নওগাঁর মোহাম্মদ আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড

অখ্যাত কোম্পানি দুই বছরেই দেশের অন্যতম শীর্ষ ঠিকাদার

শামীম রাহমান

নওগাঁর ঠিকাদার মোহাম্মদ আমিনুল হক। ঠিকাদারি ব্যবসায় যুুক্ত রয়েছেন দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে। তবে আলোচনায় এসেছেন গত চার বছরে। সড়ক জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের একের পর এক কাজ পেয়ে বনে গিয়েছেন সংস্থাটির অন্যতম শীর্ষ ঠিকাদার। গত দুই বছরে আমিনুল হকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদ আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড হাজার ৬৭৯টি কার্যাদেশ পেয়েছে, যা সময়ে সওজ থেকে হওয়া মোট কার্যাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ। এসব কাজের বেশির ভাগই আবার মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে অন্য ঠিকাদার। অভিযোগ রয়েছে, নির্দিষ্ট কমিশন নিয়ে ছোট ঠিকাদারদের মধ্যে কাজ বিক্রি করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। রয়েছে লাইসেন্স ভাড়া দেয়ার অভিযোগও। যদিও প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আমিনুল বলছেন, বিক্রি নয়, পরিচিত নানাজনের অনুরোধ ফেলতে না পারায় কাজগুলো তাদের দিয়েছেন তিনি।

বণিক বার্তার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গত চার বছরে আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেডের নামে পাওয়া বেশির ভাগ কাজ বাস্তবায়ন করেছেন অন্য ঠিকাদাররা। বিশেষত বিভিন্ন জেলার স্থানীয় ঠিকাদাররাই মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন। বগুড়া-জয়পুরহাট মহাসড়ক, মোকামতলা-জয়পুরহাট মহাসড়ক, ঢাকা-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের বগুড়া সড়ক বিভাগের অংশ, কাহালু থানা সংযোগ সড়ক, বগুড়া-ক্ষেতলাল মহাসড়ক কাহালু-আদমদীঘি মহাসড়কবগুড়া সড়ক বিভাগ থেকে গত বছর ছয়টি সড়ক উন্নয়নের কাজ পায় আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড। তবে মাঠ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি কেবল বগুড়া-জয়পুরহাট মহাসড়কের উন্নয়নকাজ নিজে করেছে। বাকি কাজগুলো করেছেন স্থানীয় ঠিকাদাররা। দেশের ৫৮টি সড়ক বিভাগে আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেডের পাওয়া বেশির ভাগ কাজই এভাবে অন্য ঠিকাদাররা করেছেন এবং এখনো করছেন।

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ঠিকাদারদের কাছে নির্দিষ্ট হারে কমিশন নিয়ে কাজ বিক্রি করেছেন আমিনুল হক। যদিও আইনে এভাবে কাজ বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। আইন অনুযায়ী একজন ঠিকাদার তার লাইসেন্সের বিপরীতে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাওয়া কাজের কোনো নির্দিষ্ট অংশ বাস্তবায়নের জন্য সহঠিকাদার নিযুক্ত করতে পারেন, পুরো কাজের জন্য পারেন না। আইনের লঙ্ঘন হলেও এভাবে কাজ বিক্রি এখন সওজ অধিদপ্তরে ওপেন সিক্রেট। কাজ বিক্রির পাশাপাশি আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেডের লাইসেন্স ভাড়া নিয়েও বিভিন্ন দরপত্র প্রক্রিয়ায় ছোট ঠিকাদাররা অংশ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তবে ঠিকাদার আমিনুল হক জানান, তিনি কারো কাছে কখনই কাজ বিক্রি করেননি। পরিচিত অনেকের অনুরোধ ফেলতে না পারায় নিজের কার্যাদেশ অন্য ঠিকাদারদের দিয়েছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমি সব সময় সত্ভাবে ব্যবসা করে এসেছি। এখনো নিজে মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কাজের তদারকি করি। সততা আর পরিশ্রমই আমার মূল শক্তি। আমার প্রতিষ্ঠান যেসব কাজ পাচ্ছে, সেগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পাচ্ছে। আর কাজ বিক্রির যে অভিযোগ, তা সত্য নয়। অনেক সময় পরিচিত অনেকেই আমার কাছে কাজ চান। তাদের অনুরোধ ফেরাতে পারি না। মানুষের উপকার করতে গিয়ে আজ আমি নিজেই অন্যদের চোখে পড়ে গিয়েছি, যা আমার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

নিজের কাজ অন্য ঠিকাদারদের দিয়ে দেয়া বেআইনিএমন কথার উত্তরে তিনি বলেন, আইন মেনে চললে তো সড়কের বেশির ভাগ ঠিকাদারই কাজ করতে পারতেন না।

সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা বলছেন, ঠিকাদার বাছাইয়ে ম্যাট্রিক্স পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে মহীরুহে পরিণত হয়েছেন আমিনুল হকের মতো গুটিকয়েক ঠিকাদার। পদ্ধতিতে ঠিকাদার নির্বাচন করা হয় ৩০০ নম্বরের ভিত্তিতে। এতে একজন ঠিকাদারের গত পাঁচ বছরের কাজের জন্য থাকে ১৪০ নম্বর। আরো ১০০ নম্বর থাকে সর্বশেষ পাঁচ বছরে পাওয়া কার্যাদেশের চুক্তি মূল্যে। আর ৬০ নম্বর দেয়া হয় চলমান কাজের চুক্তি মূল্য নিরূপণের ভিত্তিতে। দরপত্রে অংশগ্রহণ করা যেসব ঠিকাদারের অতীতে বর্তমানে কাজ করার অভিজ্ঞতা বেশি, তাদের হাতেই কাজ যায় বেশি।

প্রকৌশলীরা বলছেন, কাজগুলো মাঠ পর্যায়ের ঠিকাদাররা বাস্তবায়ন করলেও লাভবান হচ্ছেন গুটিকয়েক ঠিকাদার। ম্যাট্রিক্স পদ্ধতিতে বেশি নম্বর পেয়ে এসব ঠিকাদারের আরো কাজ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এভাবে রীতিমতো চক্রাকারে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন তারা।

আমিনুল হকের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়ার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী নেতাদের প্রভাব বলয়ে থেকে একের পর এক কাজ পেয়ে যাচ্ছেন আমিনুল। তার মামি শাহিন মনোয়ারা হক স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে দুই দফায় সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমিনুল হকের মামাও ছিলেন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার।

ঠিকাদার আমিনুল নওগাঁ সদরের পার নওগাঁ এলাকার বাসিন্দা। নব্বইয়ের দশকে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। শুরু থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি সওজ অধিদপ্তরে ঠিকাদারি করেছেন মো. আমিনুল হক নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত আমিনুল হকের পাওয়া কাজের সংখ্যা হাতে গোনা। এগুলোরও একটা অংশ আবার তিনি পান অন্য কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে।

২০১৫ সালের পর প্রতিষ্ঠানটিকে লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করেন আমিনুল। নাম বদলে রাখেন মোহাম্মদ আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড। লিমিটেডে পরিণত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি সওজ অধিদপ্তরে প্রথম কাজ পায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএস শামীম কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে পাওয়া কাজটির চুক্তি মূল্য ছিল ১৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে এই একটিই কাজ পায় মোহাম্মদ আমিনুল হক প্রাইভেট লিমিটেড।

সওজ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে মাত্র একটি কাজ পাওয়া আমিনুল হক পরের বছরে পান ১৬০ কোটি টাকার ৪৫টি কাজ। ২০১৯ সালে পান ২০২ কোটি টাকার কাজ। বেশির ভাগই ছোট ছোট কাজ, যেগুলোর চুক্তি মূল্য ছিল ৮০ কোটি টাকা। করোনা মহামারী শুরুর বছর ২০২০ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক কাজ পায় তার প্রতিষ্ঠানটি। কাজের সংখ্যা ছিল হাজার ১২৯টি। এসব কাজের চুক্তি মূল্য ৬৪৯ কোটি টাকা। আর গত বছর প্রতিষ্ঠানটি পায় ৩১৯ কোটি টাকার ৫৫০টি কাজ। শেষ দুই বছরে দেশের ৬৫টি সড়ক বিভাগের মধ্যে ৫৮টি বিভাগ থেকেই কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

আমিনুল হকের পাওয়া এসব কাজের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করেছেন স্থানীয় ছোট ঠিকাদাররা। যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন দিয়ে কাজগুলো কিনছেন। ভালো কাজ করার জন্য সওজ অভিজ্ঞ ঠিকাদার নিয়োগ দিলেও মাঠ পর্যায়ে কাজগুলো চলে যাচ্ছে স্থানীয় অনভিজ্ঞ ঠিকাদারদের কাছে। প্রায়ই তাদের করা কাজের মান নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। এসব বিষয় সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর বণিক বার্তাকে বলেন, অধিদপ্তরের অল্প কয়েকজন ঠিকাদার বেশির ভাগ কাজ পেয়ে যাচ্ছেন, বিষয়টি সত্যি। আমি প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব নেয়ার পর অবস্থা পাল্টাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের দরপত্র প্রক্রিয়ায় বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। গত এক বছরে এর সুফলও আমরা পেতে শুরু করেছি। তবে সামগ্রিকভাবে দেশের দরপত্র প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ছাড়া সমস্যা দূর করা কঠিন। বিষয়টি সমাধানে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কাজ করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার বগুড়া প্রতিনিধি এইচ আলিম।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন