সাত সতেরো

প্রজন্মান্তরে বদলে যাওয়া সামাজিক মূল্যবোধ

ড. মো. আব্দুল হামিদ

এক তরুণ তার প্রেমিকাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। নানা কথায় সেটা বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটা আরো সুনির্দিষ্টভাবে বুঝতে চায়: প্রেমিক পুরুষ তার জন্য আসলেই কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত? একদিন ছেলেটাকে কঠিন এক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। মেয়েটা বলে, তোমার মায়ের কলিজাটা আমার হাতে এনে দিতে হবে। সেটা করতে পারলে তবেই বুঝব, পৃথিবীতে তুমি আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো!

ছেলেটা জানত, তার মা সন্তানের জন্য ঠিক কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। তার সুখের জন্য মা সব করতে পারে। তাই তার মাকে গিয়ে কথাটা সরাসরি বলল। মা বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে গেল। ছেলেটা তার মায়ের কলিজা হাতে নিয়ে তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে প্রেমিকার কাছে! প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথ সে দ্রুত অতিক্রম করতে চায়।

এমন সময় হোঁচট খেয়ে সে পড়ে যায়। তখন কলিজাটা বলে ওঠে: ব্যথা পেয়েছিস, বাবা?

হাইস্কুলে পড়াকালে গল্পটা শুনেছিলাম আমার বাবার কাছে। কিশোর মনে তখন খুব মিশ্র এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমাদের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? সেদিন তিনি সরাসরি কোনো জবাব দেননি। শুধু বলেছিলেন, সময় পরিস্থিতি সেটা বলে দেয়!

পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন, পরবর্তী সময়ে সেই প্রশ্নের জবাব পেয়েছি কিনা? আসলে হরেক রকম খেলনার দোকানে ছেড়ে দিলে শিশুরা যেমন কনফিউজড হয়ে যায়; আমার হয়েছে সেই দশা! জীবনের নানা অধ্যায়ে অগণিত মানুষের সান্নিধ্যে গিয়ে মনে হয়েছেসেই প্রশ্নের জবাব বুঝি পেয়ে গেলাম। পরক্ষণে আবার তা ভুলও প্রমাণিত হয়েছে। এভাবে ভুল করে, ভুল করা নামই বুঝি জীবন!

সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের প্রতিনিয়ত নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। জীবনকে গতিশীল রাখতে তা অপরিহার্য। কিন্তু ইদানীং কেন যেন মনে হচ্ছে চারপাশে মানুষ-এর অভাব ক্রমেই তীব্র হচ্ছে! বলতে পারেন, সর্বত্র এত মানুষ গিজ গিজ করছে; কোথাও একটু স্বস্তিতে দাঁড়ানোর উপায় নেই। আর আমি কিনা বলছি মানুষের দুষ্প্রাপ্যতার কথা!

সত্যিই তাই। সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে হয়তো আপাতত জনসংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু নিজ পরিবার, বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের দিকে সচেতনভাবে তাকান। হিসাবটা কেমন যেন গোলমেলে ঠেকবে! দেশের মোট জনসংখ্যা বাড়লেও কাছের মানুষের পরিবারে সদস্য সংখ্যা কমছে। দাদা-বাবা-আপনার সন্তানদের সংখ্যার প্রবণতা লক্ষ করলেই তা স্পষ্ট হবে। সংকট ক্রমেই প্রবল হচ্ছে।

আগের দিনে বিপদ-আপদে না ডাকতেই আত্মীয়-স্বজন এসে হাজির হতো। মাঝেমধ্যে তাদের বাড়িতে যাতায়াত হতো। এভাবেই পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক গভীর হতো। এখন প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। তাদের সন্তান-সন্ততি সংখ্যাও কমছে। পড়ালেখা বা কাজের সুবাদে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করতে হচ্ছে। যারা বাসাবাড়িতে থাকছে তাদেরও অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ফলে পারিবারিক বন্ধনের ঐতিহ্য বেশ দ্রুতই হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে।

সংখ্যাগত ঘাটতির দিকটা আমরা (বিশেষত আশি নব্বইয়ের দশকে জন্মগ্রহণকারীরা) জেনে-বুঝেই গ্রহণ করেছি। তার ফলাফল দেখার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু মানুষের গুণগত দিকটা বেশি হুমকির মুখে পড়ছে। সহপাঠী, সহকর্মী, প্রতিবেশী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু আন্তরিক, সহানুভূতিশীল দরদি মানুষের সংখ্যা কমছে। পুরনো মানুষগুলো বিদায় নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন যেন পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

প্রযুক্তির কল্যাণে আজকাল যোগাযোগের সুযোগ বহুগুণ বেড়েছে। চাইলেই প্রত্যাশিত মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। কিন্তু একান্ত মনের কথাগুলো বলার মতো মানুষ সত্যিকারের জন রয়েছে? মোটিভেশনাল স্পিকাররা আমাদের সন্তানদের সফট স্কিলের নামে ভদ্রতা, উপস্থাপনা গ্রহণযোগ্য আচরণ শেখাচ্ছে। কিন্তু আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা আস্থার জায়গায় ঘাটতি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এখন মানুষের বাহ্যিক চাকচিক্য বা সৌন্দর্য যত বাড়ছে, অন্তরের কলুষতা বাড়ছে তার চেয়েও তীব্র গতিতে।

আপনি হয়তো কোনো বন্ধু, সহপাঠী বা সহকর্মীকে একান্ত আপন ভেবে নিজের দুঃখ-কষ্টগুলো প্রতিনিয়ত শেয়ার করছেন, বছরের পর বছর তাকে আশ্রয়স্থল ভাবছেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলেন: সে আপনার দুর্বলতার জায়গাগুলো এমন এক জায়গায় শেয়ার করেছে, যার জন্য আপনাকে হয়তো কঠিন (ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা পেশাগত) সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো। তখন নিজের বোকামির জন্য আফসোস হয়। কিন্তু মানুষ হিসেবে কাউকে না কাউকে তো আস্থায় নিতে হবে, তাই না? কিন্তু তেমন মানুষ মিলবে কোথায়?

হয়তো সে কারণেই আজকাল অধিকাংশ সম্পর্ক হয়ে গেছে বড্ড মেকি; লোক দেখানো। ভদ্রতায় মোড়া, আপাতদৃষ্টিতে সম্প্রীতির পরিবেশ; কিন্তু কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে হয় কৌশলে নিজেকে রক্ষা করতে, নইলে সুবিধা তুলে নেয়ার খেলায় সবাই তত্পর রয়েছে। সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী, বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমছে। পারস্পরিক আস্থা নিরাপত্তার জায়গা হচ্ছে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

সমাজ, কর্মক্ষেত্র এমনকি পরিবারে এমন চর্চা বাড়তে থাকায় কোথাও হয়তো নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে নিজেকে ঠেকাতে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে যাচ্ছেন। ফলে আজকাল প্রাণবন্ত আড্ডা, সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া কিংবা সত্যিকারের মেলবন্ধন হচ্ছে না। অনুষ্ঠানগুলোর জৌলুস বেড়েছে, সাজসজ্জার চমক বেড়েছে। কিন্তু সেগুলো দিয়ে অংশগ্রহণকারীদের প্রাণহীন অভিব্যক্তি গোপন করা যাচ্ছে না। ফলে জনবেষ্টিত পরিবেশে থেকেও আমরা বড় একা হয়ে যাচ্ছি।

মাঝেমধ্যে মনে হয়, আগের দিনে বোকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। তাদের চাহিদা ছিল কম, ছিল ত্যাগের মানসিকতা। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মুখের দিকে চেয়ে নিজের অনেক চাওয়া কম্প্রোমাইজ করত। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করত। ফলে নানা কাজের মাঝেও চারপাশের মানুষগুলোর জন্য সময় বের করতে পারত।

কিন্তু বর্তমান সিস্টেম সবাইকে চালাক বানাতে সচেষ্ট রয়েছে। আমি কেন বঞ্চিত হব’— প্রশ্ন দ্বিধাহীনভাবে ছুড়ে দিচ্ছে। কেউ কারো থেকে পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। বরং কে, কাকে, কীভাবে ল্যাঙ মেরে এগিয়ে যাবে তা নিয়ে প্রতিনিয়ত জল্পনা-কল্পনা চলছে।

একসময় দূরবর্তী মানুষের চেয়ে নিজ গোষ্ঠী বা পরিবার লাভবান হওয়ার চেষ্টা থাকত। তারপর আত্মীয়-স্বজনদের চেয়ে নিজ পরিবার লাভবান হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়। এখন তো পরিবারের অন্যান্য সদস্যের চেয়ে নিজের লাভ বোঝা লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

ফলে নিখাদ সম্পর্কগুলোতেও বিষ ঢুকে যাচ্ছে। ধনী-শিক্ষিত-নগরে বসবাসকারী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বেশি থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে? বরং তাদের ব্যক্তি পারিবারিক পর্যায়ে স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে। প্রায় সবাই নিজে লাভবান হতে চায়। অন্যদের কথা ভাবার সময় কোথায়?

ক্ষেত্রবিশেষে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, এক ভদ্রলোক তার সন্তানকে জিজ্ঞাসা করেছেন, তুমি কি চাও তোমার আরেকটা ভাই বা বোন হোক? শিশুটির স্পষ্ট জবাব, না। কারণ জানতে চাইলে বলে: তো ফোনে গেমস খেলে চার্জ শেষ করে ফেলবে। তখন আমি খেলব কেমন করে?

আরেক ছেলেকে তার অসুস্থ বাবা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হয়েছেতোমার আব্বু মারা গেলে তোমার কি খুব কষ্ট হবে? ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাল্টা প্রশ্ন করে: তাহলে তো আব্বুর ফোনটা আমার হবে, তাই না?

এগুলো হয়তো নিছক শিশুমনের নিষ্পাপ ভাবনা। কিন্তু আমাদের পারস্পরিক অনুভূতি যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বোধহয় এখনো ঠিকঠাক ধরতে পারছি না। এখন আর শুধু দূরের মানুষরা আমাদের প্রতিপক্ষ কিংবা প্রতিযোগী নয়। বরং পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, মা-সন্তানের মধ্যেও তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ ছাড় দিতে রাজি নয়। নিজের স্বার্থ রক্ষা বা উদ্ধারে সবাই তত্পর।

ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, মনের টান থাকছে উপেক্ষিত। বাস্তব প্রয়োজনেই আমরা নিত্যদিন হরেক রকম মানুষের সঙ্গে মিশছি, কাজকর্ম করছি। কিন্তু নির্ভর করা বা আস্থা রাখার মতো মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমছে। সবাই এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। আর সেই নিরাপত্তাহীনতার ওপর ভর করে জমে উঠছে নতুন পণ্যের বাজার।

মানুষকে যত বিচ্ছিন্ন করা যাবে, অন্যদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ করে তোলা যাবে, হিংসা ছড়িয়ে দেয়া যাবে... ততই তাদের নতুন নতুন পণ্যের দরকার হবে। এটা বোঝার জন্য আপনার চারপাশে সিসি ক্যামেরার ব্যবহার বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করাই যথেষ্ট।

তাছাড়া রিপলি বিলিভ ইট অর নট থেকে জানলাম, মার্কিন সংগীত তারকা লেডি গাগা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড মিটার কিনেছেন। সেই যন্ত্র দিয়ে নাকি অশরীরী আত্মা শনাক্ত করা যায়! বোঝা গেল ব্যাপারটা? আমরা শিশুদের শেখাই ভূত বলে কিছু নেই। অথচ তারা ভূতের উপস্থিতি চিহ্নিত করার যন্ত্র এরই মধ্যে বিক্রি শুরু করেছে!

অন্যদিকে বছর দশেক আগেও ডে-কেয়ার সেন্টারের ধারণাটি আমাদের দেশে বাঁকা চোখে দেখা হতো। নগরজীবনে এখন তা বেশ গ্রহণযোগ্য। ঠিক তেমনিভাবে বছর দশেকের মধ্যে বৃদ্ধাশ্রম ব্যবসাও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এমন ধারণার প্রচণ্ড বিরোধী মানুষটি নিজেই সেখানে আশ্রয় খুঁজবেন। কারণ নগরে নিঃসন্তান মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যাদের এক-দুটি সন্তান রয়েছে তারাও সফল হয়ে বড় শহর বা বিদেশে পাড়ি জমাবে। জীবনসঙ্গীও চিরদিন থাকবে না। তখন তো আপনাকে সে পথেই হাঁটতে হবে, তাই না?

সব দেখে মনে হয়, চারপাশে অসংখ্য মানুষ থাকলেও দিন শেষে সত্যিকারের মানুষের বড্ড অভাব। সেই এসটি কোলরিজের দ্য রাইম অব দি অ্যানসেইন্ট মেরিনার কবিতার বৃদ্ধ নাবিকের দশা। অথৈ সমুদ্রে জাহাজ ভাসছে। সীমাহীন জলরাশির ওপর তারা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তা এতই লবণাক্ত যে, পান করার মতো এক ফোঁটা পানিও নেই!

 

. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক মস্তিষ্কের মালিকানা বইয়ের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন