ব্যাংক খাতকে পাশ কাটিয়ে কি বড় হচ্ছে দেশের জিডিপি

হাছান আদনান

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ব্যাংকের সম্পদ প্রবৃদ্ধি কেমন হয়, সেটি নিয়ে একটি চমত্কার ধারণা দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ অ্যান্ড্রু হ্যালডন। দীর্ঘদিন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রধান অর্থনীতিবিদের দায়িত্বে থাকা হ্যালডন বলেছিলেন, ১৮৮০-এর দশকে যুক্তরাজ্যের মোট ব্যাংক অ্যাসেট বা সম্পদ ছিল দেশটির জিডিপির শতাংশ। কিন্তু বুদবুদের চরম সময়ে সেটি ৫০০ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। এরপর বিশ শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের তিনটি বড় ব্যাংকের একত্রীকরণের ফলে তাদের মিলিত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় দেশের মোট জিডিপির শতাংশ। শতাব্দীর শেষে তা বেড়ে হয় ৭৫ শতাংশ। ২০০৭ সাল নাগাদ সেটি পৌঁছে যায় এক বিস্ময়কর অংকে, ২০০ শতাংশ।

অ্যান্ড্রু হ্যালডন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন, সেটির মূল ভাষ্য হলো উদীয়মান অর্থনীতিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে ব্যাংকের সম্পদ প্রবৃদ্ধি হবে বহুগুণ বেশি। যদিও যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক বুদবুদের বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে। এক দশকের বেশি সময় ধরে জিডিপির উচ্চপ্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের ব্যাংক খাতের সম্পদ বড় হতে পারেনি। ২০১৬ সাল শেষে দেশের ব্যাংক অ্যাসেট টু নমিনাল জিডিপি রেশিও বা জিডিপি-ব্যাংক সম্পদের অনুপাত ছিল ৬৬ শতাংশ। পাঁচ বছর পর ২০২১ সালে অনুপাত না বেড়ে উল্টো ৬১ শতাংশে নেমে এসেছে।

অথচ পাঁচ বছরে দেশের জিডিপিতে নতুন করে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ২৬৫ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে জিডিপির আকার ৪১৬ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে।

জিডিপির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ব্যাংক খাতের সম্পদের প্রবৃদ্ধির অসামঞ্জস্যতা নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো একটি অর্থনীতির দেশে জিডিপি-ব্যাংক সম্পদের অনুপাত শতভাগের বেশি হওয়ার কথা। কেননা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ৯০ শতাংশই ব্যাংকনির্ভর। শিল্প থেকে অবকাঠামো, সবকিছুই নির্মিত হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাংকঋণে। পরিস্থিতিতে জিডিপির অনুপাতে ব্যাংকের সম্পদ ৬০ শতাংশের ঘরে আটকে পড়া রহস্যজনক।

শুধু জিডিপি-ব্যাংক সম্পদের অনুপাতই নয়, বরং গত কয়েক বছরে দেশের ব্যাংক খাতে রিটার্ন অন অ্যাসেট (আরওএ) বা সম্পদের বিপরীতে আয় ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। ২০১৫ সালেও ব্যাংক খাতের আরওএ ছিল দশমিক শতাংশের ঘরে। কিন্তু বর্তমানে আরওএ দশমিক শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ আরওএর বৈশ্বিক গড় দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর উন্নত দেশগুলোর ব্যাংক খাতের সম্পদের বিপরীতে আয় শতাংশেরও বেশি।

ব্যাংকাররা বলছেন, দেশের ব্যাংক খাতের সম্পদ বা ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অনুৎপাদনশীল। খেলাপি হয়ে পড়া সম্পদ থেকে রিটার্ন পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোসহ বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংকের অবস্থাই নাজুক। কারণে দেশের ব্যাংক খাতের আরওএ কমছে। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যাংক খাতের অংশগ্রহণ বাড়ছে না।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরও বলছেন, জিডিপির আকার প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দেশের ব্যাংক খাতের সামঞ্জস্য নেই। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশের জিডিপির আকার প্রবৃদ্ধির হার অনুযায়ী জিডিপি-ব্যাংক সম্পদের অনুপাত শতভাগের বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি, আমাদের দেশে অনুপাত ৬০ শতাংশের ঘরে ওঠানামা করছে। চীনে জিডিপি-ব্যাংক খাতের সম্পদের অনুপাত ২০০ শতাংশেরও বেশি। ভারতেও এটি ১০০ শতাংশের ওপরে। প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যাংকের সম্পদ না বাড়লেও জিডিপির আকার প্রবৃদ্ধি কিসের ভিত্তিতে বাড়ছে, সেটি সংশ্লিষ্টরাই বলতে পারবেন।

প্রতি অর্থবছরের শুরুতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করে বাজেট ঘোষণা করে সরকার। বাজেটের পর সরকার ঘোষিত লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, গত কয়েক বছরই তা অর্জিত হচ্ছে না। এমনকি সর্বশেষ দুই অর্থবছরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে শতাংশের ঘরে। যদিও মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১৫ শতাংশের বেশি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির সংকটের মধ্যেও সরকার জিডিপির বড় প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।

জিডিপিতে দেশের ব্যাংক খাতের অংশগ্রহণ নিয়ে ব্যাংকাররাও সন্তুষ্ট নন। প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ব্যাংক খাতের সম্পদের বিপরীতে আয় খুবই কম। কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ব্যাংক খাতের অংশগ্রহণ সন্তোষজনক মাত্রায় নেই। যে হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে ব্যাংক খাতের সম্পদ বাড়ার কথা। কিন্তু ব্যাংক খাতে আমরা সে প্রবৃদ্ধি দেখছি না। দেশের ব্যাংক খাত শক্তিশালী হওয়ার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সুশাসনের ঘাটতি। ঘাটতি শুধু ঋণ বিতরণে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ, রীতিনীতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই সুশাসন কার্যকর করতে হবে।

জনগণ রক্ষণশীল হওয়ার কারণে বাংলাদেশের জিডিপি-ব্যাংক সম্পদের অনুপাত কম বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর . মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের দেশে মূলধন সম্পদ গঠন প্রক্রিয়াটি ধীর। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষ অনেক বেশি রক্ষণশীল। দুটি কারণে জিডিপি-ব্যাংক সম্পদের অনুপাত বাড়ছে না। উন্নত দেশগুলোতে মানুষ ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যয় করতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ এখনো অন্যের কাছ থেকে ধার নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ঋণ নেয়ার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় অর্থনীতিতে মানিটাইজেশন হচ্ছে না।

ফরাসউদ্দিন বলেন, জিডিপির উচ্চপ্রবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিক, কিন্তু এর সুফল গণমানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। অল্প কিছু মানুষের প্রবৃদ্ধির ফল আটকে গেছে। অর্থনীতি মানিটাইজড না হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহারসহ মুদ্রানীতির অন্য উপাদানগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে না।

বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে বিভিন্ন ধরনের লিকেজ আছে। অর্থনীতির প্রাণ খাতে স্বচ্ছতারও ঘাটতি আছে। একটি সুস্থ অর্থনীতি বিনির্মাণ করতে হলে ব্যাংক খাতের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাদের যেকোনো পরিসংখ্যান গবেষণা যেন স্বচ্ছ হয়, সেদিকে নজর দেয়া দরকার। বাংলাদেশের জিডিপি এখন ৪১৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু জিডিপি-ব্যাংক সম্পদের অনুপাত কম কেন, সেটি সংশ্লিষ্টরা ভালো বলতে পারবেন। দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন