আলোকপাত

বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে কিছু ভাবনা

ডায়ান কোয়েল

আন্তঃদেশীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার শুরুটা গত শতকের আশির দশকে। তখন থেকে প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে সহায়তা করেছে। কমিয়েছে পণ্যের দাম। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রেখেছে তাত্পর্যজনক অবদান। কিন্তু কভিড মহামারী ইউক্রেন যুদ্ধসৃষ্ট অভিঘাত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দেখিয়েছে বৈশ্বিক শ্রম বিভাজন জাস্ট ইন টাইম প্রডাকশন প্রভাবিত দক্ষতার সুফল এসেছে স্থায়িত্বশীলতার বিনিময়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চলমান বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার বাধাগুলো সহসা নিরসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। স্বভাবত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাই উৎপাদন প্রক্রিয়া নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা (রিশোরিং) কিংবা প্রতিবেশী কোনো দেশে নিয়ে যাওয়ার (ফ্রেন্ড-শোরিং) বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে। সেক্ষেত্রে ভৌগোলিক নৈকট্যের সঙ্গে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুঁজছে তারা।

তবে এক প্রজন্ম আগের স্বল্পমেয়াদি এবং অধিক জাতীয় (কিংবা আঞ্চলিক) সরবরাহ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বেশ ব্যয়বহুল হবে। কতটা ব্যয়বহুল তার ইঙ্গিত পাওয়ার জন্য ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেনের সাম্প্রতিক বাণিজ্য পুনরুদ্ধারে ঘাটতির বিষয়টিই যথেষ্ট। যুক্তরাজ্যের বাজেটবিষয়ক কার্যালয়ের হিসাব বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে গভীর বাণিজ্য সংযুক্তি থেকে লব্ধ উৎপাদনশীলতার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদে এখন দেশটির উৎপাদনশীলতা কমবে শতাংশ। বিশ্বায়নসৃষ্ট বিশেষায়ণ বহুমাত্রিক সুফল এনেছে, যেমনটা আমিসহ অনেক অর্থনীতিবিদই দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছি। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, যার মধ্যে অন্যতম।

সন্দেহ নেই, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্নভাবে সরবরাহ ব্যবস্থার অভিঘাত প্রশমন করবে। কিছু প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কার্যক্রম নিজ দেশে ফিরিয়ে আনবে। কিছু প্রতিষ্ঠান নানা জায়গায় সাব-কন্ট্রাক্টর খুঁজবে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান অটোমেশন বাড়ানোর পথ বেছে নিতে পারে। উৎপাদন নিজ দেশে স্থানান্তরের চেয়ে শেষোক্ত দুটি কৌশলে উৎপাদনশীলতা তুলনামূলক কম হবে। উপরন্তু, তার সঙ্গে যুক্ত হবে অভিযোজন ব্যয় এবং নতুন বিনিয়োগের মতো বাড়তি খরচ। গত চার দশকের বিশ্বায়ন অবশ্য কিছুটা হোঁচট খাবে ওই তিন কৌশলে।

বছরের পর বছর আউটসোর্স করা কর্মকাণ্ডের পরিধি প্রকৃতি বিবেচনায় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্য এসব পদক্ষেপের কোনোটিই নিতে পারবে না। কিছু খাত যেমন ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিক্যাল খাতে আউটসোর্স করা উৎপাদন মোট উৎপাদনের ১৫-২০ শতাংশ- এটা উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য অংশ বলা চলে। সুতরাং তাদের পক্ষে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো নেয়া অনেক কঠিন হবে। 

একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার, ১৯৮০ দশকের পর কোম্পানিগুলোর মধ্যে পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ অভ্যন্তরে তৈরির চেয়ে বাইরে থেকে কেনার প্রতি একটা তাত্পর্যজনক স্থানান্তর লক্ষ করা গিয়েছিল। এটা হয়েছিল মূলত তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্তারের কারণে, যে প্রযুক্তিগুলো নির্দেশনা পাঠানো তাত্ক্ষণিকভাবে সাড়া পাওয়ার ( ফিডব্যাক) বিষয়টি সম্ভব করে তুলেছিল। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোয় এমন এক ব্যবস্থাপনা দর্শনের সম্মিলন ঘটানো হয়েছিল, যা ব্যয় দক্ষতা লিন প্রডাকশনে (উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে শূন্য বর্জ্যের প্রক্রিয়া) জোর দেয়। অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সদর দপ্তর যে দেশে অবস্থিত, সেখানে গবেষণা উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) কিংবা ডিজাইনের মতো উচ্চমূল্যের কর্মকাণ্ড বজায় রেখেছিল আর মালয়েশিয়া চীনের মতো সাশ্রয়ী অবস্থানের কারখানাগুলোয় পাঠিয়েছিল ফর্মুলা বা ব্লুপ্রিন্ট। প্রাথমিকভাবে অর্জিত অভিজ্ঞতার একটা সময়ের পর দূরবর্তী এসব কারখানা নিজ দেশের চেয়ে অনেক কম মূল্য এবং অধিক সংগতিপূর্ণ মানে পণ্য উৎপাদনে সমর্থ হয়েছিল। 

সময়ান্তরে ধরনটি অবশ্য আরেকটা সুপ্ত ব্যয় সৃষ্টি করেছিল। সেটি হলো উৎপাদন খাতের লব্ধ পরোক্ষ জ্ঞান বা কৌশলের ক্ষতি। অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত এটা এমন এক শিক্ষা, যা কখনো লিখিত থাকে না কিন্তু প্রতিটি প্রডাকশন লাইনে অন্তহীনভাবে ঘটে চলে। ধরনের অন্তর্দৃষ্টি-শিক্ষা গবেষক প্রকৌশলীদের গুরুত্বপূর্ণ ফিডব্যাক দিতে পারে বটে, কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরের কোনো স্থানে চলা উৎপাদন কার্যক্রমে ওই ফিডব্যাক অনেকটা হারিয়ে যায়।  

ধনী দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো দশকের পর দশক এসব সক্ষমতা-সামর্থ্য নিঃশেষ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে এবং দ্রুতই সেগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা তেমন করেনি। তাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো উপকৃত হয়েছে। চীন, মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উৎপাদন কেন্দ্রগুলো সুনির্দিষ্ট কিছু খাত এবং লজিস্টিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে টেকসই নকল করতে কঠিন এমন আপেক্ষিক সুবিধার উন্নয়ন ঘটিয়েছে।

এটা নীতিনির্ধারকদেরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। খাদ্য মাইক্রোচিপের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর সরবরাহ নিশ্চিত করা এখন বেশির ভাগ দেশের এজেন্ডার শীর্ষে রয়েছে। কয়েকটি প্রাগ্রসর অর্থনীতি তাদের উৎপাদন সক্ষমতা পুনরায় গড়ে তুলতে কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। দু-একটি উদাহরণ দেয়া যাক।  যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৪৫ দশমিক বিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান প্রস্তুত করেছে। ইনসুলিন অন্য জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য ১০০ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব তৈরি করেছে।

চলতি সরবরাহ অভিঘাত মোকাবেলায় এসব পরিকল্পনা ভালো ধারণা হতে পারে কিন্তু সেগুলো সফল করে তুলতে উল্লেখযোগ্য সময় অর্থ প্রয়োজন হবে। কিছু দেশ এরই মধ্যে তেল গ্যাস মজুদ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পনির মাখন মজুদের মতো অনেক দেশ খাদ্য মজুদ করেছে, যদিও সরবরাহ নিশ্চিতের চেয়ে খামার কৃষকদের আয় সমর্থনের জন্যই তারা এটা করেছে (যুক্তরাজ্য অবশ্য গত শতকের নব্বইয়ের দশকে তার কৌশলগত খাদ্য মজুদ অনেকটা বন্ধ করে দিয়েছে)

চলতি সরবরাহ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রতিযোগিতায় সাধারণভাবে অদৃশ্য এক বিষয়ও তুলে ধরেছে। কিছু অর্থনীতিবিদ বর্তমান সরবরাহ ঘাটতির জন্য অনেক বাজারে কেন্দ্রীভবন বাড়ার বিষয় ইঙ্গিত দিলেও সাধারণভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার শেষ প্রান্তে থাকা বড় সুপার স্টার কোম্পানিগুলোর দিকে দৃষ্টিটা বেশি গেছে। কারণ যা- হোক, আজকের ঘাটতি আমাদের একটি বিষয় মনে করিয়ে দেয়। সেটি হলো, সরবরাহ ব্যবস্থায় যত বেশি বিশেষায়িত সংযোগ সৃষ্টি হয়, প্রতিটি স্তরে প্রতিযোগিতা তত কমতে পারে।

অন্তত সাম্প্রতিক সময়ের আগে পর্যন্ত প্রতিযোগিতা নীতি উল্লম্বভাবে একীভূত কোম্পানিগুলোকে নিয়ে খুব কমই মাথা ঘামিয়েছে যতক্ষণ না খুচরা বাজার প্রতিযোগিতামূলক থেকেছে। ধারণা ছিল নিম্ন প্রান্তের চাপ উচ্চ প্রান্তে প্রবাহিত হবে। বড় কোম্পানির বাজারশক্তির বিপুল দৃষ্টান্তের মধ্যে কেউ কেউ ধারণা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলাও শুরু করেছিল। কিন্তু যুক্তরাজ্যের খাদ্য উৎপাদনে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘাটতি (সারের উপজাত) এবং যুক্তরাষ্ট্রে শিশুখাদ্য সরবরাহকারী একটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিপুল প্রভাব একই ধারণা আবারো জোরালোভাবে সামনে এনেছে।

সরবরাহ ব্যবস্থার আজকের নীতি চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক দক্ষতার বাইরে অন্য বিবেচনাগুলো  যে গুরুত্ব বহন করে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা জ্ঞান যে অনলাইনে পুরোপুরি সঞ্চালন করা যায় না, বিষয়টি ভুলে যাওয়ারই পরিণাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, চার দশকে পুঞ্জীভূত হওয়া সমস্যাগুলো রাতারাতি সমাধান করা যাবে না এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য সেগুলো সমাধানের কার্যধারাও খুব একটা পরিষ্কার নয়। কিন্তু উল্লিখিত সব কারণই বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার বিরাজমান মডেলটি পুনর্ভাবনা বদলানোর জন্য যথেষ্ট এবং কাজটি এখনই শুরু করা জরুরি। 

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

ডায়ান কোয়েল: যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসির অধ্যাপক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন