আপনি কী রূপকথায় বিশ্বাস করেন? যদি করেন তাহলে বর্তমানে আর্থিক বিনিয়োগকারী হিসেবে আপনি বেশ মোটা অংকের অর্থ আয় করতে পারবেন কিংবা একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে সম্মান ও ক্ষমতা দুটিই অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
গত ৪০ বছরের তুলনায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোজোনের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি গ্রীষ্মের শেষে সেখানে মূল্যস্ফীতির হার দুই অংকের ঘরে পৌঁছতে পারে। এ অবস্থায় আর্থিক বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে যদিও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে কেননা তারা আশা করছে, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চারদিকে পণ্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা ক্রিসমাস নাগাদ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। একই সঙ্গে আগামী বসন্তের মধ্যে সুদের হারও কমতে শুরু করবে। আর তাই যদি হয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতি খুব দ্রুত একটি শোভন আর্থিক অবস্থানে উন্নীত হবে, যেমনটা গোল্ডিলক্সের রূপকথায় দেখা যায়। যে ধারণাটি গত এক দশক ধরে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে, কারণ এখানে খুব বেশি উত্থান কিংবা পতনের ঝুঁকি নেই, বরং বিনিয়োগ সবসময়ই লাভজনক।
বিনিয়োগকারীরা কতটা আশাবাদী তা দেখা যায় সম্প্রতি তিনটি খুব ঘনিষ্ঠ মার্কেট বিটে ট্রিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থ বাজি ধরার বিষয়টির মাধ্যমে। আর্থিক বাজারগুলো পূর্বাভাস প্রদান করছে যে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি নাগাদ আমেরিকায় সুদের হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি উঠবে না, এরপর এপ্রিল থেকে তা কমতে শুরু করবে এবং ২০২৪ সালের শুরুতে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। আমেরিকায় ৯ দশমিক ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বন্ড মার্কেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, আশা করা হচ্ছে, এর ফলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ২ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এদিকে শেয়ার বাজারের পক্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির গতির সাময়িক মন্থরতা আমেরিকান করপোরেট মুনাফার পরিমাণকে চলতি বছরের রেকর্ড মাত্রা থেকে ২০২৩ সাল নাগাদ ৯ শতাংশ বৃদ্ধি করবে।
বিনিয়োগকারীদের তুলনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বেশি চিন্তিত, কিন্তু তারা আবার তাদের অর্থনৈতিক মডেলগুলোর মাধ্যমে আশ্বস্ত হচ্ছে। যদিও এ মডেলগুলো ‘যুক্তিযুক্ত প্রত্যাশা অনুমান’ মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, বলা যায় এর উন্নত সংস্করণ। তবে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় মডেলটি কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। তবে এ মডেলগুলোর মাধ্যমে ধারণা করা হয়, কম মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা করাটা মূলত মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মূল চাবিকাঠি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা তাই, ‘অনুমিত’ মূল্যস্ফীতিকে একটি জুতসই প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করেন ও মনে করেন যে, তাদের নীতিগুলোয় তো ভালোমতো কাজ করছেই।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক বাজারগুলো যখন পরস্পরকে অনুসরণ করে, তখন দুই পক্ষেরই পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেননা এটি শুধুই আংশিকভাবে ঝুঁকির বিপরীতে আর্থিক বাজারের পক্ষে বাজি ধরার ইচ্ছাকে ব্যাখ্যা করে—ল্যারি সামারস, মোহাম্মাদ এল-এরিয়েন, জিম ও’নিল এবং নুরুয়েল রুবিনি সত্তরের দশকের মূল্যস্ফীতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমনটাই বলেছেন।
আর্থিক বাজারের সম্ভাবনা সম্পর্কে এক দশকের অতি আশাবাদের পর আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেছি। শত শত পেশাদার বিনিয়োগকারীর সঙ্গে এ সম্পর্কিত আলোচনা চালাতে গত তিন মাস ধরে আমি বিশ্বজুড়ে ছুটে বেড়িয়েছি। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমি নিশ্চিত হয়েছি, আজকের বিনিয়োগকারীরা চারটি কৌশল অথবা ন্যূনতম কগনেটিভ বায়াসের ওপর নির্ভর করেন। কগনেটিভ বায়াস অর্থাৎ যে ভ্রান্তিগুলো মানুষের সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব রাখে।
প্রথম কগনেটিভ বায়াস হলো ভূ-রাজনীতিকে খাটো করে দেখা ও অস্বীকার করা। নেপোলিয়ন যুদ্ধের সময়ে নাথান রথচাইল্ড তার কাজের পরিপ্রেক্ষিতে যেমনটা বলেছিলেন, কোনো কিছু বিক্রয়ের সময় কামানের শব্দের মতো জোরালো আওয়াজ তুলে বিক্রি করুন, আর ক্রয়ের সময় ঠিক তার বিপরীত পদ্ধতি অনুসরণ করুন—অর্থাৎ যতটা সম্ভব কম শোরগোল করুন। যুদ্ধের কারণে সম্পদ বিক্রি করতে আসা ভীতসন্ত্রস্ত খুচরো বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে লেনদেন নিয়ে পেশাদার বিনিয়োগকারীরাও তাই রীতিমতো অহংকার করেন।
এ ধরনের কৌশলগুলো প্রায়ই সঠিক বলে প্রমাণিত, যদিও অনেক ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়া ও ইজিপ্টের নেতৃত্বে আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে এমন রূপান্তর ঘটিয়েছে, যা মূলত চরম আত্মবিশ্বাসী বিনিয়োগকারী একটি প্রজন্মকে শেষ করে দিয়েছে। তাদের ওই পরিণতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, তারা মূলত বিষয়গুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি; যদিও একটি শক্তিশালী অভিঘাত, দীর্ঘ সময় ধরে আর্থিক ও রাজস্ব সম্প্রসারণের পর মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, একই সঙ্গে উচ্চমূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি ও গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের উৎপাদক রাশিয়াকে বিশ্ববাজারের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের সরবরাহ সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যা ১৯৭৩-৭৪ সালের আরব তেল নিষেধাজ্ঞার মতোই গুরুতর এবং বছরের পর বছর ধরে চলবে। দামের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য তাই পণ্য সরবরাহ অনুসারে দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা সংকোচনের প্রয়োজন। যার অর্থ শীর্ষ ৩ দশমিক ৪ শতাংশের পরিবর্তে সুদের হার ৫, ৬ কিংবা ৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা, যেমনটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীরাও অনুমান করছেন। যদিও বিনিয়োগকারীরা মার্কিন মুদ্রানীতিতে ছোটখাটো সমন্বয় ও ভূরাজনৈতিক উত্থানকে কমিয়ে আনার দিকেও দৃষ্টি দিচ্ছেন।
এটি মূলত দ্বিতীয় কগনেটিভ বায়াসকে প্রতিফলিত করে এবং ‘প্রবণতাই আপনার বন্ধু’ এ ধরনের সংক্ষিপ্ত বিনিয়োগ প্রবাদকে তুলে ধরে। যার মানে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব বা সুদের হারের মতো বাজারের চলমান অর্থনৈতিক সূচকগুলোর পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিনিয়োগকারী তাই বিশ্বাস করেন, আর্থিক অবস্থা খুবই আঁটসাঁট হয়ে উঠেছে কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশের পরিবর্তে সুদের হার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়িয়েছে, যদিও সুদের এ হার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম।
একইভাবে ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতিতে বিনিয়োগকারীরা খানিকটা উদ্বিগ্ন। কারণ তারা অনুমান করছে ডিসেম্বর নাগাদ এটি হয়তো মাত্র ৭ শতাংশে নেমে আসতে পারে। কিন্তু বাস্তব অর্থনীতিতে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা দেখবে যে কয়েক দশকের মধ্যে দ্রুত দাম বাড়ছে, যা ২০২৩ সালের মধ্যে করপোরেট মূল্য নির্ধারণ কৌশলগুলো নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দেবে।
এ ধরনের পরিণতি সম্ভাব্য বলেই মনে হয়—যদি না আর্থিক বিনিয়োগকারীরা তৃতীয় কগনেটিভ বায়াস দ্বারা তাড়িত না হয়; যা হচ্ছে ‘ফেডের সঙ্গে লড়তে যাওয়া যাবে না।’ তাছাড়া বাজারে এ কথাটা প্রচলিত, আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি একবার কোনো লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে, যেমন মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা, সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের সবসময় ধরে নিতে হবে যে ফেড তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো না কোনো উপায় খুঁজে পাবে।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ফেডের প্রস্তুতির বিষয়টিও অর্থপূর্ণ, উদাহরণস্বরূপ বেকারত্ব, শেয়ার বাজার এবং ঋণ-পরিষেবা, খরচের ওপর প্রভাব, মূল্যস্ফীতির হার কমানো ইত্যাদি। কিন্তু ফেড মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেক বেশি মনোযোগী, অন্তত আগের তথ্যগুলো এ বার্তাই দেয়।
আর এটি মূলত আমাদের চূড়ান্ত বায়াসের দিকে ঠেলে দেয়; অর্থাৎ বেশির ভাগ লোকই মনে করে যা তাদের জীবনে ঘটেনি এমন ঘটনা কল্পনা করাটা কঠিন। তাই অনেক বিনিয়োগকারী ও নীতিনির্ধারকদের কাছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিষয়টি কোনো তারতম্যই সৃষ্টি করে না। এ ধরনের বায়াসকে ব্যাখ্যা করা হয়—‘নতুন যুগ বলে কিছু নেই।’
তবে নতুন যুগ আসে। ১৯৭৩ সালের সময়কালে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্ব যেটা উপলব্ধি করেছিল। তাই বর্তমানে রাশিয়া সংকট, কভিড-১৯-এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক সম্প্রসারণ এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যাতে মনে হয় আগামী দিনগুলো গত ৪০ বছর থেকে আলাদাই হবে। যদিও আর্থিক বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে একটি নতুন উদ্বেগমুক্ত যুগের প্রত্যাশা করছে। তাদের অনুমান যদি সঠিক হয়, তাহলে আমরা সবাই সুখে থাকতে পারব।
[স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]
আনাতোল কালেস্কি: প্রধান অর্থনীতিবিদ ও
কো-চেয়ারম্যান, গাভেকাল ড্রাগোনমিকস
ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস