বিশ্লেষণ

বাজেটের প্রকৃত দিকনির্দেশনা কী?

ড. এ কে এনামুল হক

খরচ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা এবং লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা আয় দেখিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন আমাদের অর্থমন্ত্রী। এরই মধ্যে বাজেট নিয়ে আলোচনা কিংবা সমালোচনা অনেক হয়েছে। দুপক্ষের থলেতেই হয়তো যুক্তি রয়েছে। সব পক্ষের যুক্তি কিংবা বিবৃতি শুনে আমার ছাত্রবেলার বিতর্কের কথা মনে পড়ে। সে সময় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিচারকরা আমাদের একটি বিষয় দিয়ে ১০ মিনিট সময় দিতেন। আর বলতেন ১০ মিনিট পর বিতর্ক শুরু হবে। লটারির মাধ্যমে ঠিক হবে কোন দল কোন পক্ষে কথা বলবে। তাই দলের সবাই মিলে দুই দিকের যুক্তিতর্ক আলোচনা করে ফেলো। ১০ মিনিট পর ঠিক হবে তোমার ভাগ্যে কী? পক্ষে না বিপক্ষে? আমরাও দলীয়ভাবে আলোচনা করে ফেলতাম। যদি দেখতাম পক্ষে জোরালো যুক্তি রয়েছে তবে সবাই মিলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম আমাদের ভাগ্যে যেন তা- হয়। আর যদি তা না হয় তবেও মনে মনে ঠিক করতাম কী বলতে হবে। বাজেট পরবর্তী আলোচনা আমার কাছে ঠিক তেমনি।

বাজেট ঘোষণার দিন বিমানে ছিলাম। তাই অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা বা বাজেট বক্তৃতা শুনতে পাইনি। পরদিন দেশে পৌঁছে তার সংবাদ সম্মেলন আধো ঘুম-আধো জেগে শুনেছি, কারণ জট লেগে ছিল। শুনছিলাম, কারণ বিদেশে থাকতেই বণিক বার্তার পক্ষে একটি লেখা চাওয়া হয়েছিল। অনেক দিন লিখিনি। তাই পরিচিত অনেকেই আশা করছিলেন যেন আবার লিখি। কেন লিখিনি তার কারণ আমার কাছেও খুব স্পষ্ট নয়। লেখার পক্ষে নিজস্ব চিন্তা না থাকলে আমার কলমে কিংবা বলা যেতে পারে আমার কিবোর্ডে কেন জানি লেখা আসে না। তবে কিছুটা ব্যস্তও ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় একটি নতুন দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে, তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হয়েছে এবং যোগ হয়েছে দিনে - ঘণ্টার যানজট। ফলে হাতে সময় হচ্ছিল না। কৈফিয়ত দেয়ার দরকার ছিল না, তবে ভাবলাম অনেকেই যেহেতু লেখা আশা করেন তাই দিলাম। বাজেট নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছা আমার নেই, তবে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে বাজেটের কয়েকটি দিকের আলোচনাই আমার লক্ষ্য।

বলা বাহুল্য, বাজেটের আকার প্রতি বছর বাড়বে। অতএব, বিষয়ে কোনো তর্কের অবকাশ নেই। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করলে সরকারের দায় দায়িত্ব বাড়বেই। তাই খরচ বাড়বেই। এটাই স্বাভাবিক। বাজেটের আয় নিয়েও প্রায় একই কথা সত্য। প্রতি বছর আয়ের পরিমাণও বাড়বে। তবে আমাদের মতো দেশে যেখানে মাত্র ২৭ লাখ লোক কর দেয় সেখানে আয়-ব্যয়ের অসামঞ্জস্য লেগেই থাকবে। এটাও নিয়ম। যত দিন আমরা করদাতা শনাক্ত করতে না পারব তত দিন এর কোনো পরিবর্তন হবে না। সেই সঙ্গে বাজেটের ঘাটতি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মতো অতিমাত্রায় ভীত হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। কারণ পশ্চিমাদের বাজেট ঘাটতির মূল কারণ বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় কিংবা দৈনন্দিন খরচ বৃদ্ধি পাওয়া। তাদের খরচ বাড়ে ভর্তুকি দিয়ে, যুদ্ধে জড়িয়ে কিংবা অন্য কোনো দেশের স্বাধীনতা সংরক্ষণের যুক্তিতে। তাদের দেশে আমাদের মতো উন্নয়ন বাজেট বা অবকাঠামোয় বিনিয়োগ হয় না। বিনিয়োগ মানেই হচ্ছে আগামীর জন্য খরচ। তাই সব খরচের দায় কেবল এক প্রজন্মের ওপর বর্তায় না। অর্থাৎ কর দিয়ে সব অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে হবে এমন যুক্তি অবান্তর। একটি সড়ক কিংবা ব্রিজ তৈরি করলে তার ফল ভোগ করে কয়েকটি প্রজন্ম। তাই আজকের প্রজন্মই কেন সব খরচের দায় বহন করবে? আর সেই কারণেই করা হয় ঋণ, যাতে আগামী প্রজন্মও তার দায় বহন করে। তাদের হাতে থাকে একটি সম্পদসড়ক, ব্রিজ ইত্যাদি। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে সরকারের রকম বিনিয়োগের দায় নেই। নেই নতুন রাস্তা কিংবা ব্রিজ বানানোর প্রয়োজন। তাই সেখানে ঘাটতি বাজেটের জন্য ঋণ গ্রহণ অন্যায়। এক প্রজন্মের আবেগের কারণে পরবর্তী প্রজন্মগুলো তার দায় বহন করবে। তাদের হাতে থাকে না কোনো সম্পদ। যেমন আফগানিস্তান-ইরাকে যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে ঋণ করে। অথচ আগামী প্রজন্মকে তার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। শুধু তা- নয়, যুদ্ধাহতদের জন্য অন্তত আরো ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। সব দায় বহন করতে হবে আগামী প্রজন্মকেই। এখানেই পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের ঘাটতি বাজেটে যত আপত্তি। আমাদের ক্ষেত্রে তা নয়। আমাদের বাজেটে ঘাটতি থাকবেই। কারণ আমাদের অবকাঠামো অপ্রতুল। আমরা ঋণ নিয়েই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তৈরি করব সম্পদ। আমি জানি অনেকেই ভাবছেনতবে শ্রীলংকার অবস্থা এমন হলো কেন? বিষয়টি উঠিয়ে রাখলাম আগামী কোনো একটি লেখার জন্য।

তাহলে বোঝা গেল, ঘাটতি বাজেট বিতর্কের বিষয় নয়। তেমনি বাজেটের আকার অর্থাৎ আয়-ব্যয়ের বহরকে কেউ যদি ঐতিহাসিক বলে মনে করেন তাও হবে অবান্তর কথা। কারণ এটিই হবে। আমাদের বাজেটের আয়-ব্যয়ের পার্থক্য থাকবেই। কারণ দুটিএক. সরকার করদাতা খুঁজে পাচ্ছে না এবং দুই. সরকার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য খরচ করছে। এর বাইরে একটি আলোচনা সর্বত্রই রয়েছে তা হলো সরকারের অপচয় কিংবা দুর্নীতি। দুর্নীতির মাধ্যমে সরকার খরচ বাড়িয়ে ফেললে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তার দায়ও বহন করতে হবে। অতএব, বিষয়ে সব অর্থনীতিবিদ সোচ্চার থাকেন। অবস্থা অনেকটা উন্নত দেশের যুদ্ধের খরচের মতো, যার দায় তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বহন করতে হচ্ছে।

একই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, কোনো সরকারই তার বাজেটে জেনেশুনে এমন কোনো বিষয়ের অবতারণাই করবে না যেখানে সমাজের ক্ষতি হয়। কারণ তাতে সরকারই শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাবে না। কেউই বলতে পারবেন না যে, অর্থমন্ত্রীরা ইচ্ছা করে তার সরকারকে বিপদে ফেলতে বাজেট তৈরি করেছেন। তাই বলতে পারেন বাজেটে আর কী আশা করতে পারি? আমাদের দেশে বিপত্তি এখানেই। বাজেট সরকারের ভাবমূর্তির বিষয় নয় বরং বাজেট সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়। সরকার কী করতে চান? কী দিতে চান দেশকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে? তার একটি দলিল বাজেট। কেন যেন আমরা সেখানেই সব গুলিয়ে ফেলছি। আলোচনার জন্য আমি দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলব। একটি হলো বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়। অন্যটি সরকারের সর্বজনীন পেনশন স্কিম।

বিদেশে থেকে যাওয়া বনাম বিদেশে পাচার করা অর্থ

আগেই বলেছি বাজেটে অর্থমন্ত্রী দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন। তার দিকনির্দেশনায় থাকবে পাণ্ডিত্য, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি সরকারের সাফল্য লাভের দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের দেশ হতে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়। তা অর্থমন্ত্রী অকপটে স্বীকার করেছেন বলে আমি তাকে ধন্যবাদ দিই। এর আগে বিভিন্ন সংস্থা এমন সংবাদ প্রকাশ করেছে। অর্থ পাচার সব সরকারের আমলেই হয়েছে। কী কারণে তা হয় সে বিষয়ে আলোকপাত না করে বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে প্রণোদনার মাধ্যমে ফেরত আসবে বলে যদি কেউ মনে করেন তবে তিনি বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। পাচার করা অর্থ বিদেশে কেন যায়? কেউ বলেন দুর্নীতির কারণে যায়। তাহলে কি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদরা সম্পদ লোপাট করার তথ্য দেশে টাকা ফেরত এনে প্রকাশ করবেন? এমনটা কি কেউ আশা করেন? অসম্ভব। যিনি দেশ হতে টাকা লুট করেছেন, তিনি দেশে টাকা ফিরিয়ে আনবেন এবং ধরা দেবেন জনগণের কাছেএমন বোকা পৃথিবীতে দুটি নেই। অতএব, প্রণোদনার লক্ষ্য দুর্নীতিবাজ কেউ হবেন না।

পাচার করা অর্থ বিদেশে যাওয়ার আরো একটি কারণ রয়েছে। তা হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য। অনেকেই তার টাকা বিদেশে রাখেন, কারণ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার শঙ্কা রয়েছে। তিনি ভাবেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাকা বিদেশে নেয়াই ভালো। কেউ সম্পত্তি বিক্রয় করেও টাকা বিদেশে নিয়ে যান। যাওয়ার সহজ-সরল রাস্তা না থাকায় তারা হুন্ডি কিংবা অন্য পন্থায় টাকা নিয়ে যান। তারা কি দেশে টাকা ফিরিয়ে আনবেন? টাকা কালো টাকা নয়। অর্থমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে তাই- বলেছেন। সব পাচার করা টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ নয়। রকম অর্থের পরিমাণও কম নয়। দেশের বিত্তশালী অনেকেই টাকা সরিয়ে নিয়েছেন বিদেশে। কারণ তারা এখানে টাকা রাখার জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। অতএব, তারা কি সেই টাকা ফিরিয়ে আনবেন? তাদের কি দেশের প্রতি আস্থা এসেছে? ঘটনাটি এখানে শেষ নয়। আপনি কোথায় টাকা আনবেন? স্টক মার্কেট দালালদের খপ্পরে। এখানে বিনিয়োগ মানে অর্থের শ্রাদ্ধ করা। ব্যাংকে রাখবেন? ব্যাংকের টাকার পরিমাণের ওপর কর বেড়েছে। অর্থমন্ত্রীর কথায়, সব পাচার করা অর্থ দুর্নীতির অর্থ না হলেও কে তার অর্থ দেশে এনে নতুন করারোপের সম্ভাবনা বাড়াবে? এত বোকা কেউ হয়? মানুষ কর দেয়ার পর যে সঞ্চয় করে তার ওপর যদি কর বসানো হয় তবে তার অর্থ কি এই নয় যে, একজনের ওপর কয়েকবার কর বসানো হলো? একই ভাবে শুধু ব্যাংক হিসাব নয়, সম্পদের ওপরও কর রয়েছে। বিদেশ থেকে টাকা এনে তিনি কি নতুন করের বোঝা বইবেন? আগেও বলেছি, আবারো বলছি বিদেশের টাকা দেশে স্বেচ্ছায় আনতে হলে প্রয়োজন পরিবেশ তৈরি। ব্যাংকের লেনদেন কিংবা সম্পদের ওপর কর আরোপের যে প্রবণতা আমাদের দেশে রয়েছে তাতে কেউ তার টাকা দেশে স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে আনবেন না। তবে অর্থমন্ত্রীর উদ্যোগকে সফল করতে হলে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা করনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

বিদেশে সম্পদ রাখার তৃতীয় কারণ হলো, যারা দেশে বসে বিদেশী টাকায় আয় করেন। এক অর্থে, তারা বিদেশেই কাজ করেন তবে থাকেন দেশে। কভিড-পরবর্তী বিশ্বে তারা সরকারের বৈদেশিক অর্থ সংগ্রহের একটি বড় শক্তি। তাদেরকে যদি প্রণোদনা দিতেই হয় তবে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে আমরা যেমন কোনো করারোপ করি না তেমনি তাদের আয়কেও একই ভাবে দেখা উচিত। তাতে বাংলাদেশের বহু লোক তাদের পেশাগত দক্ষতা দিয়ে দেশে বসে বিদেশী মুদ্রায় আয় করতে পারবেন। আগামী এক দশক পর্যন্ত তাদের আয়কে করমুক্ত ঘোষণা করলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের একটি তৃতীয় পথ উন্মোচন হবে। অর্থমন্ত্রীর উচিত তাদেরকেই লক্ষ্য করে নীতিমালা প্রণয়ন করা। পাচার করা অর্থ ফেরত আনা নয়। বিদেশে চলে যাওয়া, বিদেশে থেকে যাওয়া আর বিদেশে পাচার করা অর্থ এক নয়। সরকারের উচিত বিষয়ে ভেবেচিন্তে দিকনির্দেশনামূলক নীতিমালা প্রণয়ন করা। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য করে নীতিমালা তৈরি অগ্রহণযোগ্য। তবে অর্থমন্ত্রী যেহেতু স্বীকার করেছেন যে, দেশ হতে অর্থ পাচার হয় তাই তা রোধেও সরকারের উচিত নতুন কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করা।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম

বিষয়টি আমার প্রাণের বিষয়। গত ২০ বছরের অধিক সময় ধরে বিষয়ে আমি কথা বলেছি। সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীদের আহ্বান জানিয়েছি। কেউই বিশ্বাস করেননি। অর্থমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তিনি কাজটি হাতে নিয়েছেন। বিষয়টি দেশের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। কারণ দেশের জনগণের গড় আয়ু যেখানে ৭৩ বছর, সেখানে যারা পেনশনে যাবে, তাদের গড় আয়ু ৮৫ বছর। বহু দিন ধরে অংকটি আমি বলে এসেছি। আগামীতে বয়োবৃদ্ধ প্রজন্মের সংখ্যা বাড়বে। পরিবারের আকার ছোট হওয়ায় এবং জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামীতে রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধদের রক্ষা করার জন্যই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ছিল। তদুপরি মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে সামাজিক সুরক্ষা বলয় আর গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা এক নয়। ভাতার আরেক নাম হলো দান। পেনশন দান নয়, পেনশন হলো প্রতিদান। একজন কর্মক্ষম লোক তার কর্মজীবনের আয়ের প্রতিদানে পেনশন গ্রহণ করে। তাই সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ছিল। তবে বিষয়টি এখনো সুস্পষ্ট নয়। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় দেড় যুগ পরও বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব আমাকে ব্যথিত করেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, পেনশনকেও দেখা হচ্ছে দান কিংবা অনুদান হিসেবে। আমি নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রীর ধারণায় ভাতা (যা দান বা অনুদান হিসেবে দেখা হয়) আর পেনশন এক ছিল না। কারণ এর আগে এই প্রধানমন্ত্রীই দেশে বয়স্ক ভাতা চালু করেছিলেন।

পেনশন বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার এখনো যে অভাব রয়েছে, তাতে শেষ পর্যন্ত তা যেন ভাতায় রূপান্তর না হয় সে বিষয়ে অর্থমন্ত্রীকে এখনই আরো স্পষ্টবাদী হওয়া উচিত। এটি সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অর্থমন্ত্রী গত বছর বিষয়টি বিবেচনায় এনেছিলেন। তাই বাজেটে তার একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আশা করেছিলাম।

সরকারের উচিত, পেনশন বিষয়ে সাধারণ কিছু পদক্ষেপ নেয়া। প্রথমত, সব প্রাপ্তবয়স্কের জন্য একটি পেনশন অ্যাকাউন্ট তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, সব উপার্জনকারীকে মাসিক ভিত্তিতে তার আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ তার পেনশন ফান্ডে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা (স্ব-উপার্জনকারীদের জন্য তা হবে স্বেচ্ছায় আর কর্মজীবীদের জন্য তা হবে বাধ্যতামূলকভাবে যা নিয়োগদাতা নিযুক্ত ব্যক্তি জমা দেবেন) জমা করা অর্থ করমুক্ত করা উচিত। তৃতীয়ত, সরকারের সব ঋণ অর্থ হতে সংগৃহীত হবে এবং তার বিনিময়ে সুদসহ তা প্রতি বছর অ্যাকাউন্টে জমা দেবেন। তাতে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণগ্রহণে ব্যাংকনির্ভরতা সঞ্চয়পত্র নির্ভরতা কমে যাবে। চতুর্থত, সরকারের উচিত হবে একটি ন্যূনতম পেনশন ঘোষণা করা। অর্থাৎ যারা কোনো অর্থ জমা দেবেন না তাদের মাসিক অর্থ হবে সরকারের দান বা ভাতা। আর যারা নিয়মিত অর্থ জমা দেবেন তাদেরকে তাদের জমাকৃত মাসিক অর্থের গুণিতক হারে পেনশন স্কিম তৈরি করা। সুস্পষ্ট ঘোষণা ছাড়া বাজেটের পদক্ষেপ অনেকটাই ফাঁকা বুলি। আশা করি, সবাই ভাববেন।

 

.  কে এনামুল হক: অর্থনীতিবিদ  অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন