শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতির কথা শুনছি না

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . আতিউর রহমানের জীবনসংগ্রামের জনশ্রুত এক গল্প। সে গল্পে আতিউর রহমান বিভিন্ন সময়ে তার শিক্ষাজীবনের সংগ্রামের কাহিনী অকপটে বলেছেন। সেগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় মাঠে গাভী আর ছাগল চরাতেন। বিকালে হাটে গিয়ে গাভীর দুধ বিক্রি করতেন। এমন পরিস্থিতিতেও পড়াশোনা ছাড়েননি। গ্রামে বড় হওয়া আতিউর রহমান যখন ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন তখন তার কাছে শহরে যাওয়ার মতো টাকা ছিল না। সে সময় তার শিক্ষকরা হাটে চাঁদা তুলে তিন মাস চলার মতো খরচ ১৫০ টাকা আতিউরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এরপর আতিউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। শিক্ষা তার জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল। শিক্ষকদের সেদিনের সহযোগিতা তিনি স্মরণে রেখেছেন। প্রান্তিক সমাজের মানুষ আতিউর রহমানের জীবনের রূপান্তর ঘটেছে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগের মাধ্যমে।

অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের শিক্ষাজীবনও প্রতিকূল পরিস্থিতিকে জয় করার। তিনি ১৯৭০ সালে তৎকালীন পুরো পাকিস্তানে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। রেকর্ড নম্বর পাওয়ায় তাকেলোটাসউপাধি দেয়া হয়েছিল। তার শুরুর পরিস্থিতিও ছিল কঠিন। শৈশবে দারিদ্র্যের কারণে স্কুল থেকে নাম কাটা গিয়েছিল অনেকবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যখন সুযোগ পান তখন তার কাছে ঢাকায় যাওয়ার মতো টাকা নেই। ঢাকায় পড়াশোনা করতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। তিনিও আজ যে অবস্থানে এসেছেন তার ভিত তৈরি করেছে শিক্ষাজীবনের অর্জন।

. আতিউর রহমান কিংবা মুস্তফা কামালের মতো উদাহরণ আমাদের সমাজে খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। আজকের সমাজের সফল মানুষদের জীবন বদলে দিয়েছে শিক্ষা। প্রান্তিক অবস্থানে থাকা এমন মানুষদের পুঁজি ছিল কেবল পড়াশোনা। এর বাইরে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ব্যবসাবিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা স্বাধীন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছেন; তাদেরও নির্মাণপর্ব সম্পন্ন হয়েছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই। 

৫০ বছর পেরিয়ে এসে বাংলাদেশের বিভিন্ন অগ্রগতি নিয়ে আলাপ হচ্ছে। উপস্থাপিত হচ্ছে অবকাঠামোসহ অর্থনীতির উন্নয়নের অনেক পরিসংখ্যান। জিডিপি বা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নিয়ে কথা হচ্ছে অনেক। কিছুদিন আগেই অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অর্থনীতির অর্জন রূপকথার গল্পকে হার মানিয়েছে।

এর বিপরীতে শিক্ষা খাতের অর্জন নিয়ে কারো কোনো কথা শোনা যায় না। শিক্ষা খাতে মান বৃদ্ধি বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত অর্জন সামনে তুলে ধরার মতো তেমন কোনো তথ্য নেইও। পর্যন্ত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গৌরবময় কোনো বার্তা নীতিনির্ধারকরা দিতে পারেননি। যদিও তাদের অনেকেই নিজেদের ভাগ্য বদল করেছেন শিক্ষার জাদু দিয়ে। কিন্তু এখন তারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার মতো কোনো উদ্যোগ বা সাফল্যের নিশানা দেখাতে পারছেন না।

আজকের বিশ্বে শিক্ষাকেই ধরা হয় উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি হিসেবে। সামষ্টিক উন্নয়নের পথে যেকোনো অর্জনকে টেকসই করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষিত মনন। জাতিগত প্রগতির বড় শর্তগুলো নিশ্চিত করতে প্রয়োজন দেশের জনসাধারণের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনাগুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার। সেক্ষেত্রে শিক্ষার চেয়ে কার্যকর আর কোনো হাতিয়ার নেই।

বাংলাদেশ অধ্যায়ে এসে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে গর্ব করার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারিনি। দেশের ভেতরে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিংহভাগই গড়ে উঠেছে স্বাধীনতার আগে। এর মধ্যে অনেকগুলো গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েও ফেলেছে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববঙ্গের সমাজ-রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে, দেশের মেধাবীদের গড়ে তুলেছে; সে বিশ্ববিদ্যালয় আজ শিক্ষার উৎকর্ষ  আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ঢাকা কলেজের মতো প্রাচীন, খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান শিক্ষাগত অর্জনের চেয়ে রাজনৈতিক সহিংসতা, দলাদলির জন্য খবরের শিরোনাম হয় বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেশ গড়ার জন্য মানবসম্পদ তৈরির কারখানা না হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনুগত কর্মীবাহিনী তৈরির ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। প্রক্রিয়া চলছে দশকের পর দশক ধরে। সামরিক শাসকরা ক্ষমতা ছাড়ার পর গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায়ও এর কোনো বিকল্প যাত্রা দেখা যায়নি।

শুধু শিক্ষার্থীরাই নন, শিক্ষকরাও এখন প্রবলভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, তাদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুগত কর্মীর মতো আচরণ করেন। জাতি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক নির্মাণ এবং দেশের উন্নয়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা থাকা প্রয়োজন ছিল তা দেখা যায় না।

পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া আমরা সমাজ, অর্থনীতি সংস্কৃতিতে দেখতে পাচ্ছি।

পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেয়া দেশগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো সাধারণ-উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা। তাদের অর্থনীতিতে জোয়ার-ভাটা আসতে পারে, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শত শত বছর ধরে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা নিয়ে টিকে আছে। যুক্তরাজ্যের কথাই ধরা যাক। দেশটি একসময় সারা দুনিয়া শাসন করত। এখন আর ব্রিটিশদের সেই দিন নেই। কিন্তু দেশটির প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো বিশ্বের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় জ্বলজ্বল করছে। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রও এগিয়েছে শিক্ষাকে পুঁজি করে। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় সেরা শিক্ষার্থীদের নজর থাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। বিভিন্ন র্যাংকিংয়ে দেখা যায়, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, কেমব্রিজ বা স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্বের সেরা সবচেয়ে সম্মানজনক হিসেবে বিবেচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবই যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিউএস (কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস) এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে গত বছর যে র‍্যাংকিং প্রকাশ করেছে তাতে শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানও নেই। র‍্যাংকিংয়ে প্রথম স্থানটি পরপর কয়েক বছর ধরে রেখেছে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। আর ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্থান ১৩৪তম। বৈশ্বিক পর্যায়ের র‍্যাংকিংয়ে (কিউএস ওয়ার্ল্ড) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০০ থেকে হাজারের মধ্যে। বলা প্রয়োজন, এটাই র্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়া বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থান।

কিউএস এশিয়া র‍্যাংকিংয়ে মহাদেশের সেরা ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটিই চীনের। সেরা ৫০০-এর মধ্য চীনের বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১২৪টি। একসময়ে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের চেয়েও অনেক দুর্বল অবস্থানে ছিল দেশটি। এডিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব বাংলার মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ৩৭২ ডলার (২০১০ সালের ডলারের বিনিময় হারকে ভিত্তি ধরে) একই সময়ে চীনে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল মোটে ১৯২ ডলার।

সেখান থেকে ক্রমেই সামনে এগিয়ে এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠেছে চীন। এক্ষেত্রে মূল কৃতিত্বের দাবিদার শিক্ষা ব্যবস্থা। কিউএস এশিয়া র‍্যাংকিংয়ের দিকে তাকালেই দেশটির শক্তির উৎস সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।

পূর্ব এশিয়ার আরেক বড় শক্তি দক্ষিণ কোরিয়ারও যাবতীয় অগ্রগতির পেছনে মূল কৃতিত্ব দেয়া হয় দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থাকে। দক্ষিণ কোরিয়ার রূপান্তরের রূপকার পার্ক চুং হি ক্ষমতায় বসেই প্রথমে নজর দিয়েছিলেন শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে। শিক্ষা খাতে কঠোর সমতাবাদী আদর্শের প্রয়োগ করে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে জোর দিয়েছিলেন তিনি। কোরিয়া যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেশটির আজকের অবস্থান তৈরিতে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে শিক্ষা ব্যবস্থা। কিউএস এশিয়া র্যাংকিংয়ের শীর্ষ ৫০০টিতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৫।

এছাড়া তালিকায় ভারতের ১০৬টি জাপানের ৯৮টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে। তালিকায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আছে মোটে ১১টি, যার কোনোটিই শীর্ষ ১০০-এর মধ্যে নেই।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন গবেষণা উদ্ভাবনের দিক থেকে সামনে এগোনোর বদলে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। মৌলিক জ্ঞানের বিকাশেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবদান রাখতে পারছে না। এক্ষেত্রে যাদের মুখ্য ভূমিকা রাখার কথা, সে শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে। নিয়ে রয়েছে গুরুতর সব অভিযোগ। আবার মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে ঠিকই। একপর্যায়ে সেটিও মুখ থুবড়ে পড়ছে। দক্ষ প্রশিক্ষিত একাডেমিক লিডারশিপ গড়তে ২০১৪ সালে দেশের ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়েছিল সেন্টার অব এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং (সিইটিএল) কর্মসূচিটির আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ কাউন্সিলের কারিগরি সহায়তায় চালু হওয়া কর্মসূচিটির সেন্টার এর জনবল কাঠামোকে রাজস্ব খাতেও নিয়ে আসা হয়েছিল। দেয়া হয়েছে বার্ষিক অর্থ বরাদ্দও। তাতেও খুব একটা সুফল পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে সিইটিএলগুলো। এজন্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের অভাব এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অনুপস্থিতিকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে।

উচ্চশিক্ষার অন্যতম বড় উদ্দেশ্য হলো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি। এদিক থেকে মোটেও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি শত শত কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হচ্ছে। এতে প্রতি বছর লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এদের বড় অংশেরই স্থান হচ্ছে না। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিপুলসংখ্যক বিদেশী বিশেষজ্ঞ কাজ করেন। অনেক ছোট উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতে হয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা দক্ষ জনশক্তির জোগান দিতে পারলে এমনটা হওয়ার কথা নয়।

এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যমানগুলোর মান বাড়াতে সচেষ্ট হওয়ার পরিবর্তে স্থাপন করা হচ্ছে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার চেয়ে নানা রকম দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা নিয়ে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে নিয়মিত। দেশের নানা উন্নয়নের পরিসংখ্যানের পাশে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমন চিত্র একেবারেই বেমানান।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন, প্রশিক্ষণ, উন্নত-বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠক্রম নিশ্চিত করা যায়নি। বহুমাত্রিক বহুস্তরীয় সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। এক দেশে চালু আছে একাধিক শিক্ষা পদ্ধতি। পরিস্থিতি পরিকল্পিতভাবে দক্ষ প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ তৈরির পথে বাধা।

গত পাঁচ দশকে দেশে কয়েক হাজার নতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনুমোদন পেয়েছে। এর প্রায় সবই বেসরকারি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারি তদারকি নজরদারি তেমন একটা নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানই ভুগছে প্রয়োজনীয় অর্থ অবকাঠামো সম্পদের অভাবে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার যারা নিয়োগ পাচ্ছেন, তাদের মান দক্ষতা নিয়ে রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই পড়াচ্ছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক। গত কয়েক বছরে মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর মান বৃদ্ধিবিষয়ক তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে পর্যন্ত বেশকিছু প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হলেও সরকারি উদ্যোগে ভালো মানের নতুন কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠার নজির পাওয়া যায় না।

বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর বড় একটি অংশ ভুগছে অবকাঠামো সংকটে। তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়কে অত্যাবশ্যক করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিষয়টি পড়ানোর মতো পর্যাপ্ত উপকরণ দক্ষ শিক্ষক নেই। খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬০ শতাংশের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব নেই। এমন নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত আজ পর্যন্ত শক্ত করে তোলা যায়নি।

নড়বড়ে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে প্রাথমিক শিক্ষাও। পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই বিষয়টি সামনে চলে আসছে। প্রাথমিক শেষ করেও গণিতের ন্যূনতম জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু। এক্ষেত্রে দায়ী করা হচ্ছে শিক্ষকদের দক্ষতার অভাবকে। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) এক জরিপভিত্তিক গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রাথমিক পর্যায়েও গণিতের মতো বিষয় শেখাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। পর্যায়ের প্রায় শতভাগ শিক্ষকের কাছেই গণিত শেখানোর বিষয়টি কঠিন। কারো কারো কাছে পাঠ্যবইয়ের কিছু কিছু অধ্যায় এখনো দুর্বোধ্যই রয়ে গিয়েছে।

একই দশা ইংরেজি ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রেও। বিষয়টিতে দুর্বলতা নিয়েই প্রাথমিক স্তর শেষ করছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার ভিত্তি পর্বের দুর্বলতা সংক্রমিত হচ্ছে পরবর্তী স্তরগুলোয়ও। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ও শিক্ষার্থীরা শেষ করছে ইংরেজিতে দুর্বলতা নিয়েই। আন্তর্জাতিক সমীক্ষাও বলছে, ইংরেজি দক্ষতায় বাংলাদেশের অবস্থান খুব একটা ভালো নয়। যদিও ব্যবসা, শিক্ষা, গবেষণা থেকে শুরু করে বিদেশ ভ্রমণ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই ইংরেজি ভাষার দক্ষতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ভাষা সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান এডুকেশন ফার্স্টের (ইএফ) ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী, ইংরেজি মাতৃভাষা নয় এমন ১১২টি দেশের নাগরিকদের মধ্যে ভাষাটিতে দক্ষতার দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান ৬৫তম। এদিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান নেপাল এমনকি আফ্রিকার ইথিওপিয়ার চেয়েও পিছিয়ে বাংলাদেশ।

এমনকি প্রাথমিকের প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাতৃভাষা বাংলায়ও দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না বলেও সাম্প্রতিক এক তথ্যে উঠে এসেছে।

কারিগরি শিক্ষার প্রচলন হয়েছিল বেকারত্ব ঘোচাতে। উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতদের ৭৫ শতাংশই তাদের ডিগ্রি অর্জনের পর অন্তত এক বছর বেকার থাকছে। জীর্ণশীর্ণ অবকাঠামো পুরনো প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার কারণে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছে না কারিগরি শিক্ষা।

এক্ষেত্রেও শিক্ষকদের দক্ষতার অভাব নিয়ে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীরাও বলছেন, শিক্ষকরা তাদের যথোপযুক্ত পাঠদানে ব্যর্থ হচ্ছেন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে কয়েক বছর আগে এইচএসসি (বিজনেস ম্যানেজমেন্ট) কোর্সের মান যাচাই বাজার উপযোগী করার লক্ষ্যে একটি গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ পরিচালিত ওই গবেষণার ২০২০ সালে প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের ৯২ শতাংশেরও বেশি শিক্ষকের মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মনে করছেন, তাদের শিক্ষকদের মান খুবই খারাপ পর্যায়ের।

নানা সংকটে জর্জরিত দেশের শিক্ষা খাতকে আরো দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছে মহামারীর অভিঘাত। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শ্রেণীকক্ষ-বিচ্ছিন্ন থেকেছে দেশের শিক্ষার্থীরা। অনলাইনে দূরশিক্ষণ পদ্ধতি চালু করেও সংকট কাটানো যায়নি। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষকই চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘ ছুটি আর্থিক দুরবস্থার কারণে ঝরে পড়েছে অনেক শিক্ষার্থী। দীর্ঘদিন ঘরে আটকে থেকে বিষাদগ্রস্ততা বিষণ্নতার মতো মানসিক সংকটে ভুগেছে শিক্ষার্থীরা। এমনকি সময় বাল্যবিবাহের সংখ্যাও বেড়েছে, যার জন্য দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকাকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, দেশের শিক্ষা খাতে মহামারীর প্রাদুর্ভাব যে ক্ষত তৈরি করেছে, সে শূন্যতা পূরণ করাটাও খাতসংশ্লিষ্টদের জন্য এখন বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উন্নত দেশ গড়তে ভালো শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প নেই। আমাদের উন্নয়ন ভাবনার একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে না পারা। সমাজের ক্ষমতাবানরা উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক তুলে ধরছেন। কিন্তু তারা কেউ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির কোনো খবর শোনাতে পারছেন না। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনার রূপরেখাও দেখা যাচ্ছে না। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারত, তাহলে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে আমাদের অর্থনীতি, গণতন্ত্র, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি আরো সমৃদ্ধ শক্তিশালী হতো তাতে সন্দেহ নেই।

দেওয়ান হানিফ মাহমুদ: সম্পাদক, বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন