তাহের খান

চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ বিষয়ে শ্রম অধিদপ্তর, চা বাগান মালিক সংশ্লিষ্ট শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যকার দ্বিতীয় দফা বৈঠক গত ১৮ আগস্ট কোনো সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয়েছে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে ধারণা করা চলে, রাষ্ট্র যেহেতু বরাবর মালিক পক্ষের স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করে এবং এবারও যেহেতু এর কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়নি এবং মালিক রাষ্ট্র পক্ষ দুয়ের কেউই যেহেতু শ্রমিক স্বার্থের কথা ভাবেন না, সেহেতু আলোচনাও একপর্যায়ে মালিকের স্বার্থরক্ষাপূর্বক চাপিয়ে দেয়া সমঝোতার ভিত্তিতেই শেষ হবে। শেষ পর্যন্ত যদি সত্যি সত্যি তাই ঘটে তাহলে এটি শুধু ওই শ্রমিকদের জন্যই একটি বেদনাদায়ক ঘটনা হবে না, একই সঙ্গে তা হবে সব নাগরিকের প্রতি সমআচরণ নিশ্চিত করা সংক্রান্ত সংবিধানের অঙ্গীকার লঙ্ঘনের ধারায় আরো একটি নতুন সংযোজন।

বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের বর্তমান দৈনিক মজুরির পরিমাণ ১২০ টাকা, যা ৩০০ টাকায় উন্নীত করার জন্য বহুদিন থেকেই তারা দাবি জানিয়ে আসছিল। ব্যাপারে প্রথমে তারা মালিক পক্ষ অর্থাৎ বাংলাদেশ চা সংসদের কাছে সাতদিনের সময় বেঁধে দিয়ে গত আগস্ট একটি স্মারকলিপি পেশ করে। কিন্তু তাতে কোনোরূপ সাড়া না মেলায় গত আগস্ট থেকে তারা প্রতিদিন ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করে। কিন্তু তাতেও কোনো ফল না পেয়ে ১৪ আগস্ট থেকে তারা পূর্ণ কর্মবিরতিতে নামে, যা বর্তমানে আমরা দেখছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চা শ্রমিকরা যে মজুরি দাবি করছে তা যৌক্তিক কিনা এবং যৌক্তিক হয়ে থাকলে তা মানতে চা বাগান মালিকদের এত গড়িমসি কেন? আর মালিকরা গড়িমসি করলে তাদের তা মানতে বাধ্য করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই? অবশ্যই আছে।

কিন্তু উল্লেখিত সে দায় পালন তো দূরের কথা, উল্টো তারা বেসরকারি মালিকদেরই পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। প্রমাণ বাংলাদেশ চা বোর্ডের (বিটিবি) আওতাধীন সরকারি চা বাগানগুলোয় তারা বেসরকারি বাগানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমরূপ নিম্ন হারে মজুরি দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারি চা বাগানগুলো ইচ্ছা করলেই তাদের শ্রমিকদের উচ্চতর হারে মজুরি দিয়ে যেতে পারত। কারণ শ্রম অধিদপ্তরের গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে চা শ্রমিকের মজুরির নিম্নসীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে মাত্র, সেটিকে বাড়িয়ে নির্ধারণে কোনোরূপ বাধা আরোপ করা হয়নি। তাহলে বেসরকারি মালিকদের শোষণমূলক মজুরি হার রাষ্ট্রীয় বাগানগুলোকেও মেনে চলতে হবে কেন? আর এখন যখন নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে দর কষাকষি চলছে, তখন বিটিবি কেন বলছে না, তারা তাদের বাগানে শ্রমিকদের দাবির সঙ্গে আংশিক সংগতি রেখে হলেও উচ্চতর হারে মজুরি নির্ধারণ করবে? আরো করুণ ট্র্যাজেডি হলো, সরকারের মজুরি বোর্ডও চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির পরিমাণ নির্ধারণ করে বেসরকারি বাগান মালিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকে তাকিয়ে।

এখন আসা যাক মজুরির ন্যূনতম পরিমাণ নির্ধারণে ন্যায্যতা প্রসঙ্গে। ন্যূনতম মজুরি বোর্ড বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের জন্য মজুরির যে পরিমাণ নির্ধারণ করে আসছে, অতীতের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে বরাবরই সবচেয়ে নিচে থেকেছে চা শ্রমিকদের মজুরি। কারণ একটাই, ঐতিহাসিক কাল ধরে শ্রমিকরা রাষ্ট্রীয় সমর্থনে শোষণ বঞ্চনার যে নির্মম শিকারে পরিণত হয়ে আসছেন, বর্তমান রাষ্ট্র কর্তৃক সে ধারাবাহিকতাই রক্ষা করে চলা। শোষণের সূত্রপাত উনিশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। স্বল্প মজুরি আনুষঙ্গিক স্বল্প সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে স্বল্প উৎপাদন ব্যয়ের চা অতি উচ্চমুনাফায় ইউরোপের বাজারে বাজারজাতের আকাঙ্ক্ষা নিয়েই বস্তুত চা বাগানগুলোর যাত্রা, যে উচ্চ মুনাফার ধারা বর্তমান মালিকরাও সমহারে বহাল রাখতে চান কোনো মুনাফাও বিসর্জন না দিয়ে। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক আমলের শোষণবৃত্তির ধারায় যে হারে যে হিসাব অনুযায়ী শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হতো, এখনকার মজুরি বোর্ড বা শ্রম অধিদপ্তর বা শ্রম মন্ত্রণালয়ও সে বিবেচনা থেকেই চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে আসছে বা বর্তমানের ধর্মঘট পরিস্থিরিতেও তারা সেটাই করতে চাইছে।

এরূপ পরিস্থিতিতে চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কত নির্ধারণ করা হবে, তা যতটা না সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনধারণের স্তর (সাবসিসস্টেন্স লেভেল) আনুষঙ্গিক যুক্তি পর্যালোচনার ওপর নির্ভরশীল, তার চেয়ে তা অনেক বেশি নির্ভর করছে এক্ষেত্রের সিদ্ধান্তপ্রণেতারা ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি মানসিকতা থেকে কতটা বেরিয়ে আসতে পারবেন, তার ওপর। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কত গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করছেন এবং একে অন্যের ত্রুটি অন্বেষণে প্রাণপাত করছেন। কিন্তু গত ৫০ বছরে তাদের কাউকেই কিন্তু কোনো দিন চা শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টিকে ঔপনিবেশিক শোষণের ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশের সংবিধানের আলোকে যৌক্তিক হারে নির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি, বরং তারা সবাই (যে যখন ক্ষমতায় ছিলেন) চা বাগানের মালিকদের পক্ষাবলম্বন করেছেন। কারণটি বোধগম্য। নিরীহ অসহায় চা শ্রমিকের ভোট বাক্সে না পড়লেও চলে। কিন্তু বাগান মালিকের কাছ থেকে নির্বাচনকালে চাঁদা পাওয়াটা খুবই জরুরি।

উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দুই চা উৎপাদনকারী দেশ ভারত শ্রীলংকায় চা শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি হচ্ছে যথাক্রমে ২৮০ টাকা ৬২০ টাকা (শহরাঞ্চলে ৬৮০ টাকা) বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ভারতের চেয়েও বেশি। সেদিক থেকে বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি তাদের দাবি করা ৩০০ টাকা না হোক, অন্তত ভারতের সমান অর্থাৎ ২৮০ টাকা হওয়া উচিত বলে মনে করি। আর চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের আলোচনায় মালিকদের পক্ষ থেকে তাদের বাসস্থান রেশন প্রদানের যে কথা বলা হয়, সেটি প্রকারান্তরে মালিকদেরই স্বার্থ রক্ষা করে। তাদেরকে ওই দুটি সুবিধা না দিয়ে যদি সমমূল্যের নগদ অর্থ দেয়া হতো, তাহলে মালিকদের ব্যয় আরো বেড়ে যেত। অন্যদিকে বাগানের ভেতরেই থাকা রেশনের ব্যবস্থা করে দিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে তারা (মালিকরা) অনেক বেশি নির্বিঘ্ন নিরবচ্ছিন্ন সময় এবং নিবিষ্ট কর্মমনোযোগ পাচ্ছেন, যা প্রকারান্তরে চা চাষ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সার্বিক উৎপাদনশীলতাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এটি এখন স্বীকৃত বাস্তবতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা নানা কারণে দেশের অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপের মধ্যে। অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়ানোটা খুবই জরুরি, যার জন্য প্রয়োজন রফতানি বৃদ্ধি করা। চা শিল্পে ধর্মঘট চলতে থাকলে চা রফতানি বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। অবস্থায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গঠনমূলক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি ন্যায্য মজুরি স্তর নির্ধারণপূর্বক অবিলম্বে ধর্মঘটের অবসান হওয়া উচিত। আশা করি সংশ্লিষ্ট পক্ষ বিশেষ করে মালিক পক্ষ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবেন, তাতে তাদের মুনাফায় খানিকটা টান পড়লেও।

বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের নাগরিকদের সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্ত করে সবার জন্য সমতাপূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধানের অঙ্গীকার করেছে (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০), যে অঙ্গীকারের আওতায় চা শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মানবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করার বিষয়টিও পড়ে বৈকি। মালিকের মুনাফার কাছে সংবিধানের অঙ্গীকার একেবারেই মূল্যহীন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত নীতিনির্ধারক জনপ্রতিনিধিদের কাছেও কি এর কোনো মূল্য নেই?

 

আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক

বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন